মুশৌরি থেকে বাস ঠিক ২০ মিনিট পরে যে পথে এসেছিলাম সেই পথে চলতে শুরু করলো। বাসে উঠে দেখি আমার সিট অন্য একজন দখল করে বসে আছেন। সে কথা জানালে সে সরে বসে আমাকে আমার সিটে বসতে দিলেন। কিছুক্ষণ পরে পাশের যাত্রীর সাথে টুকটাক আলাপ হতে লাগলো। প্রথমে যার যার পরিচিতি, তারপর কে কোথা থেকে আর কী জন্য এদিকে এসেছে সেসব। তিনি দিল্লী থেকে এসেছেন উত্তরখণ্ডের বিভিন্ন দর্শনীয় তীর্থস্থান দর্শন করতে। এবং আমার মতোই একা বা সোলো। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি আর তার চেয়েও অনেক দূরের উত্তরকাশী হয়ে গাঙ্গোত্রী আর তারপর গোমুখ যাবো শুনে বেশ অবাক হলো। যে একা একা অত দূর থেকে গোমুখ দেখতে যাচ্ছি।
তিন দিনের যাত্রা পথে তিনিই ছিলেন আমার ভ্রমণ পথে প্রথম কিছু কথা বলা বা একটু শেয়ার করার মতো কেউ। বেশ ভালোই লাগছিল তার সাথে আলাপ হয়ে। পথে যেতে যেতে তার ব্লুটুথ স্পীকার দিয়ে কিছু গান শোনা হলো। নানা রকম কথা হলো। পাহাড়ি পথে চলতে চলতে ৩০ বা ৪০ মিনিট পরে একটা পাহাড়ের মোড়ে বাস থেমে গেলে হেল্পার আমাকে জানালো আমার নামার জায়গা চলে এসেছে। এখান থেকে উত্তরকাশী যাবার বাস পেলেও পেতে পারি। ঝটপট পাশের যাত্রীকে বাই বলে আর একে অন্যকে শুভ কামনা জানিয়ে নেমে গেলাম।

উত্তরকাশীর পথে… ছবিঃ লেখক
বাস থেকে নেমে সামনের চায়ের দোকান বা হোটেলে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে আজকের উত্তরকাশী যাবার বাস এখনো যায়নি, তবে অল্প সময়ের মধ্যেই চলে আসবে। মুশৌরি পৌঁছেই বেশ ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ায় প্রিয় জ্যাকেটটা গায়ে চাপিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে খুব একটা ঠাণ্ডা কমছিল না, কারণ পায়ে শুধু স্যান্ডেল পরেছিলাম। শীতের দেশে বা শীতের সময়ে গায়ে যতই গরম কাপড় থাকুক না কেন, পায়ে আর কানে যদি যথাযথ গরমের ব্যবস্থা না থাকে তবে ঠাণ্ডাটা জেঁকে ধরেই। তাই ভাবলাম, জ্যাকেটের সাথে এবার তবে প্রিয় উডল্যান্ডটাও বের করে পরে ফেলি। তারপর এখানে একটু চা-টা খেয়ে বসে বাসের জন্য অপেক্ষা করা যাবে।
এই ভেবে ব্যাগ থেকে সবে মাত্র বুট খুলে বের করবো, তক্ষুনি পিছনে একটি বাস এসে আমি যে মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম বাস থেকে নেমে তার উল্টো পাশের বায়ের মোড়ে এসে দাঁড়ালো। যে চায়ের দোকানে উত্তরকাশীর বাসের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম তিনি জানালেন এটাই উত্তরকাশী যাবে। আর সেই বাসগুলোও মানে, ভারতের যে কোনো রাজ্যের স্টেট বাসগুলো যত দূরত্বের পথেই যাক না কেন, কোথাও এতটুকু অযথা দেরি করে না। লোক থাকলে নামিয়ে দেয় আর ওঠার থাকলে উঠিয়ে নিয়েই চলতে শুরু করে। অযথা কোথাও কারো জন্য দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার মতো সময় ওদের নেই।

