দক্ষিণ ফ্রান্সের নিস শহরে এসে ট্রেন থেকে নামলাম আমরা। এই ট্রিপের বাকি তিন দিন এই শহরেই থাকবো আমরা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখন। আমাদের ছোট এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে ফরাসী বস ক্রিশ্চিয়ান পোর্টাল। অনলাইনেই গাড়ী ভাড়া করে রেখেছিল সে। রেলস্টেশনে রেন্ট এ কারের কাউন্টারে বলতেই চাবিসহ একটি খাম দিয়ে দিলো ক্রিশিয়ানের হাতে। তার আগে অবশ্য তার পাসপোর্ট দেখে নিশ্চিত হলো সঠিক ব্যক্তিকেই দিচ্ছে গাড়ীটা।
ভাড়া করা গাড়ীটা একটি পুজোহ ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ী। আগামী তিনদিন আমাদের সাথে থাকবে। যাওয়ার দিন এয়ারপোর্টে রেখে গেলেই হবে। এখানকার গাড়ী ভাড়া করার এটাই নিয়ম। আমাদের জন্য একটু চমকপ্রদ ব্যাপারই বটে। ক্রিশ্চিয়ান ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো, গুগল ম্যাপ দেখে সুন্দর করে পৌঁছে গেল আমাদের হোটেলে। নিসের সমুদ্র সৈকতের পাশেই আমাদের হোটেল। সামনে একটি রাস্তা আর বেশ বড়সড় সৈকতে হাঁটার জন্য ফুটপাতের পরেই ভূমধ্যসাগর।

হোটেল রুমে চেক ইন করে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। এত সুন্দর সাজানো গোছানো রুম, ইনটেরিয়র খুব বেশি সুন্দর। এই ট্রিপে ইতোমধ্যে প্রতিরাত ২৫,০০০ টাকায় নভোটেল প্যারিসে থাকা হয়ে গেছে। কিন্তু আমার কাছে নভোটেলের চেয়ে ১০,০০০ টাকার এই হোটেলের রুম অনেক বেশি ভালো লাগছে। পরের দিন সকালে ঘুম ভেঙে দেখলাম চমৎকার রোদ উঠেছে। ইউরোপে এখন গ্রীষ্মকাল, তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে।
সকালে হোটেলের সামনের বারান্দায় ব্রেকফাস্ট শেষ করে বীচের দিকে হাঁটতে গেলাম। সামনেই নীল ভূমধ্যসাগর। রাস্তার প্রায় সমান সমানই একটি ফুটপাত নির্মাণ করা হয়েছে এখানে। অনেকগুলো সাদা বেঞ্চ রাখা আছে। আমি এই ফুটপাতে হাঁটতে গিয়ে অস্বস্তিতে ভুগতে শুরু করলাম। আমার কাছে মনে হচ্ছে এ রাস্তা আমার অনেক চেনা। কী বিপদ! অথচ আমি এবারই প্রথম ইউরোপে পা দিলাম।

যতই হাটছি ততই অস্বস্তি বাড়ছে। কিছুক্ষণ পর অবশ্য সব ভুলে গেলাম। সমুদ্র সৈকতে আসা পর্যটকদের দেখছিলাম। অনেকেই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। এখানে ভাড়ায় সাইকেল পাওয়া যায়। অ্যাপ নির্ভর সেই সাইকেল ব্যবহারের নিয়ম জানি না বলে ভাড়া নিতে পারলাম না। মনের দু:খে সৈকতের দিকে রওনা দিলাম। গ্রীষ্মকালেই সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে এ শহরে। তাই সৈকতে সকাল বেলায়ই অনেক পর্যটক দেখা যাচ্ছে।
আমরা তিনজন সৈকতে এসে বসলাম। পানির এ ধরনের নীল রং আমি আগে কখনো দেখিনি। আমাদের সমুদ্রগুলোর রং নীলের মধ্যে একটু সবুজ ভাব থাকে, এখানকার পানি একেবারেই নীল। আর সৈকতে বালি নেই বললেই চললে। আছে এক ধরনের নুড়ি পাথর। পানি দেখে নামার জন্য আর তর সইছিল না আমাদের। কিন্তু পানি স্পর্শ করেই সেই ইচ্ছে সাথে সাথে উবে গেল। এত ঠাণ্ডা হয় পানি! আমি আর কিছুতেই নামতে রাজি হলাম না, দেখাদেখি বাকিরাও নামার পরিকল্পনা বাদ দিল।

