রাতের মুন্নার ছিল গাছে-গাছে, পাতায়-পাতায়, পাহাড়ে-পাহাড়ে, ফুলে-ফুলে, ঝর্ণা ধারায়, পাহাড়ি নদীতে বৃষ্টি ঝরা, বৃষ্টি জড়ানো, বৃষ্টিময়। কিন্তু সকালের মুন্নার? একদম অন্য রকম মুগ্ধতা ছড়ানো। খুব ভোরে আমাদের ঘুম ভেঙেছিল। সকাল ৮টায় আমাদের অটো আসবে বলে আমরা সকাল ৭টার মধ্যেই তৈরি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে।
আগের দিনের ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মুন্নারের যে স্নিগ্ধ সবুজ রূপ দেখেছিলাম, সকালে সেই সবুজে সূর্যের প্রথম আলো পড়ে চারদিক যেন হলুদ রঙে সেজে উঠেছিল! সবুজ কচি পাতায় সূর্যের প্রথম স্পর্শে একটা হলুদের ঢেউ ওঠে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে নাম না জানা অনেক রকমের আর রঙ-বেরঙের ফুল হেসেছিল সূর্যের ছোঁয়া মেখে। পাহাড় আর অরণ্যের ফাঁক গলে ঢুকে পড়া শীতের সকালের প্রথম সূর্যের উষ্ণ পরশ একটা অন্য রকম আরাম দিচ্ছিল। হোটেলের সামনেই একটু উপরে উঠে পাহাড়ের পিঠে গড়ে ওঠা একটা টংয়ের দোকানে আমরা চা আর বিস্কিট দিয়ে প্রাথমিক নাস্তা সারলাম।
আগের দিন রাতে যে অটোতে করে আমরা এই হোটেলে এসেছিলাম, সেই অটোটাই ঠিক করেছিলাম আজ সারাদিন মুন্নারের সম্ভাব্য সব জায়গায় ঘুরে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেবে বলে। ভাড়া সরকারী রেট ১,০০০ রুপী। তবে অফ সিজনে কখনো কখনো ৮০০ রুপীতেও সারাদিনের জন্য অটো পাওয়া যায়। যার পেছনে তিনজন আর সামনে একজন আরাম করে বসা যায়। পাহাড়ি পথে হেঁটে বসে, ছবি তুলে, টংয়ের চা খেয়ে অনেকটা সময় কাটালাম। ৮:৩০ এ আমাদের অটো চলে এলো। ব্যাগপত্র পেছনে তুলে রেখে বসে পড়লাম। আমাদের অটো চলতে শুরু করলো মুন্নার দেখাতে।
আহ! কিছুদূর এগোতেই আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু পথে চলতে শুরু করলো। একপাশে গভীর খাদ, তবে ঝুঁকিমুক্ত। কারণ খাদের পাশেই রয়েছে নানা রকম গাছের সমারোহ, কোনো কোনো ঢালু পাহাড়ে চাষের জমি আর খাদের ওপারে বড় বড় পাহাড়ের সারি, সবুজ গাছে গাছে আচ্ছাদিত। আর একটু এগোতেই সকালের প্রথম রোদ পড়া চা বাগানের হলুদ আলো চোখে এসে পড়তেই ঝলসে যাওয়ার মতো অবস্থা। খুব সকালের সদ্য গজানো চায়ের পাতায় যখন সূর্যের প্রথম আলো পড়েতখন চা বাগান ঠিক সবুজ দেখায় না। তখন চা বাগান এক অন্যরূপ ধারণ করে, চা বাগান এক অন্য সাজে নিজেকে সাজায়, একটা অন্যরকম মাধুরী নিয়ে প্রকৃতির মাঝে আলাদা হয়ে থাকে।
সকালের কচি সবুজ চা বাগানের পাতায় পাতায় সূর্যের আলো পড়ে সবুজ রঙ হয়ে ওঠে হলুদ, কখনো কখনো সোনালি রঙে সেজে ওঠে। সবুজের মাঝ থেকে তো তবু মাঝে মাঝে চোখ সরে, কিন্তু এই অপরূপ হালকা হলুদ আর সোনালি রঙের চা বাগান থেকে চোখ সরানো সাধ্য কার আছে জানি না, আমার তো সেই সাধ্য নেই, ছিল না। কী রূপ সেই চা বাগানের, পাহাড়ে পাহাড়ে ঢেউ খেলানো সবুজ ঢেউয়ের মাঝে হলুদ আর সোনালি রঙের ছড়াছড়ি। কী যে এক আকর্ষণে, চোখ মন আর সমস্ত সত্ত্বাকে আটকে রাখবে বুঝে ওঠা মুশকিল। এমন অপার্থিব সৌন্দর্যে পৃথিবীও যেন অপার্থিব হয়ে ওঠে। বহুদিন থেকে মুন্নারের যে ছবি দেখে দেখে আফসোস করেছি, আজ সেই ছবি একদম আমার, আমাদের সামনে, সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে!
