মঠ, এটি হলো একটি বিশেষ অবকাঠামো। তবে নির্দিষ্ট করে মঠ বলতে এমন একটি বিশেষ অবকাঠামোকে বোঝানো হয় যা কোনো এক বিশেষ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গ তাদের ধর্মীয় কারণে নির্মাণ করে থাকেন। এই মঠগুলো মূলত ধর্মীয় কেন্দ্র। মঠগুলো প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় কেন্দ্র হলেও এগুলো শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেও ভূমিকা পালন করেছে বলে জানা যায়। বর্তমানে মঠ নির্মাণের কোনো খবর পাওয়া যায় না, মূলত প্রাচীন সময়ে এসব মঠ নির্মাণ করা হতো। বাংলাদেশে অসংখ্য প্রাচীন মঠ রয়েছে। প্রাচীনকালে নির্মিত সেসব মঠের মধ্যে বাগেরহাটের কোদলা মঠ বা অযোধ্যার মঠ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত এই কোদলা মঠ। মঠটির অবস্থান সদর উপজেলার বারুইপাড়া ইউনিয়নের যাত্রাপুরে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক অবকাঠামোটি আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীতে তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। বাগেরহাটের বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উত্তরে অযোধ্যা নামক একটি গ্রামে এই মঠটি অবস্থিত। নির্মাণের পর মঠটির নামকরণ করা হয় ‘কোদলা মঠ’ নামে। তবে অযোধ্যা গ্রামে অবস্থানের কারণে স্থানীয়দের মুখে মুখে বলার মাধ্যমে বর্তমানে মঠটি ‘অযোধ্যা মঠ’ নামে পরিচিত।
স্থানীয়ভাবে অযোধ্যার মঠ নামেই বেশি পরিচিত হলেও কোদলা মঠ নামেও পরিচিতি আছে মঠটির (তবে স্থানীয়রা ‘অযোধ্যার মঠ’ বললে সকলেই সহজে চেনে)। অযোধ্যা গ্রামে অবস্থিত মঠটির নাম ‘কোদলা মঠ’ রাখার সঠিক কারণ জানা যায়নি। ‘কোদলা’ অযোধ্যা গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর তাদের বিভিন্ন নির্দেশিকায় এই মঠটিকে ‘কোদলা মঠ’ নামেই লিখে থাকেন। এবং বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে মঠটি কোদলা মঠ নামেই প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
কোদলা বা অযোধ্যা মঠের প্রায় পুরোটাই একসময়ে পোড়ামাটির ফলকে আচ্ছাদিত ছিল। এটি একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির। তবে ভারতীয় উপমহাদেশীয় অঞ্চল সমূহের মন্দিরের ন্যায় কোদলা মঠ সাধারণ হিন্দু মন্দিরের অনুরূপে নির্মিত হয়নি। কারণ এই মঠটির নির্মাণ কাঠামো ও ধরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র প্রকৃতির। এ কারণেই মূলত এই মঠটি অধিক পরিচিত ও জনপ্রিয়।
বর্গাকারে নির্মিত চারকোণা আকৃতির ভিতের উপর নির্মাণ করা হয়েছে এই মঠটি। সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র প্রকৃতির এই মঠটি অনেক বেশি সুন্দর। ভূমি থেকে এই মঠটির উচ্চতা প্রায় ১৮.২৯ মিটার। ভেতরে বর্গাকার প্রতিটি দেয়ালের দৈর্ঘ্য প্রায় ২.৬১ মিটার। দেয়ালগুলোর পুরুত্ব প্রায় ৩.১৭ মিটার।
এই মঠটিতে প্রবেশের জন্য তিনটি দরজা রয়েছে। ধারণা করা হয়, দক্ষিণ দিকের বড় দরজাটি ছিল এই মঠটিতে প্রবেশের জন্য মূল প্রবেশ পথ। বাকি দুটি প্রবেশ পথ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে। দক্ষিণের দেয়ালে বর্তমানে কোনো দরজা নেই। প্রবেশ পথগুলোর উপরে পোড়া মাটিতে খোদাই করা লতা-পাতা, ফুলের নকশা ইত্যাদি এখনো দেখা যায় স্পষ্টই। যদিও আগের মতো সৌন্দর্য এখন আর অবশিষ্ট নেই। অনেকটা ভেঙে, ময়লা জমে বয়সের ছাপ পড়েছে মঠটির দেয়ালে দেয়ালে।
