আবাসস্থল আর রাজধানী – এই দুই শহরের পর তৃতীয় যে শহর দেখেছিলাম, তা হলো কুমিল্লা। স্কুল থেকে শিক্ষাসফরে নিয়ে গিয়েছিল। তখন জায়গার সৌন্দর্য দেখব কী, পিকনিকে এসেছি হৈহুল্লোড় আর ছবি তোলাতুলিতেই সময় গেছে চলে। তাই কী কী দেখেছি, জায়গার নাম মনে থাকলেও, কী দেখেছি – তার বেশির ভাগটাই মনে নেই।
এবারের প্ল্যানটা আমার করা। মানে, সাদামাটা প্ল্যান – আমি ঈদের পর পর গিয়ে তাসনুর সাথে দেখা করে আসবো। মেয়েটাকে এখন পর্যন্ত দেখাই হয়নি। ইচ্ছে ছিল, ডেমো ট্রেনে চেপে বসবো, তারপর সারাটা দিন ওর সাথে কাটিয়ে শেষ বিকেলে ফিরে আসবো।

কথায় কথায় জাকির ভাইয়াকে বললাম। ভাইয়ার বাড়ি ফেনী। উনার জন্য তো আরো কাছে। ভাইয়া শুধু বলল, কবে যাবি, জানাইস।
ভাবলাম, নিলয়কেও জানাই। ওও ট্রেনে চেপে বসলে কতক্ষণই বা লাগবে?
ও বলল, কুমিল্লা? এরজন্য আবার প্ল্যান করা লাগে নাকি! আমার তো মন-টন খারাপ থাকলে কুমিল্লায় চলে যাই।
এতসব পজেটিভ জবাবে খুশি হয়ে বাকিদেরও জানানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। মনে মনে খুব এক্সাইটেড, আরেকটা চমৎকার ট্যুর হতে যাচ্ছে!
ঠিক হলো, ঢাকা থেকে ঢাকাবাসী ছাব্বিশ ক্রুরা আসবে, আমি চাঁদপুর থেকে, জাকির ভাইয়া ফেনী থেকে, নিলয় চট্টগ্রাম থেকে। তাসনু কুমিল্লার হলেও, কুমিল্লার কিছুই চেনে না। সমস্যা নেই, কুমিল্লাবাসী আরেকজন পাওয়া গেছে, অনিক, কুমিল্লার সবকিছু তার নখদর্পনে।

বেড়াতে যাবার যেকোনো একটা প্ল্যানের শুরুতে বিশাল একটা দল থাকে। এটাই নিয়ম। শেষ পর্যন্ত বিশাল দল ছোট হতে হতে তলানীতে এসে পৌঁছায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
কুমিল্লা গিয়ে সবার আগে পা রাখলাম আমি। মিনিট দশেকের মধ্যে তাসনু চলে এলো। মেয়েটা এসেই যে জাপটে ধরেছে, ছাড়াছাড়ির আর নাম নেই। ওর চেহারা দেখেছি চার মিনিট পর। দুজনের গল্প তো আর শেষ হয় না! তারপর এলো জাকির ভাই। ঢাকা থেকে এলো সবে দুজন। রূদ্র আর শিহান। নিলয় ফোন করে জানালো, সে সবে রওনা করেছে। শুরু থেকে খুব লাফালাফি করলেও শেষ মুহূর্তে বেচারার প্ল্যান বানচাল হয়ে গেছে অফিসের কাজে। আগের দিনের ছুটি ক্যান্সেল হয়ে যাওয়ায়, নির্ধারিত সময়ে সে আসতে ব্যর্থ।
আমরা পাঁচজন। কিচ্ছুটি চিনি না কুমিল্লার। গ্রুপচ্যাটে অনিকের বলে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী অটো ভাড়া করে রওনা করলাম ময়নামতির দিকে। শহরে নবাগত হওয়ায় অটোওয়ালা বিশেষ সম্মান দেখিয়ে ভাড়া নিলো দ্বিগুণ।

