অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল, এমন একটা ভ্রমণ হবে, যেখানে ছোটাছুটি করে, অল্প সময়ে অনেক দেখার পরিবর্তে, ধীরে ধীরে অনেক সময় নিয়ে অল্প দেখা আর বেশী উপভোগ করার প্রয়াস থাকবে। প্রায় প্রতিবার ভ্রমণের শেষেই পরবর্তী ভ্রমণটা উপরের মতো করে করবো বলে মনস্থির করি। কিন্তু তা আর করা হয়ে ওঠে না!
প্রতিবারই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে বিরামহীন ভ্রমণ ও দর্শনের অস্থির আকুলতা। কিন্তু এবার আর তা হয়নি। সেই সুযোগই যে ছিল না, ছুটে ছুটে এদিক-ওদিক যাবার। “নিঝুম দ্বীপ” আমাদের দিয়েছিল সেই পূর্ণতা। শুধুই বসে থাকার আর দু’চোখ ভরে উপভোগের সেই অধরা বিলাসিতা।

ঢাকা থেকে হাতিয়া ১৫ ঘণ্টার বিলাস বহুল লঞ্চ ভ্রমণের পর নিঝুম দ্বীপ পৌঁছে যতক্ষণ থাকবেন উপভোগ করুন ব্যস্ততাহীন প্রকৃতির বিশাল ব্যঞ্জনা। (মাঝের কিছু চড়াই-উৎরাই ছাড়া!) আবার ফিরে আশার সময় সেই ১৫ ঘণ্টার নির্মোহ নীরবতা।
যেখানে পাশে ও সাথে থাকবে- সীমাহীন জলরাশি… উড়ে যাওয়া গাংচিল… চির সবুজ গ্রামের যাপিত জীবন… জেলেদের জলের আবাস… গোধূলির রঙিন আলো… আঁধার রাতের নীরবতা… নিজেকে, নিজের প্রশ্ন করার অবারিত অবসর… আর ব্যস্ত জীবনের কিছু খণ্ডিতক্ষণ। সাথে মনের মাঝে জমে যাওয়া কিছু গল্প।
চলুন এর পরের পর্বগুলোতে আপনাদের পুরো নিঝুমদ্বীপ ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো।

বেশ কিছুদিন থেকেই পরিকল্পনা চলছিল এবার নিঝুম দ্বীপ যাবো। অনেক দিন টিমের সকল সদস্য মিলে কোথাও যাওয়া হয় না। সবাই গিয়েছি কোথাও না কোথাও, কিন্তু একসাথে সেই প্রায় দেড় বছর আগে। সেই আক্ষেপ ঘুচিয়ে আবার শুরু করতে স্বপ্নিল স্বপ্ন দেখার। তো এবার সবাই বেশ অস্থির ও রোমাঞ্চিত। যতটা না কোথাও যাবার জন্য তার চেয়েও বেশি সবাই মিলে কয়েকটি দিন একেবারেই নিজেদের মতো করে লাগামহীন লক্ষ্যে কিছু অমলিন সময় কাটাবো। তো ঠিক হলো আসছে তিন দিনের ছুটিতে নিঝুম দ্বীপ যাব। বেশ সেভাবেই প্রস্তুতি শুরু। মাঝে ছোট-খাট বাঁধা তো ছিলই! যেটা আমাদের জন্য অবারিত আর লঙ্ঘনহীন নিয়ম।
যাত্রা শুরুর ঠিক আগের রাতে এক সহযাত্রীর আত্মীয়ের একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটল। মেসেজ দিলেন তিনি যেতে পারবেন না! খানিক হতাশ সবাই, কিন্তু হাল ছেড়ে দিলাম না। অফিস থেকে তিনটায় বের হব এমনই ঠিক করলাম। সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে যাবে ঠিক ৫:৩০ এ। দুই জন আরও আগেই চলে গেছে। বাকি তিন। একজন বাসায় গেছে, তার প্রয়োজনীয় কাজ সারতে।
একজন এখনো বসকে বলতে পারেননি একটু আগে বের হবার কথা। সময় তখন ২:৩০ মিনিট। এই কাজ, সেই কাজ, অযথা কাজ শেষ করতে প্রায় ৩:১৫ বেজে গেল! অবশেষে শত অনিচ্ছা আর প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে, সেই দুর্ঘটনা কবলিত জনও আমাদের সাথে! নিঝুম দ্বীপ আর একত্রে কিছু প্রহর কাটানোর নেশায়।