চা বাগান তো অনেক দেখেছি আগে। আমাদের সিলেটে, শ্রীমঙ্গলে, মৌলভীবাজারে, তেতুলিয়ায়, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিংয়ে। কোথাও সমতলে, কোথাও টিলায়, কোথাও ছোট ছোট পাহাড়ে, কোথাও বড় বড় পাহাড়ের সমস্ত শরীর জুড়ে। কিন্তু এমন ঢেউ খেলানো, এমন আকৃতির আর আকর্ষণীয় চা বাগান এর আগে কোনোদিন দেখিনি। হ্যাঁ, দেখেছি শুধু মুন্নারের ছবিতে আর সিনেমার নাচে গানে। কিন্তু আজ যে একদম হাতের নাগালে, চোখের সামনে, ক্যামেরার ক্লিকে।
ইচ্ছে হলেই নেমে পড়া যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে, ছোঁয়া যাচ্ছে, আর প্রাণভরে ওর রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করা যাচ্ছে। পাগল করা মুহূর্তগুলো যতটা সম্ভব ধরে রাখতে কখনো ক্যামেরা আর কখনো মোবাইলে ধারণ করে রাখছিলাম। সেই হলুদ-সবুজ আর সোনালি স্নিগ্ধ চা বাগানে অনেক অনেকক্ষণ কাটিয়েছিলাম। একটু বসে, একটু হেঁটে, একটু দৌড়ে আর কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থেকে।
এমন অসংখ্য চা বাগানে অনেকবার থেমেছি, নেমেছি, ছবি তুলেছি আর অপলক তাকিয়ে থেকেছি। কিন্তু এতটুকু সাধ মেটেনি। ইচ্ছে হচ্ছিল যদি কোনো এক চা বাগানের কটেজে, সবুজের মাঝে, কাটাতে পারতাম দুই-একটা দিন, তবেই না পাগল প্রাণে কিছুটা প্রশান্তির পরশ পেতাম হয়তো। কিন্তু সে যে সম্ভব নয়। আমাদের আজকে বিকেলেই ফিরতে হবে কেরালায়, পরদিন ট্রেন আছে ব্যাঙ্গালরের। আর আজকে আরও তো কতকিছু দেখা বাকি রয়ে গেছে।
আবারো পথ চলতে শুরু করলাম অটোতে করে। এবার আমাদের একদিনে ঢেউ খেলানো সবুজ চা বাগান আর অন্যদিকে ঝর্ণা ধারা বয়ে চলা বড় বড় পাহাড়ের সারি। কিছুটা পথ পেরিয়ে, কয়েকটা বাঁক এড়িয়ে আমাদের অটো থামলো এলিফ্যান্ট পয়েন্টে। এখানে গভীর অরণ্যের মাঝে হাতির দেখা মেলে প্রচুর। এখানে হাতির পিঠে করে গভীর অরণ্যের ভেতরে যাওয়া যায় শতেক রুপীর বিনিময়। আমরা প্রকৃতি দেখা ছাড়া কোনো পয়সা আলাদা করে খরচ করার পক্ষে ছিলাম না বিধায়, শুধু দেখে, ছবি তুলে আবারো অটোতে উঠে এবার লেক ও ড্যামের পথ ধরেছিলাম।
মুন্নার ভারতের কেরালা রাজ্যের একটি শৈল শহর। কলকাতা থেকে প্লেন বা ট্রেনে ইরনাকুলাম স্টেশন থেকে বাস বা ট্যাক্সি করে যাওয়া যায়। সময় লাগে ৪/৫ ঘণ্টা।
ফিচার ইমেজ- cloudfront.net
মন মাতানো মুন্নারের চা বাগানের পথে পথে

Loading...