শালবন বিহার
টিকিট কেটে শালবন বিহারে ঢুকে পড়লাম। প্রথমেই যেটা চোখে পড়লো, চমৎকারভাবে সাজানো ফুলের উদ্যান। চেনা অচেনা নানা ধরনের ফুলের গাছ। উবু হয়ে বসে হাত বাড়িয়ে পাতার আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া দোপাটি ফুল ছুঁয়ে দেখলাম। একটু এগুতেই দেখি, একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছে বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে। বিখ্যাত সেই কবিতা মনে পড়ে গেলো।
বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই …
বাউন্ডারি টাইপ উঁচু স্থাপনা ঘুরে বৌদ্ধ বিহারে প্রবেশ করলাম। ঘুরে ঘুরে দেখছি। সে আমলের গেটটা দেখে বললাম, এই গেটকে মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করলো, এতটা অক্ষত রয়েছে কী করে? ভাইয়া বললো, এটা মোটেও এভাবে মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করেনি। করলে এতটা অক্ষত আর নিখুঁত হতে পারতো না।
তবে? এটা নকল?
জানা নেই কারোর। চুপ মেরে গেল সবাই।

এই বৌদ্ধবিহারের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনার কাছে গেলাম। হালকা পায়ে পোড়ামাটির ফলকের উপর দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ পা হড়কালো। কী করে যে টাল সামলালাম, জানি না। পড়লে আর দেখতে হতো না!
উঁচু হওয়ায় ঝিরঝিরে হালকা বাতাস বইছিল। ওখানেই হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লো সবাই। শিহান বাড়ি থেকে হাতে বানানো নারকেলের নাড়ু নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে খেতে শুরু করলাম। বাচ্চাকালের চড়ুইভাতি চড়ুইভাতি ফ্লেভারটা তখন আরেকবার পেলাম।
এরপরের স্থাপনাটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে। আর পুরো জায়গাটার ঠিক মাঝখানে কিছু শ্রমিক কাজ করছে। ওদের দিকে তাকিয়ে সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, এটা ঠিক এভাবেই মাটির নিচ থেকে উদ্ধার হয়েছিল?’
রূদ্র খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটা পরীক্ষা করতে করতে বললো, ‘না। সে আমলে নিশ্চয়ই ইটের গায়ে ইংরেজি লেখা থাকতো না?’
হতভম্ব হয়ে ওর দেখানো ইটের সারির দিকে আঙুল তাক করলো।
‘তাহলে পুরোটাই পরে তৈরি করা?‘ হাহাকার কিছুতেই চেপে রাখতে পারছিলাম না। ‘এত বড় ফাঁকিবাজি!’
জাকির ভাইয়া হেসে ফেলল। বললো, ‘মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করার সময় ভেঙে গিয়েছিল না? ওটাকে ওভাবেই আবার পুনঃস্থাপন করেছে।’
পোড়ামাটির ফলকগুলো দেখিয়ে বলল, ‘এগুলো নকল না।

এখান থেকে পুরো জায়গাটাকে খুব ভালোমতো দেখা যায়।
একটা কুয়া দেখতে পেলাম। রেলিং দেওয়া। রেলিংয়ের বাইরে দেখে মনে হলো অনেক গভীর। সেই ভয়েই বুঝি রেলিং দেওয়া। জাকির ভাইয়া গভীরতার তোয়াক্কা না করে রেলিং টপকে ওপাশে গিয়ে কুয়া মুখে উঁকি দিল। এরপর হাসতে হাসতে বলল, ‘বাইরে থেকে দেখছিস, সেটাই ভালো। অন্তত এটা তো ভেবে নিতে পারছিস যে কুয়াটা অনেএএএএক গভীর!’
উফফফ! আরেকটা ধোঁকা!
আমি আর জাকির ভাইয়াকে বলিনি, ভিতর থেকে ছবি তুলতে। বাইরেরটাই দেখি নাহয়!
সাইনবোর্ডে বিহারের ইতিহাস লেখা আছে।
বিহার থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ শালবনে ঢুকে হাঁটাহাঁটি করলাম। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। ওখানকার একটা হোটেল টাইপ দোকানে ঢুকে পড়লাম। ধরেই নিয়েছি খাবার ভালো হবে না। হলোও তাই। সেই ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাত। কোনো রকমে কেবল সেদ্ধ করে রাখা ঝোল ঝোল মুরগী, গোশতবিহীন গরুর ঝোল দিয়ে খাওয়া সারলাম। তবে পুঁইশাক আর শুঁটকি ভর্তা খেয়ে খুব মজা পেয়েছি।
এবারের অটোওয়ালা আগেরজনের মতো নয়। বরং আমাদের খুব সাহায্য করলো। কোথায় কোথায় গেলে আরো কিছু বিহার দেখতে পাব, তা সাজেশন করলো। অটোর পেছনে বসায় জাকির ভাইয়ার সাথে অটোওয়ালার কী কী কথা হলো, ডিটেইলে শুনতে পাইনি। সে আমাদের রূপবান মুড়ায় যাবার রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে গেল।
রূপবান মুড়া
রাস্তাটাও চমৎকার! গাছের পাতায় ছায়া ঢাকা ঢালাই করা রাস্তায় হালকা শেওলা জন্মেছে। স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। দারুণ লাগছিল।

