ফুল ভালোবাসে না এমন লোক সহজে পাওয়া যাবে না। তাই যারা ফুল ভালোবাসেন তারা ঘুরে আসতে পারেন বাংলাদেশের সব থেকে বড় ফুলের বাজার এবং গ্রাম যশোরের গদখালি থেকে।

সকালে চাষিরা দাঁড়িয়ে থাকবে হরেক রকম ফুল নিয়ে যেমন গোলাপ, গাদা, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস সহ নানা রঙের হরেক রকম ফুল। অনেকই ফুলের রাজধানী বলে থাকে গদখালিকে। সকাল ৮টা নাগাদ জমে ওঠে গদখালি ফুলের বাজার। দেশের ৭০% ফুলের যোগান যশোর থেকে হয়।

এবারে যশোরে যাওয়ার পরিকল্পনা হয় আকস্মিকভাবেই। ব্যক্তিগত কাজেই মূলত যশোরের দিকে যাওয়া। সন্ধ্যা ৭টার চিত্রার ট্রেনের টিকিট কেটে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। বেশির ভাগ সময় ট্রেন লেট থাকে কিন্তু ঐদিন ভাগক্রমে ট্রেন ঠিক সময় ছেড়ে গিয়েছিল।

ঝকঝকাঝক শব্দ করতে করতে ট্রেন এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। কখন ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, আবার কখনোবা আলোর ছটা এসে পড়ছে ট্রেনের গায়ে। আমার দৃষ্টি সীমানা পেরিয়ে ছুটে চলেছে দু’পাশের পৃথিবী। আর তখনই মনে পড়ে গেল শামসুর রাহমানের কবিতার লাইনগুলো…
ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই।
ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?
ছুটন্ত ট্রেন, আলোআঁধারির খেলার মাঝে হুট করেই বোধ করলাম পেট কিছু চাইছে। বেশ কিছুক্ষণ পেটে কিছু পড়েনি। বেশ রাতও হয়ে গেছে। আর তৎক্ষণাৎ সাথে করে আনা নুডুলস মুখে পুরে দেই। আয়েস করে খাবার খেয়ে আহমেদ ছফার প্রবন্ধ সমগ্র খুলে বসলাম।
পড়তে পড়তে চোখটা কখন যেন লেগে এসেছে। ট্রেনের ভেতর থেকে ভেসে আসা শব্দে হুড়মুড় করে জেগে উঠি। ট্রেন ততক্ষণে যশোর জংশনের খুব কাছেই চলে এসেছে। সবাইকে নামার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হয়।

ষ্টেশনে যখন নামলাম তখন রাত ৩টা বাজে। এত রাতে কোথাও যেতে দিচ্ছে না আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। তাই অগত্যা অপেক্ষা করতে হয় ষ্টেশনে। ষ্টেশনে আগে থেকে ভাগ্নে রিফাত অপেক্ষা করছিল, তাই রক্ষা। বাকি রাতটুকু ওর সাথে গল্প করে কাটিয়ে দেই।

ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে বের হই রিফাতের বাসার দিকে। ষ্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে সোজা চলে যাই ওদের বাসায়। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে এক ঘুম দেই। ঘুম থেকে উঠে দেখি বিকাল হয়ে গেছে। তাই সেদিন আরও কোথাও বের হওয়া হয়নি। বাসার আশেপাশের স্থানগুলো ঘুরে দেখি।

পরের দিন হাতে কোনো কাজ না থাকায় সকাল সকাল রওনা হই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ফুলের বাগান ঝিকরগাছার গদখালি গ্রামে। যশোরের চাষড়া চেক পোস্ট থেকে লোকাল বাসে করে গদখালির উদ্দেশ্যে যাত্রা। ৪৫ মিনিট এর মতো লাগে বাসে। চাইলে ট্রেনেও যাওয়া যায়। তবে সময় একটু বেশি লাগবে।

গদখালি যাওয়ার পথে রাস্তার দু’ধারে মাথা উঁচু করে আছে বৃক্ষরাজি। আর যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজে ঘেরা মাঠ।