শুধু সমুদ্র সৈকত না, পুরো নিস খুব সুন্দর সাজানো গোছানো পর্যটন শহর। রুমে ফিরে এসে সবাই মিলে রওনা দিলাম ক্যাফোর উদ্দেশ্যে। ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় চেইন শপ ক্যাফো (বানান পড়লে মনে হয় ক্যারেফোর লিখেছে)। রওনা দিতে গিয়ে আবার সেই অস্বস্তি। গত রাতে অন্ধকারে ভালোমতো অলিগলি বুঝতে পারিনি। কিন্তু দিনের বেলায় সেসব অলিগলি দেখে মনে হচ্ছে এগুলো আমার কত চেনা।
বিশেষ করে একটা বিল্ডিং দেখে মনে হলো এ বিল্ডিংটা আমি কোথাও দেখেছি। কী মুশকিলে পড়লাম! শপিং লিস্ট বের করে সেটাতে মনোযোগ দিলাম। চেইনশপ দেখে অবাক হতেই হলো। এতবড়, প্রায় সব কিছুই আছে। জানতে পারলাম ওয়ালমার্টের পর ক্যাফোই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম চেইন শপ। আমরা সবাই নিজেদের কেনাকাটা শেষ করে নিলাম। পরে আর সুযোগ পাই কি না পাই।

নিসের একদিকে বিখ্যাত কান শহর আর অন্যদিকে মোনাকো। তিনদিনে আমরা এগুলো ঘুরে দেশে ফিরে আসলাম। দেশে আসার কয়েক সপ্তাহ পরের ঘটনা। আমি টিভি খুলে দেখলাম আমার প্রিয় মুভি “ট্রান্সপোর্টার-১” দেখাচ্ছে। জেসন স্টেটহাম অভিনীত এই মুভিটা আমি কতবার দেখেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মাত্র শুরু হয়েছে ছবি, অলস সপ্তাহান্তে তাই আবার দেখতে বসলাম।

প্রথম দৃশ্য দেখেই চমকে উঠলাম, এই সেই বিল্ডিং। নিসে এই বিল্ডিংটায় আমার অনেক পরিচিত মনে হচ্ছিল। মজার ব্যপার হলো এই বিল্ডিং কিন্তু কোনো ব্যাংক নয়, এটি আসলে নিসের চেম্বার অব কমার্স। ছবির নায়ক ফ্রাংক যখন গাড়ি নিয়ে রওনা দিলো আর পুলিশ পেছন থেকে ধাওয়া করতে থাকলো গাড়ী উঠে আসলো সৈকতের পাশের ফুটপাথে। সাদা বেঞ্চিগুলো চিনতে এবার একটুও দেরি হলো না।
রহস্যের সমাধান হওয়ার কারণে ভালোও লাগছিল, আবার নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজের উপরেই একটু করুণাও হচ্ছিল। ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখলাম মোট ১২টি লোকেশনে এই ছবির শ্যুটিং হয়েছিল। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি আমরা এই ট্রিপে দেখেছি। সৈকত আর চেম্বার বিল্ডিংয়ের কথা তো বললামই, ট্রেনে করে আসার সময় মার্সেই বন্দরও দেখেছিলাম। সেখানে কন্টেইনার নিয়ে দৃশ্যগুলোর শ্যুটিং হয়েছিল ফ্রান্সের বন্দর শহর মার্সেইতে।

খুব আফসোস হচ্ছিল আগে থেকে নিস সম্পর্কে পড়াশোনা করে কেন গেলাম না, তাহলে অন্তত কয়েকটা জায়গায় ছবি তুলতে ভুলতাম না। আমি নিসে গিয়েছিলাম ২০১০ সালে। আর ট্রান্সপোর্টার ছবির শ্যুটিং হয়েছিল ২০০২ সালে, অর্থাৎ প্রায় আট বছর আগে। তারও অনেক বছর পর নিস আবার বিশ্ববাসীর আলোচনার শিরোনাম হয়।
তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন দু:খজনক একটি কারণে। ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দিবসে উৎসব মুখর জনতার উপর দিয়ে ৩২ টন ওজনি ট্রাক চালিয়ে ইউরোপের ইতিহাসে জঘন্যতম জঙ্গী হামলা চালানো হয়। এতে নিহত হয় ৮৪ জন মানুষ, আহত হয় আরও ২০২ জন। সুন্দর এই শহরটিতে নিরপরাধ মানুষের উপর এই হামলা আমাকে এখনও ব্যথিত করে।
ফিচার ইমেজ: লেখক