দোয়েল চত্বরের আশেপাশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়েছিলাম। তিন নেতার মাজার, হাজী শাহবাজের মসজিদ ও মাজার, কার্জন হল ঘুরে পা বাড়ালাম মুসা খাঁর মসজিদ দেখতে। কার্জন হলের পেছনে মসজিদটি, হলের পাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে, এটা আগেই জানতাম। কিন্তু দুটি রাস্তা দেখে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো কিছু তরুণ ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করে কিছুই জানা গেল না। তাই কার্জনের গা ঘেঁষেই হাঁটতে শুরু করলাম। দেখা যাক, সামনে কী পাওয়া যায়।

পেয়েও গেলাম। এটি বাংলাদেশের ঢাকা শহরে অবস্থিত একটি মধ্যযুগীয় মসজিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল ছাত্রাবাসের উত্তর-পশ্চিম কোণে মুসা খাঁর মসজিদ নির্মিত হয় আনুমানিক ১৬৭৯ সালে। ধারণা করা হয় যে, এই মসজিদটি ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খান নির্মাণ করেন। বিনত বিবির মসজিদের পাশাপাশি এটি প্রাক-মুঘল স্থাপত্যের একটি নিদর্শন। মহাপরাক্রমশালী মুঘল সম্রাটদের বিপক্ষে বিক্রম দেখিয়ে বাংলার একটি অংশে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করা বারো ভূঁইয়াদের শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে আছে মসজিদটি।
মসজিদের সামনে একটি প্রাচীন অস্পষ্ট সাইনবোর্ড থেকে জানতে পারলাম, মসজিদটি ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খান নির্মাণ করলেও, স্থাপত্য শিল্পে শায়েস্তা খানি রীতিতে নির্মিত এবং সম্ভবত মুসা খান শায়েস্তা খানের আমলে নির্মাণ করেছেন। মসজিদের দেয়ালে কোনো শিলালিপি না থাকলেও সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে নির্মিত এ ধরনের বহু মসজিদের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান। স্থাপতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি খাজা শাহবাজ মসজিদের অনুরূপে নির্মাণ করেছেন মুসা খান।

মসজিদটির খোপ নকশাকৃত সম্মুখ ভাগ, গম্বুজের নিচে উন্মুক্ত প্রবেশপথ, অষ্টকোণাকার পিপার উপর স্কন্দাকৃতির গম্বুজ এবং অতিরিক্ত মিনারসহ কোণার বুরুজগুলো তথাকথিত মুসা খান মসজিদটিকে নিকটবর্তী খাজা শাহবাজ খান মসজিদের (১৬৭৯ খ্রি) সাথে প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান করে।
এ কারণে মসজিদটির নির্মাণকাল ওই একই সময়ের ধরা যেতে পারে। এটি শায়েস্তা খানের আমলে নির্মিত অথবা পরবর্তী সময়ে মুসা খানের পৌত্র মুনওয়ার খানের তৈরি এবং নির্মাতা তার পিতামহের স্মরণে মুসা খানের নাম অনুযায়ী এর নামকরণ হয়।