গদখালি বাজারে নামতেই দেখা মিলবে অস্থায়ী ফুলের দোকান। ২০/৩০ টাকায় ফুলের ট্রফি বিক্রি করছে বাস থেকে আগত মানুষের কাছে। গদখালি বাজারের এই মেইন সড়ক মিলেছে বাংলাদেশের অন্যতম স্থলবন্দর বেনাপোলে। আর তার দু’পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যশোর রোডের শত বর্ষীয়ান গাছ।

গদখালি বাজার থেকে হালকা নাস্তা করে ভ্যানে করে চলে যাই ফুল বাগানের দিকে। গ্রামের দিকে যত ঢুকছি তত চোখ আটকে যাচ্ছে দু’ধারে। রাস্তার দুই পাশে যতদূর চোখ যায় ফুল গাছ আর ফুল গাছ। হরেক রঙের ফুল ছেয়ে আছে। রাস্তার দু’পাশে দিগন্ত জুড়ে ফুলের সমাহার। মনে হবে, হরেক রকমের রঙিন চাদর বিছিয়ে রেখেছে দিগন্তজুড়ে।

পানিসারা, হাড়িয়া, কৃষ্ণচন্দ্রপুর, পটুয়াপাড়া, সৈয়দপাড়া, মাটিকুমড়া, বাইসা, কাউরা, ফুলিয়াসহ অসংখ্য গ্রামের মাঠজুড়ে চোখে পড়বে কেবলই ফুলের বাগান। দেশি বিদেশি নানারকম ফুল চাষ হয় এই অঞ্চলে। ১৯৮২ সালে গদখালি থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষের শুরু হয়েছিল। এখন এই ফুল চাষ ছড়িয়ে পড়েছে শার্শা ও ঝিকরগাছা থানার আরও বেশ কিছু গ্রামে। সারা বছরই ফুল চাষ হলেও ভালো ফুল পাওয়া যায় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে। দেশে ফুলের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়।

ফুলের রাজ্যে গিয়েছি আর কিছু ফুল ছবি তুলবো না- তা কী হয়!

ফুল চাষীদের অনুমতি নিয়ে তাদের ফুলের ক্ষেতগুলো ঘুরে দেখি। রঙবেরঙের ফুল দেখে চোখ ছানাবড়া অবস্থা। এত ফুল একসাথে আমি কোনোদিন দেখিনি।

চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, সারা বছর এখানে ফুল পাওয়া যায়। তবে সব থেকে ভালো ফুল পাওয়া যায় ডিসেম্বরে। আর সব থেকে বেশি ফুল চাষ হয় এই ঝিকরগাছায়। সব থেকে বড় পাইকারি ফুলের বাজার এটি।

তবে গদখালিতে ঘুরতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় শীতকাল। এই সময় মাঠের পর মাঠ জুড়ে ফুলের চাষ করা হয়। ভ্রমণপ্রিয় লোকের উপচে পড়া ভিড় থাকে তখন।

ফুলের সুবাস আর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হচ্ছিলাম প্রতি মুহূর্তে। কী অপরূপ এই দেশ!
ফুলের দর্শন শেষে এবার পর্বরতী গন্তব্যে যাওয়ার পালা।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে করে যশোর। সেখান থেকে রিকশা বা অটো করে চাষড়া। লোকাল বাসে করে গদখালি।
খাওয়ার ব্যবস্থা
গদখালি বাজারে খাবারের দোকান আছে। সেখান থেকে খাবার খেয়ে নেবেন।

সতর্কতা
ফুল চাষির অনুমতি ছাড়া তাদের ক্ষেতে যাবেন না। আপনার দ্বারা ফুল ক্ষেতের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেই দিকে নজর রাখবেন।
অবশ্যই মনে রাখবেন
*যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে দূরে থাকবেন।
*খেয়াল রাখবেন আপনার অতি উচ্ছ্বাসে প্রকৃতির যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
*সঙ্গে নেওয়া পলি প্যাকেট গুলো সঙ্গে নিয়ে ফিরুন।