ঢাকার দক্ষিণে পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর মাঝখানে অবস্থিত প্রায় ১৩৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি অবভূমি আড়িয়াল বিল। বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্রে যেমন সেজে থাকে নানা রূপে, তেমনি সে রূপ বদলের পালায় বৈচিত্র দেখা যায় আড়িয়াল বিলেও।
একেক ঋতুকে একেক চিত্রের দেখা মেলে এ জায়গাটিতে। কখনো জলে টইটুম্বুর চারপাশ, তো কখনোবা শুকনো মাঠ। মাঠ জুড়ে নানা রকম ফসল, সবুজে ভরে থাকা। কোন দৃশ্যটাই বা মন্দ লাগবে আপনার! শহুরে পরিবেশে থেকে থেকে যারা ক্লান্ত, যারা খানিকটা অবসর পেলেই হারিয়ে যেতে চান প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে তাদের জন্য ঢাকার অদূরেই এই জায়গাটি অসাধারণ এক ভূমিকা পালন করবে।
ঢাকা থেকে এ জায়গাটির দূরত্ব খুব বেশি নয়। ঘণ্টা দেড়েকেই পৌঁছে যাওয়া যায়। এ জায়গায় শহরের যান্ত্রিকতার ছোঁয়া নেই, যানজট আর কোলাহল নেই। এখানকার পথে চলতে চলতে দেখা পাবেন চোখ জুড়ানো সবুজের, শুনতে পাবেন নানা রকম পাখির কিচিরমিচির ডাক।

গ্রামীণ পরিবেশ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের এমনিতেই খুব আকৃষ্ট করে থাকে। আমরা গাছপালা ঘেরা স্নিগ্ধ যেকোনো পরিবেশে অনেকটা স্বস্তি খুঁজে পাই। আর তাছাড়া অন্যান্য সৌন্দর্যের পাশাপাশি আড়িয়াল বিলের আলাদা এক সৌন্দর্য তো থাকছেই।
আড়িয়াল বিল মুন্সিগঞ্জে অবস্থিত। এর আয়তন ১৩৬ বর্গ কিলোমিটার। জায়গাটি জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক অসাধারণ সৌন্দর্য। শীতকালে শুকনো থাকে এর চারপাশ, শুরু হয় ফসলের চাষ। নানা রকম সবজি চাষ করে থাকেন সেখানকার স্থানীয় কৃষকরা। সেসময় চারপাশ জুড়ে চোখে পড়বে অনন্য এক দৃশ্য।

এখানকার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই দেখা যায় মিষ্টি কুমড়ার চাষ। এ জায়গাটিতে মিষ্টি কুমড়ার ফলন বেশ ভালো হয়। কৃষকেরা মেতে থাকেন পুরো শীত জুড়ে সবজি চাষে। শীতের শেষে মিষ্টি কুমড়া পাকলে দেখা যায় ভিন্ন আরেক চিত্র। সবুজ পাতার ফাঁকফোকর হতে ঝুলে থাকা কমলা রংয়ের ছোট বড় মিষ্টি কুমড়াগুলো দেখতে ভীষণ ভালো লাগে।
কোনো কোনো মিষ্টি কুমড়া অনেক বেশিই বড় হয়ে থাকে, দেখা যায় ওজনে দুই মনেরও বেশি। আপনাদের অনেকের কাছেই বিষয়টি অবাক লাগতে পারে। এ দৃশ্যটিও চাইলে গিয়ে কাছ থেকে দেখে আসতে পারেন আড়িয়াল বিলে।

শীত জুড়ে বিশাল মাঠ, সবজি খেত। আবার বর্ষাকালে এই জায়গাগুলোই পানিতে তলিয়ে যায়। তখন পুরো অংশের যেদিকেই চোখ রাখবেন, দেখতে পাবেন মাটির উপর সবুজ জলের গাঢ় প্রলেপ। বর্ষাতেই মূলত আড়িয়াল বিলের আসল সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়।
সবুজাভ জলে ভরা আড়িয়াল বিলের উপর তখন নৌকা নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন স্থানীয় মাঝিরা। শীতকাল জুড়ে যেমন কৃষকদের হাসির কারণ ও আয়ের উৎস হয়ে থাকে আড়িয়াল বিল, তেমনি বর্ষায় সুযোগ করে দেয় মাঝি ও জেলেদের।
আড়িয়াল বিলে নানা রকম মাছ পাওয়া যায় তখন। স্থানীয় জেলেরা ছোট বড় নৌকা নিয়ে মাছ ধরেন। তাদের বিশেষ পদ্ধতিতে আড়িয়াল বিলের বুকে মাছ ধরার দৃশ্যটিও দেখতে পারেন। তাছাড়া এই মাছের জন্যই সেসময় আড়িয়াল বিলের বুকে বেড়ে যায় পাখিদের আনাগোনা।

