বাংলা সাহিত্যে ‘মধু কবি’ নামে পরিচিত মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি নামক গ্রামে, এক রাজ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রাজ নারায়ণ দত্ত এবং মাতা জাহ্নবী দেবী। তিনি একাধারে মহাকবি, প্রথম মৌলিক নাট্যকার, বাংলা ভাষার সনেট প্রবর্তক ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। এছাড়াও বলা যায়, তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত মেঘনাদবধ কাব্য রচনা করে উনিশ শতকের বাঙালির নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। আমি প্রথম যেদিন এই কবির রচিত কপোতাক্ষ নদ কবিতাটি পাঠ করেছিলাম, সেদিনই কল্পনায় নদীটির একটি ছবি এঁকেছিলাম। আর ঐ চিত্রটিই আমাকে বার বার জীবন্ত নদীটি দেখতে যাওয়ার তাগিদ দিতো। আমিও সময় করে প্রাণহীন চিত্রটিকে প্রাণ দানের অভিপ্রায়ে বেরিয়ে পড়লাম।

খুব ভোরে রওনা হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কারণ আমি জানি ভোরের পথে ক্লান্তি কম। কিন্তু পৃথিবীতে মানুষের ইচ্ছা মতো কয়টি কাজই বা হয়? সকালে এমন ঘুমে ধরল যে একবারে ১২ টা বাজিয়ে দিল। ঘড়িতে নয়, কপালে। মানে, ঘড়িতে বাজল ৮টা আর কপালের বাজল বারোটা। বাজবে না কেন?
কোথাও যাওয়ার আগের রাতে ঘুম মহাশয় কোথায় যেন পলায়ন করেন, আর ঠিক ভোর হওয়ার পূর্বে এক মহা শক্তি নিয়ে চুপিসারে আমার চোখে প্রবেশ করেন। কোনো সময় জ্ঞান নেই, অপদার্থ একটা! আসলে এটা আমারই অপর নাম। কারো সাথে সময় মিলিয়ে চলাটা আমার কখনোই হয়ে ওঠে না। কিন্তু তখন পারলাম। ৮.১৫ মিনিটের গাড়ি ধরার উদ্দেশ্যে ছিল, তাড়াহুড়া করে অবশেষে সফল হলাম। উঠে পড়লাম সাতক্ষীরা গামী গাড়িতে, গন্তব্য চুকনগর।
গাড়ি চলাকালীন বারবার মাইল ফলকের দিকে তাকাচ্ছিলাম, কখন যে রাস্তা শেষ হবে। আর যখন মনে পড়ছিল, আরও দুইটি গাড়ি পরিবর্তন করার পর সাগরদাঁড়ি পৌঁছব তখন কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম। আর বার বার সুপারভাইজারের কাছে জিজ্ঞাসা করছিলাম, এখান থেকে আর কতক্ষণ লাগবে? পুরো রাস্তাজুড়ে আমার চোখটা নিবদ্ধ ছিল ঘড়ি আর মাইল ফলকে।
তাই অন্য কোনো কিছু দেখার সুযোগ মেলেনি। তবে এই সুযোগটি মিলেছিল তিন গাড়ির শেষ গাড়িতে উঠে। অর্থাৎ চুকনগর থেকে আমি যখন কেশবপুরে পৌঁছলাম তখনই কেমন যেন কবিকে অনুভব করতে শুরু করলাম। উঠে পড়লাম হেলিকপ্টারে। চমকে গেলেন?
আসলে গ্রামের রাস্তা হওয়ায় এই রাস্তায় বাস চলে না। চলে শুধু ছোট গাড়িগুলো আর এদের মধ্যে সব থেকে তাড়াতাড়ি চলে মোটরসাইকেল। তাই স্থানীয় রসিক মানুষেরা একে হেলিকপ্টার নাম দিয়েছেন। হেলিকপ্টারে তথা মটর সাইকেলে চড়ে বিস্তৃত মাঠের ভেতর দিয়ে ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম কবির গ্রামের দিকে, যেখানে তিনি ছোটবেলা কাটিয়েছিলেন।
সবুজ শ্যামলে ঘেরা গ্রাম্য পথ বেয়ে পৌঁছে গেলাম একটি বাউন্ডারি ঘেরা শহুরে বাড়ির সামনে। বাড়িটি তার, যার টানে আমার এই ছুটে আসা। মনের মাঝে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। কবিকে সামনে পেলে যে অনুভূতি হতো এটা হয়তো তারই সংক্ষিপ্ত রুপ। গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।
কুটিরের আদলে তৈরি প্রধান ফটক পেরিয়ে প্রবেশ করলাম বাড়ির অভ্যন্তরে। এখানে চোখে পড়ে নানান প্রাচীন স্থাপনা যেমন, কবির বাড়ি এবং তার সামনে রয়েছে কবির অাবক্ষ মূর্তি। কবির বসতবাড়ি এখন জাদুঘর। ১৯৬৫ সালের ২৬ অক্টোবর সরকার বাড়িটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এবং এসময় এর নাম দেওয়া হয় ‘মধুপল্লী’।