রূপবান মুড়ায় ঢুকতে কোনো টিকিট লাগলো না। জাকির ভাইয়া বললো, ‘এই জায়গাটা বিজিবির আন্ডারে। তাই এটাকে সবার জন্য উন্মুক্ত রেখেছে।’
এখানে এসে মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। গুটিকয়েক মানুষ ছিল। তারা চলে গেল তখনি। এখানকার প্রধান স্থাপত্যটা বেশ উঁচু। শালবন বিহারেরটার চেয়েও উঁচু। আমি সাবধানী পায়ে উঠতে লাগলাম উপরে। পা হড়কে পড়তে চাই না।
ওখান থেকে দারুণ সব ছবি তোলা গেল।
চমৎকার পরিবেশ। মেঘলা আকাশ। মন ভালো করা বাতাস বইছে। তাসনুর অনুরোধে এখানেই বসে গেল গানের আসর। আসর বলতে, একজনই গাইলো। আমরা সবাই শ্রোতা। চমৎকার পরিবেশে রবীন্দ্র সংগীতের আসরটা বেশ মানিয়ে গেল।
ইটাখোলা মুড়া
রূপবান মুড়া থেকে বেরিয়ে গেলাম, ইটাখোলা মুড়ায়। এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলাম না। সময় নেই। পটাপট কয়েকটা ছবি তুলেই ফিরে যাব। সাইনবোর্ড থেকে জানলাম, একটা আবক্ষ মূর্তি যথাস্থানে স্থাপন করা আছে। ওটাকে না দেখে কি যাওয়া যায়?
একদম উপরে ওটা। তাও আবার মাথা নেই। তার উপরে জালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া। জাকির ভাইয়া খুব রিস্ক নিয়ে জালির ভিতরে মোবাইল ঢুকিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করছিল। তাই দেখে রূদ্র ফোড়ন কাটল, ‘দেইখেন কিন্তু! পড়ে গেলে ওটা দেবতার জন্য দেওয়া ভেট হয়ে যাবে!’
এই জায়গাটা থেকে পুরো কুমিল্লা শহর দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মোবাইলের ক্যামেরায় ওটা ভালো করে বোঝা যায়নি।
লতিকোট মুড়া
আমরা ভেবেছিলাম এটায় তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। লতিকোট মুড়াতে ঢোকার ইচ্ছে ছিল না। বাইরে থেকে মনে হচ্ছিল, এটায় তেমন কিছুই নেই। একদম সমান কিছু দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে লতিকোটের ইতিহাস পড়ছিল একজন। হুট করে বললো, ‘”ভিক্ষু কক্ষ” কী? ভিক্ষুকদের কক্ষ?’
আমি বললাম, ‘আরে না! বৌদ্ধদের মধ্যে যারা ধার্মিক, তাদের ভিক্ষু বলে।’
ও বললো, ‘তাহলে ভিক্ষু কক্ষগুলো কই? মাটির নিচে চলে গেছে?’
আমি আনমনে বললাম, ‘মনে হয়।’
বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, দূর থেকে যেটাকে ইট দিয়ে বাউন্ডারি করা দেয়ালের মতো মনে হয়, সেটা আসলে মোটেও তা নয়। ওটার ভেতরে আসলেই সেকেলে অনেকগুলো ঘরের আদল আছে। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। এ কারণেই অন্য দুইটা মুড়া যেখানে লোকারণ্য, সেখানে লতিকোট মুড়ায় কাক-পক্ষীটাও নেই।