অফিস থেকে বের হতে-হতে ৩:৩০। লঞ্চ ৫:৩০ এ! সময় দুই ঘণ্টা। সাথে তিন দিনের ছুটির সকলের সার্বিক ব্যস্ততা। তিন জন এক হতে-হতে আরও ২০ মিনিট! সময় ৩:৫০। রাস্তায় এতটুকু ফাঁকা নেই! বাসে ওঠার মতো পরিস্থিতি নেই! একটিও সিএনজি ফাঁকা নেই! কী করার আছে? শুরু হলো হাঁটা আর পিছন ফিরে বাস বা সিএনজির জন্য আকুতি নিয়ে তাকিয়ে থাকা! নেই, কিচ্ছু নেই! ঘেমে-নেয়ে একাকার রামপুরা বাজার যেতে-যেতেই।
এলো এক বহুল অারাধ্য ভিক্টর পরিবহন। উঠে পড়লাম ওতেই ঠেলেঠুলে। গন্তব্য সদরঘাট। বেশ আছি ব্যাগ পিঠে নিয়ে, অন্য যাত্রীদের গালি শুনে! “ওই মিয়া, ব্যাগ হাতে লন”, “ভাই ব্যাগটা নামান, আপনার ব্যাগের লাইগা আমার একজন যাত্রী কম যাইতাছে”– সুপারভাইজারের মন্তব্য!

সাথে সিগারেটের ধোঁয়া, ধুলোর সাগর! দাঁত না মাজা মুখের বিকট গন্ধ। ঘামে ভেজা শরীরের ঘেঁষাঘেঁষি! সিটের কোণা থেকে বের হওয়া টিনের খামচিতে গেঞ্জি ছিড়ে মাংসপেশী থেকে রক্তের ছিটে! দমবন্ধ অবস্থার সাথে যোগ হলো জ্যাম, মালিবাগ পেরুবার আগেই! অপেক্ষা ১০ মিনিটের। সময় ৪:২০ মিনিট! যেতে হবে আরও বহুদূর! প্রয়োজনের সময়ই কেন জ্যাম নিরন্তর? আর কেনই বা আমার বা আমাদের সাথেই? বিধাতার কাছে বিবেকের আর্তনাদ!
অনেক জ্যাম, কখন ছাড়বে ঠিক নেই। তবে কি নেঁমে হাটা শুরু করবো? যেই ভাবা, সেই কাজ, নেমে পড়লাম। কিন্তু হায়, বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। নামা মাত্রই ছেড়ে দিল বাস! মুহূর্তেই রাস্তা ফাঁকা, নিমেষেই চলে গেল চোখের পলকে বহুদূর! সংক্ষিপ্ততম সহায় এক সিএনজি। গন্তব্য গুলিস্থান পর্যন্ত। কোনোমতে ঠেলে-ঠুলে জিপিওর মোড় এলাম। এদিকে একের পর এক ফোন, “কোথায় তোমরা, কত দূরে?”

আবার জ্যাম! ১৫ মিনিট একই জায়গায়। সময় ৫:০৫, মাত্র পঁচিশ মিনিটে সদরঘাট পৌঁছানো অসম্ভব।
অসম্ভব কে, সম্ভব করাই অ্যাডভেঞ্চারিস্টদের কাজ! (সাথে যদি সহায় থাকেন বিধাতা, সাধ্য কার ঠেকাবে?) শুরু হলো হাঁটা-দৌড়-ধাক্কা-লাফ-ঝাঁপ এই শহরের ইট-পাথর আর ইস্পাতের কঠোরতা উপেক্ষা করে। আমাদের টিমের সবচেয়ে বিলাসী আর শান্ত-শিষ্ট জনও এই পথে আমাদের মতোই ঝঞ্ঝা মাড়িয়ে বাঁধা ভেঙে, এক কাপড়ে উন্মাদের মতো উত্তপ্ত, উল্লাসের নেশায়, নিঝুম দ্বীপের নিরবতার নেশায় মত্ত হয়ে গেল।
কোনোক্রমে ইংলিশ রোড, ৫:২০! বাকি মাত্র ১০ মিনিট। এবার দৌড় যে-যার মতো, উদ্দেশ্য একজনও যদি গিয়ে পৌঁছাতে পারি তো লঞ্চের লোকদের বলে কিছু সময় যদি অপেক্ষা করানো যায়। এবার শুরু ভোঁ দৌড়! একে ওকে ঠেলে, ধাক্কা দিয়ে, সিএনজির রডে পা দিয়ে, রিক্সার চাকায় ঠেস দিয়ে, কারের বনেটে হাত রেখে লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে, ভেঙে-চুরে ৫:৩৫ এ সদরঘাটে পৌঁছলাম।

আহ স্বস্তি! লঞ্চে একটা বড়-সড় বস্তু উঠছে, যে কারণে কিছুটা কালক্ষেপণ হচ্ছে। আসলে এ বোধহয় আমাদের অ্যাডভেঞ্চার আর নির্ভেজাল আনন্দের সাথে আলিঙ্গনবদ্ধ হতে সময় আর সৃষ্টিকর্তার সহমর্মিতা। থেমে গেলেই অসম্ভব ছিল। থেমে যাইনি তাই সার্থক হয়েছি। সুতরাং থেমে থাকা যাবে না কিছুতেই, কখনওই, যত বাধাই আসুক না কেন।
এগিয়ে যেতেই হবে., সব বাধা ডিঙিয়ে!