সবুজে ছাওয়া পথে পথে। ছবিঃ লেখক
যে কারণে বাসটা একজনকে নামিয়ে দিয়েই চলতে শুরু করতেই আমার দৌড় দেখে একটু থামিয়ে তুলে নিল। কিন্তু হায়! বাসে তো বসার জায়গা নেই। সব সিটই ভরে গেছে আগের গন্তব্যগুলো থেকে এবং প্রত্যেকেই যাবে অনেক অনেক দূরের পথে উত্তরকাশী বা তার একটু আগে পরে। অবশেষে ভাগ্য অল্প সুপ্রসন্ন বলে বাসের ড্রাইভারের ঠিক পেছনের দিকে কোনো রকমে পা রেখে বসা যায় এমন একটা জায়গা পেয়ে গেলাম। যাক বাবা দাঁড়িয়ে যাবার চেয়ে তো ঢের ভালো। যেখান থেকে উঠেছিলাম সেই জায়গাটার নাম কৌশালি বা এমন কিছু একটা। মাত্র এক ঝলক দেখে বেশ আনকমন নাম যতটা মনে রাখা যায়। এখান থেকে উত্তরকাশীর দূরত্ব ঠিক ১০০ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগবে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। এমনটাই জানালো বাসের হেল্পার। ভাড়া নিল ১৭০ রুপী।
তবুও আমি খুশি যে আজকেই অন্তত উত্তরকাশী যেতে পারছি বা পারবো। উত্তরকাশী থেকে গাঙ্গোত্রীর দূরত্ব আরও ১০০ কিলোমিটার। তাই ভালো লাগছিল আগে তো উত্তরকাশী যাই তারপর সেখান থেকে গাঙ্গত্রি যাবার কিছু না কিছু ঠিক পেয়ে যাবো বলে মনে হলো। আর না পেলেও ক্ষতি নেই, পরদিন সকালে তো নিশ্চয়ই কিছু পেয়ে যাবো। তারপর না হয় বাকিটা দেখা যাবে। এমন কোনো তাড়া নেই যে যেতেই হবে এখানে বা ওখানে। একা একা ৮/৯ দিন অচেনা নানা রকম জায়গায় ঘুরে বেড়াবো সেটাই আসল আনন্দ। যার মধ্যে গোমুখ একটা লক্ষ্য মাত্র। যেতে না পারলেও এমন কোনো ক্ষতি হবে না আমার। তবে হ্যাঁ একটা লক্ষ্য যেহেতু ঠিক করেছি, সেটা অর্জনের জন্য শেষ পর্যন্ত নিজের সাধ্যমত চেষ্টাটা করে যাবো। সেটা না হলে তখন যেখানে যতটা পারা যায় ঘুরে বেড়িয়ে ফেরার পথ ধরবো।

পিপল মানডি লেক। ছবিঃ লেখক
কত শত পাহাড় যে পেরিয়েছি, পেরিয়েছি একটা নদী যে কতবার? একবার এক পাহাড়ের ঢাল থেকে ওপার তো আর একবার আর এক পাহাড়ের ঢাল থেকে এপার। যে নদীটাকে এত এতবার পাহাড়ের ঢাল আর লোহার ব্রিজ পেরিয়ে এতটা পথ চলেছি সেটাই যে গঙ্গা বা পদ্মা বা স্থানীয়ভাবে ভাগীরথি সেটা জানতাম না। এটাই যে সেই গঙ্গা যেটার উৎস মুখ, গোমুখ দেখতে আমি যাচ্ছি সেটা জেনেছি পিপল মানডি গিয়ে। উত্তরকাশী থেকে ৩০ কিলোমিটার বা এর কমবেশী দূরত্ব থেকে। যেখানে গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে পাহাড়ের খাদে পানি জমিয়ে রেখে একটা সবুজ আর নীল জলাধার করে অপূর্ব করে রাখা হয়েছে চারপাশ। আর যে জমে থাকা পাহাড়ি জল দিয়ে কাছেই গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।
শত নয় বোধহয়, হাজারো পাহাড় পেরিয়ে, কত শত ঝর্ণায় ভিজে ভিজে, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বয়ে যাওয়া গঙ্গার অগনিত শাখা প্রশাখা পেরিয়ে দুপুর ঠিক একটায়, প্রায় ৪ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে আমার প্রাথমিক গন্তব্য উত্তরকাশী এসে পৌঁছেছি। বেশ ভালো লাগছিল ভেবে যে অবশেষে আজকেই, একদিনেই দেরাদুন থেকে উত্তরকাশী পর্যন্ত চলে এসেছি। এখন পারলে, কিছু পেলে গাঙ্গোত্রী যাবো আর না পেলে আজকে এখানে থেকে কালকে যাবো গাঙ্গোত্রী আর সেখান থেকে গোমুখ। বাস থেকে নেমে উত্তরকাশী বাস স্ট্যান্ডে গাঙ্গোত্রী যাওয়ার বাসের কথা জিজ্ঞাসা করতে জানালো যে উত্তরকাশী থেকে এই সময় গাঙ্গোত্রী কোনো বাস যায় না। হায় তাহলে উপায়? কিছু কী আছে? জিজ্ঞাসা করলাম বাস স্ট্যান্ডে।

উত্তরকাশী বাস স্ট্যান্ড। ছবিঃ লেখক
একজন জানালো, পাঁচ ছয়জন ছেলে মেয়ে নাকি একই পথে যাবে বলে এখানে এসেছিল, সামনের দিকে গেছে কোনো গাড়ি বা রিজার্ভ ট্যাক্সি পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখতে। ওদেরকে পেলে ওদের সাথে শেয়ারে চলে যেতে পারবো সেই পরামর্শ দিল। এটা শুনেই আবার দৌড়। সেই পাঁচ বা ছয়জন ছেলে মেয়ের দলকে খুঁজে পেতে। ওদের খুঁজে বের করতে পারলেই একটা উপায় পেয়ে যেতে পারি আজকেই গাঙ্গোত্রী যাবার। তাই আবারো ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে, জুতা হাতে নিয়েই ছুটলাম গাঙ্গোত্রী যাবার সেই দলকে খুঁজে পেতে সামনের উঁচু রাস্তার দিকে।