কিন্তু ওটার ভেতর ঢুকবো কেমন করে? প্রায় গলা সমান উঁচু দেয়াল তো দস্যি মেয়েরাও টপকাতে পারবে না। তাহলে?
গরমে, রোদে অস্থির হয়েও প্রায় পুরোটা ঘুরে অপর পাশে দিয়ে ঢোকার রাস্তা পেলাম। সবুজ ঘাসে ছোট ছোট ধবধবে সুন্দর কাশফুল ফুটে রয়েছে। চমৎকার লাগলো এখানটায়।
ইচ্ছে ছিল ওয়্যার সিমেট্রি আর বার্ডে ঘোরার। ওয়্যার সিমেট্রি ছিল বন্ধ। আর বার্ডে ঢুকতে দিল না। শহরে ফিরে এসে শুনি, নিলয় বেচারা দুই ঘণ্টা ধরে শহরে এসে অপেক্ষা করছে। জাকির ভাইয়াকে ফোনে বলেছিল, ও শহরে এসে পড়েছে, গ্যাঞ্জামের কারণে ভাইয়া শুনেছে, ও চরে এসেছে!
বেচারার জন্য কষ্টই লাগলো। ওর সাথে সবসময়ই এমন কিছু ঘটে।
এখান থেকে তাসনু চলে গেল। আর আমরা আবারো পঞ্চমানব কুমিল্লার খোলা হাওয়ার আখড়া ধর্মসাগর গিয়ে ঘুরে এলাম।

রসমালাই
কুমিল্লায় এসেছি, মাতৃভান্ডারের রসমালাই না খেলে কি চলে? আদী মাতৃভান্ডারের রসমালাই খুঁজতে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, যেসব দোকানে রসমালাই আছে, সেসবের কোনোটায় বসে খাবার ব্যবস্থা নেই! আশ্চর্য তো! আমরা কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাব নাকি!
তারপর অনেক খুঁজে-পেতে একটা দোকান পাওয়া গেল, যেটায় একটা টেবিল আছে। রসমালাই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ফিরে চললাম গন্তব্যে। তৃপ্তি ঢেকুর তুলেছি ঠিকই, আসল রসমালাই কিন্তু খাইনি। কারণ আমরা জানতামই না, কুমিল্লার আসল মাতৃভান্ডার হলো মনোহরপুরের। আসল মাতৃভান্ডারের রসমালাই খেতে চাইলে অবশ্যই মনোহরপুরে চলে যাবেন।

সতর্কতা
আমাদের ভ্রমণ স্থানগুলো পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। আসুন, ঘোরাঘুরির সাথে সাথে সুরুচির পরিচয় দিই।
কারণ, মন সুন্দর যার, সেই তো দেশ পরিষ্কার রাখে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার সায়দাবাদ থেকে প্রায় এক ঘণ্টা পর পর ছাড়ছে কুমিল্লার গাড়ি। নামতে হবে কোটবাড়ি চৌরাস্তায়। সেখান থেকে সিএনজি বা অটো যোগে যেতে পারবেন যেখানে খুশি। সি,এন,জি/অটো ভাড়া জনপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে।
কোথায় থাকবেন
কুমিল্লায় দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা যায়। তবুও থাকতে চাইলে শহরে কিছু হোটেল আছে, সেখানে থাকতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় বার্ডে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে। বার্ডের চমৎকার পরিবেশ আর খাবার আপনার রাত্রীযাপনকে করবে মোহনিয়া।
Feature Image : সজল