একটি উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত মসজিদটির নিচতলায় কয়েকটি কক্ষ রয়েছে। মঞ্চের মতো এই অংশে রয়েছে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ। এগুলোতে আগে মসজিদ সংশ্লিষ্টরা বাস করলেও এর সবগুলোই এখন পরিত্যক্ত। মসজিদের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বারো ধাপ সিঁড়ি পেরুনোর পর আসে মসজিদের দরজা। পূর্ব দিকে খোলা বারান্দা।
পুরো মসজিদের দেয়াল বেশ চওড়া। মসজিদটির পূর্ব-পশ্চিমের দেয়াল ১ দশমিক ৮১ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণের দেয়াল ১ দশমিক ২ মিটার করে চওড়া বলে জানা গেছে। পূর্ব পাশের দেয়ালে তিনটি এবং উত্তর-দক্ষিণে দুটি খিলান দরজা।
মসজিদের ভেতরের অংশের পশ্চিম দেয়ালের মধ্যে একটি প্রধান ও তার পাশে দুটি ছোট মেহরাব। পুরো মসজিদটির দেয়াল সজ্জিত মুঘলরীতির নকশায়। বাইরের দেয়ালের চার কোণে চারটি মিনারখচিত আট কোণ বুরুজ। তার পাশে ছোট ছোট মিনার। বুরুজ ও ছোট মিনার রয়েছে ১৬টি। ছাদে তিনটি গম্বুজ। মাঝেরটি বড়। ওপরের কার্নিশ নকশাখচিত।
তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির একটি গম্বুজে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। ঐ ফাটল দিয়ে বর্ষায় বৃষ্টির পানি মসজিদের ভেতরে পড়ে। তাই গত রোজার ঈদের আগে সেটি সংস্কার করে ভেতরের অংশে নতুন করে রঙ করা হয়েছে। মসজিদের পশ্চিম ও পূর্ব প্রাচীর প্রায় ৬ ফুট পুরু। উত্তর ও দক্ষিণ প্রাচীর ৪ ফুট পুরু। চার দেয়াল, ছাদ এবং গম্বুজ— সবকিছুতেই দীর্ঘদিন ধরে শেওলা জমে কালচে হয়ে গেছে। দুই মূল স্তম্ভে বড় ধরনের ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে।

বাহ্যিক চাকচিক্য হারালেও নান্দনিক নির্মাণ শৈলীতে তৈরি এ স্থাপনা এখনও সচল রয়েছে জামে মসজিদ হিসেবে। কার্জন হল চত্বরে অবস্থিত এ মসজিদে নিয়মিত জুমাসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।
তবে পর্যাপ্ত যত্ন ও তত্ত্বাবধানের অভাবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পূরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষিত মসজিদটি হারিয়েছে তার স্বাতন্ত্র্য। পূর্বদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগ, উত্তরে বিজ্ঞান অনুষদের ডিনের কার্যালয় ও অগ্রণী ব্যাংকের শাখা, দক্ষিণে শহীদুল্লাহ হল এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের ডিনের কার্যালয়ের মাঝখানে তিন গম্বুজবিশিষ্ট মুসা খান মসজিদটি অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই ঢাকা পড়ে আছে। ইতিহাস জানা না থাকলে দেখার পরেও অনুমান করা কষ্ট এটি ইতিহাসের একটি অমূল্য নিদর্শন।

ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি পরিচালনার দায়িত্ব এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের। মসজিদে মোট চারজন কর্মচারী থাকার কথা থাকলেও ইমাম এবং খাদেম ছাড়া বাকী দুটি পদ এখনও খালিই রয়েছে। ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা মো. মামুনুর রশীদ।
শহীদুল্লাহ হল কাছে হওয়ায় এটি হল থেকেই পরিচালনা করা হয়। তবে ইমামসহ অন্যান্যদের বেতনভাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া হয়। লোকবলও নিয়োগ করা হয় কেন্দ্রীয়ভাবেই। হলের দায়িত্বে থাকলেও মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট অনুষদের।

বেশিরভাগ লোকেই জানে না, ভাষাসৈনিক, বহু ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর আনোয়ারুল চৌধুরীর কবর এই মসজিদের প্রাঙ্গণে রয়েছে। পুরোটা ঘুরে দেখতে মসজিদের অন্য দিকে গেলাম। গিয়ে দেখি, ওখানে মেয়েদের নামাজের ঘর আছে। মনটা এত ভালো হয়ে গেল! ভেতরে ঢুকে আসরের নামাজ পড়ে ফেললাম।
কীভাবে যাবেন:
ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে শাহবাগ বা নীলক্ষেত এসে রিকশায় কার্জন হল। কার্জন হলের একটু সামনেই মসজিদটি।
ফিচার ইমেজ: মাদিহা মৌ