মধুপল্লীর ভিতরে ঢুকে দেখতে লাগলাম কবির স্মৃতি বিজড়িত সব আসবাবপত্র, যা ছিল কবির নিত্য-কর্মের সাক্ষী। এখানে রয়েছে কবির আলমারি, টেবিল, খাট, সিন্দুক, থালা-বাসন, গ্রামোফোন ইত্যাদি। এছাড়াও একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখতে পেলাম কবির জন্মস্থান।
কবির সকল জিনিসপত্র দেখে মনে হচ্ছিল এই সবকিছুই যেন ধন্য হয়েছিল তার ছোঁয়ায়। আর হাজার হাজার বছর ধরে গর্ব করার জন্যই এখনো পড়ে আছে অবলীলায়।

বাড়ির পশ্চিম পাশেই রয়েছে একটি দীঘি। ঘাটে বসে কিছু মানুষকে গল্পে মেতে উঠতে দেখলাম। প্রসঙ্গটা অবশ্যই কবিকে ঘিরে ছিল, কিন্তু ওদিকে আমার আগ্রহ ছিল না। আমার দৃষ্টি দীঘির জলে; এই দীঘিতেই কবি স্নান করতেন। ঝুপ করে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছা হলো, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা শুধু ইচ্ছাই রয়ে গেল।

কবির বাড়ি থেকে কপোতাক্ষ নদ কিছুটা দূরে, তবে বেশি নয়। হেঁটে যাওয়ার মতো, এমনটাই শুনেছিলাম। বাস্তবেও তাই, হাঁটতে হাঁটতেই চলে গেলাম কপোতাক্ষের তীরে। নদীর তীরে রয়েছে কবির জীবনের সব থেকে মূল্যবান জায়গা, কবির পাঠাগার। এখানেই কবি পড়াশোনা করতেন। এই কপোতাক্ষের তীরে বসেই কবি রচনা করেছেন তার অমর কিছু বই।
নদের ঘাটে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এই ঘাটকে লোকে বলে সান বাঁধানো ঘাট। এখানে রয়েছে কবির স্মৃতি বিজড়িত কাঠবাদাম গাছ। যার ছায়ায় বসে কবি কাটিয়ে দিয়েছেন কত না প্রহর। কলকাতায় থাকাকালে কবি একবার তার মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে খ্রিস্টান স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে বাড়ি আসেন।
কিন্তু সে হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হওয়ায়, তার জ্ঞাতিরা তাকে বাড়িতে উঠতে দেয় না। হায় রে ধর্ম! মায়ের কাছ থেকে তার সন্তানকে দূরে ঠেলে দিল। তারপরও কবি হতাশ না হয়ে, এই কাঠ বাদাম গাছের নিচে তাঁবু খাটিয়ে ১৪ দিন অবস্থান করেন। তাতেও কোনো ফল না পেয়ে অবশেষে তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে কলকাতায় ফিরে যান। এর এটিই ছিল তার শেষ যাত্রা, এরপর তিনি আর কখনো দেশে ফেরেননি।

কবির স্মৃতি জড়ানো এই ঘাটে আমি প্রায় ২-৩ ঘণ্টা অবস্থান করলাম। কপোতাক্ষ নদ আজ আর আগের মতো নেই। সে মৃত, পড়ে আছে শুধু তার দেহ; প্রাণ নেই। এখানে আগের মতো আর ঢেউয়েরা মেতে ওঠে না। আজ আর সে কলকল ধ্বনি তোলে না, তুলবে কী করে? তাকে ভালোবেসে যে আর কেউ কবিতা লেখে না। যা লেখে তা হলো, হা-হুতাশে ভরা ভ্রমণ কাহিনী। আজ সে বেঁচে আছে শুধু কবিতায়; কবির কবিতায়। আমি মনে মনে আবৃত্তি করতে লাগলাম,
সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
-মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে প্রথমে যশোর যেতে হবে। তারপর ওখানকার মূল বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে যেতে হবে কেশবপুর, তারপর সেখান থেকে মটর সাইকেল বা ভ্যানে করে সোজা যেতে পারবেন সাগরদাঁড়ি, কবির বাড়ির সামনে।
অথবা অন্যভাবে যেতে চাইলে প্রথমে খুলনা আসতে হবে এবং সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে উঠতে হবে সাতক্ষিরার বাসে; নামবেন চুকনগর আবার সেখান থেকে বাসে করে কেশবপুর যেতে হবে। আর কেশবপুর থেকে আগের প্রক্রিয়ায় যেতে পারবেন কবির বাড়ী।
কোথায় থাকবেন
সাগরদাঁড়িতেই বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের একটি মোটেল আছে। ভাড়া ৬শ’ থেকে ১২শ’ টাকা পড়বে। এছাড়াও আপনি চাইলে খুলনা বা যশোর শহর থেকেও আসতে পারবেন।
ফিচার ইমেজ- উইকিমিডিয়া কমন্স