তবে শুধু বর্ষা বা মাছই কারণ নয় এ স্থানে এত সংখ্যক পাখিদের আনাগোনার। প্রায় সারা বছর ধরেই আড়িয়াল বিলের আশপাশের বিশাল অংশ জুড়ে, গাছপালায় এসব পাখিদের দেখা পাওয়া যায়। পাখিরা এ জায়গাটিতে স্বাচ্ছন্দ্যে উড়ে বেড়ায় ও মিষ্টি সুরে ডাকে।
বর্ষায় ঘাট তৈরি হয় আড়িয়াল বিলে। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে ঘুরতে পারবেন পুরো আড়িয়াল বিলের বুকে। জলের উপর ভেসে উপভোগ করতে পারবেন এ বিলের প্রকৃত সৌন্দর্য। জায়গাটি বর্তমানে ভ্রমণ প্রিয়দের জন্য একটি আকর্ষণ।

বিশেষ করে বর্ষাকালে এ জায়গাটিতে পর্যটকদের ভিড় বেড়ে যায়। মাঝিরা বেশ ভালোই আয় করে থাকেন এ সূত্রে। ঢাকার বেশ কাছে হওয়ায় আপনি খুব অল্প সময়েই জায়গাটি ভ্রমণ করে ঢাকায় ফিরে আসতে পারবেন। তাই সাপ্তাহিক ছুটিটাকে কাজে লাগিয়ে ঘুরে আসতে পারেন আড়িয়াল বিল। খরচটাও বেশ কম।
আড়িয়াল বিল থেকে ফেরার পথে ঘুরে দেখে আসতে পারেন শ্যামসিদ্ধির মঠ। শ্রীনগর বাজারের পশ্চিম দিকে শ্যামসিদ্ধি গ্রামে অবস্থিত এই মঠটি। প্রাচীন এ মঠের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথের উপরে বাংলা শিলালিপি অনুযায়ী ধারণা করা হয়, ১৮৩৬ সালে বিক্রমপুরের জনৈক ধনাঢ্য ব্যক্তি শম্ভুনাথ মজুমদার এই মঠটি নির্মাণ করেন। প্রায় ২৪১ ফুট উঁচু এ মঠ দিল্লির কুতুব মিনারের চেয়েও পাঁচ ফুট উঁচু। তাই বলা যেতেই পারে, এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বোচ্চ মঠ।

অষ্টভুজ আকৃতির এ মঠ দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে ২১ ফুট। চুন-সুরকি দিয়ে তৈরি মঠের দেয়াল বেশ পুরু। মঠের উপরের দিকে বাইরের দেয়াল জুড়ে রয়েছে শত শত খোড়ল। এগুলোতে বাসা বেঁধেছে শত শত সবুজ টিয়া, ঝুটি শালিক। তাই মঠটি সবসময়ই পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে।
ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন আড়িয়াল বিল
ঢাকার গুলিস্তান থেকে মাওয়াগামী যেকোনো বাসে চড়ে নামতে হবে শ্রীনগরের ভেজবাজার। ভাড়া ৭০ টাকা। শ্রীনগরের ভেজবাজার থেকে ব্যাটারি চালিত রিকশা নিয়ে সোজা যেতে হবে গাদিঘাট। ভাড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। গাদিঘাট থেকে ট্রলার কিংবা নৌকা ভাড়া করে ঘুরে আসুন আড়িয়াল বিল। নৌকা বা ট্রলারের ভাড়া নির্ভর করে সময়ের উপর। ৩০০ থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যে ভালোভাবেই ঘুরে দেখতে পারবেন বিলটি।
তাছাড়া, ঢাকার গুলিস্তান থেকে মাওয়াগামী যেকোনো বাসে চড়ে নামতে পারেন ষোলঘর বাস স্ট্যান্ড। ভাড়া ৬৫ টাকা। ষোলঘর বাস স্ট্যান্ড নেমে, রাস্তা পার হয়ে ঢুকবেন ষোলঘর বাজারে। ষোলঘর বাজার থেকে নৌকা ভাড়া করে ঘুরে দেখতে পারবেন আড়িয়াল বিল। ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। মাঝিকে বলে রাখতে হবে কালিবাড়ি দিয়ে আড়িয়াল বিল যাবেন।
Very good