মঠটির ভেতরের দিকে প্রায় ১৩ ফুট পর্যন্ত লম্বা গম্বুজ উপরের দিকে উঠে গেছে। এই মঠটির নির্মাণকাল নিয়ে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থাপত্যিক বৈশিষ্টানুসারে অনুমান করা হয় এটি ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে কিংবা সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নির্মিত। বহুকাল আগে মঠের দক্ষিণ কার্নিশের নিচে প্রায় অদৃশ্যমান দুই লাইনের একটি ইটে খোদাই করা লিপি ছিল। সে লিপি অনুযায়ী ধারণা করা হয়, সম্ভবত সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে দেবতার অনুগ্রহ লাভের আশায় কোনো এক ব্রাহ্মণ এই মঠটি নির্মাণ করেছিলেন।
অসাধারণ এই মঠটি জুড়ে অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে। বাগেরহাটের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মতো এই মঠটিও পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে। এই মঠটি ঘুরে দেখতেও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণ পিপাসু ও প্রাচীন নিদর্শন নিয়ে জানতে আগ্রহীরা। বিদেশী পর্যটকদের কাছেও মঠটি কম সমাদৃত নয়।
বাংলাদেশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন নিদর্শন নিয়ে জানতে আগ্রহী? কাছ থেকে দেখে আসতে চান সেসব নিদর্শন? তাহলে আপনার তালিকায় নিশ্চয়ই রয়েছে বাগেরহাটের প্রাচীন এই মঠটি। জেনে নিন ঢাকা থেকে অযোধ্যার মঠ বা কোদলার মঠে যাওয়ার উপায়।
ঢাকা থেকে বাসে যেতে চাইলে:
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত অনেক বাস বাগেরহাটের উদেশ্যে ছেড়ে যায়। তার মধ্যে রয়েছে মেঘনা, বনফুল, পর্যটক, ফাল্গুনী, আরা, বলেশ্বর, হামিম ও দোলা।
এছাড়া গাবতলী থেকে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে সোহাগ, শাকুরা, হানিফ ও ঈগল পরিবহন ছেড়ে যায়। ভাড়া পড়বে ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। ঢাকা থেকে বাগেরহাট পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৭ ঘণ্টা।
ঢাকা থেকে বাগেরহাট পৌঁছে, বাগেরহাট শহর থেকে অটো রিকশায় যেতে পারবেন অযোধ্যা মঠ। পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ৩০ মিনিট। অটো রিজার্ভ নিয়ে গেলে যাওয়া-আসায় ভাড়া পড়বে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। অথবা বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশায় করে আপনি যাত্রাপুরে এসে, সেখান থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ হেঁটে এই মন্দিরে পৌঁছাতে পারবেন।
ঢাকা থেকে ট্রেনে যেতে চাইলে:
ট্রেনে যেতে চাইলে প্রথমে ঢাকা থেকে আপনাকে খুলনা যেতে হবে। ঢাকার কমলাপুর থেকে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসে প্রথমে খুলনা পৌঁছাবেন। খুলনা থেকে বাস ধরে যেতে হবে বাগেরহাট সদর। খুলনার রূপসা থেকে বাগেরহাট সদরে যেতে সময় লাগে প্রায় ৪০ মিনিট।
বাগেরহাট সদর থেকে একইভাবে (পূর্বে উল্লেখ করা নির্দেশনা অনুযায়ী) অটো রিক্সা যোগে পৌঁছে যাবেন অযোধ্যা মঠ।
ফিচার ইমেজ- wikimedia.com