মিরিকের মেঘের মায়ার বাঁধা পড়তে পড়তে প্রায় দেড় ঘণ্টা জীপ ভ্রমণ শেষে পৌঁছে গেলাম মিরিকের লেকের কাছে। জীপ থেকে নেমেই ছোট ছোট সাময়িক নানা রকম দোকানের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে মিরিকের টলটলে জলের লেকের আহ্বান পাচ্ছিলাম। ঝটপট সেদিকে ছুটে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মুহূর্তেই থমকে যেতে হয়েছিল কারণ সামনে গিয়েই দেখি ছোটখাট একটা লোহার গেট, যার দুইপাশে নানা রকম ফলের দোকানে সমারোহ। অনেকেই সেখান থেকে ফলের তরতাজা জুস কিনে খাচ্ছে। কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা।
সেটা হলো, লেকের পাড়ে যেতে গেট দিয়ে ঢুকতে টাকা লাগবে নাকি? ভ্রমণে গিয়ে কোনো প্রকৃতির কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা দেয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি না কেন যেন। তাই একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবলাম ঢুকে যাই আগে, যদি টিকেট না চায় তো বেঁচে গেলাম আর যদি চায় তখন না হয় মূল্য জেনে নতুন করে ভেবে দেখবো।
ঢুকে সোজা লেকের পাশের একটি ছোট গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম, কিছুটা শঙ্কা নিয়ে। নাহ কেউ পিছন থেকে ডাকছে না। বেশ একটা পাথর যেন বুক থেকে নেমে গেল। এবার তবে প্রাণ ভরে মিরিকের লেক উপভোগ করা যায়।
বেশ চমৎকার আঁকাবাঁকা একটা লেক। লেকের যে পাশে আছি, মানে প্রবেশ পথ সেই ধারে লেক লাগোয়া বেশ কিছু হোটেল রয়েছে, যেখানে বিদেশিদের আনাগোনাই বেশি দেখা যাচ্ছিল। তার মানে যথেষ্ট সমাদর আছে এই লেকের বোঝা গেল। একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি যে হয়ে গেছে বেশ বোঝা যাচ্ছিল, ভেজা সবুজ ঘাস আর ঘাসের উপর জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা দেখে।
পাশের গাছ থেকে জমে থাকা বৃষ্টি ফোঁটার ঝরে পড়া দেখে। গাছের ছায়া থেকে এবার লেকের একদম পাড়ে চলে গেলাম। পুরো লেকের পাড় রঙিন ইট আর পাথরের বাঁধাই করা সরু পথের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। যেন পর্যটকদের হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে কোনো সমস্যা না হয়।
লেকের এপারে সবুজ গালিচা আর বেশ কয়েকটি হোটেল। লেকের মাঝখানে রয়েছে একটি সেতু, যা লেকের অন্য পাড়কে যুক্ত করেছে, পাশাপাশি সবার উপভোগের জন্য দারুণ একটা উপায় হয়েছে। অনেকেই সেই লেকের উপরের ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমতো ছবি তুলে চলেছে।
একটি বিদেশি ছেলে মেয়েদের দল এক দৌড়ে ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে চলে গেল মুহূর্তেই। ওরা ওপারে যেতেই প্রথমবারের মতো লেকের ওপারে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। আরে, লেকের ওপারে তো এক অন্য ভুবন দাঁড়িয়ে আছে যে! যেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল আমার কাছে।
কারণ লেকের যে পাড়ে আছি সেই পাড় বেশ সমতল, হোটেলগুলোর অবস্থান থেকে পাহাড়ের শুরু। পাহাড়ি পথের ওপারে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে দাঁড়িয়ে আছে নানা রকম বর্ণিল ঘরবাড়ি আর নানা আকৃতির হোটেল মোটেলসহ আরও নানা রকম স্থাপনা। সেসব ছাড়িয়ে আরও উপরের দিকে তাকালে দেখা মিলবে মিরিকের মন মাতানো আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু পাহাড়ে পাহাড়ে চা বাগানের সবুজ সমুদ্র।
কিন্তু লেকের ওপারে? ওপারে পুরো পাহাড় জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক গভীর অরণ্যে ঢাকা গম্ভীর বনভূমি, পাইন, দেবদারু, শালসহ আরও নানা রকম বিশাল বিশাল গাছের সমারোহ আর সাথে নানা রকম বুনো গুল্মলতার ঝাঁক, যা ওপারটাকে এক অন্য রকম আকর্ষণের আবহ করে রেখেছে।
আর এই ক্ষেত্রে যা হবার তাই হলো। লেকের পানিতে একটু মুখ ডুবিয়ে, ব্রিজের উপরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পুরো লেকের সবটুকু উপভোগ করে, লেকের মাঝে ছোট ছোট নৌকায় ভেসে চলা বিলাসি পর্যটক দেখে আর পানকৌড়িদের সাঁতার কেটে চলা দেখতে দেখতে আমরা অমোঘ আকর্ষণ একই সাথে পাহাড় আর সেই পাহাড় জুড়ে অরণ্যের কাছে চলে গেলাম।
লেকের এপারে, নির্জন অরণ্যের কাছে আসতেই একটা গা ছমছমে অনুভূতি টের পেলাম। নিস্তব্ধ, গভীর আর অনেকটা অন্ধকার একটা পরিবেশ এদিকে। বিশাল বিশাল পাইন আর নাম না জানা নানা রকম গাছে, লতায়, পাতায় আচ্ছাদিত, অচেনা নানা রকম পাখির উড়ে যাওয়া আর দূরে কোনো আদুরে পাখির ডাক শুনতে শুনতে আনন্দ, শিহরণ আর রোমাঞ্চ নিয়ে পথে চলতে লাগলাম। ১০ মিনিট হাঁটার পরেই লেকের শেষ প্রান্তে এসে পড়লাম। এখন সামনে যতদূর চোখে যায় শুধু পাহাড়ের উঠে যাওয়া, অরণ্যের মাঝে দিয়ে ছোট ছোট পথের রেখা আর পাহাড়ের বেশ উপরে একটি বাংলো।
বাংলোটা দেখে একটু সাহস হলো, যাক মনুষ্য বসতি তাহলে আছে ওদিকে। যে কারণে রোমাঞ্চের নেশাটা পেয়ে বসলো। পাহাড়ের পথ ধরে বাংলোর দিকে চলতে শুরু করতে, কিছুক্ষণ পরে দেখি আরে বাংলো তো হারিয়ে ফেলেছি কখন যেন! সেটা তো আর চোখে পড়ছে না!
তবে ভয় একটু কম পেয়েছিলাম। আমি একটি পথ ধরেই হেঁটে চলেছিলাম আর সেই পথে আরও দুজনকে পেয়ে গেলাম। যারা আমার পথ ধরেই যাচ্ছিল সামনের দিকে। তাদের হেঁটে যাওয়া পথ ধরে, বেশ কিছুটা পাহাড় চড়াই করেই একটা অনন্য জায়গায় গিয়ে পৌঁছে গেলাম। মুগ্ধ হয়ে রইলাম আর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
পৌঁছে গেছি মিরিকের এক পাহাড়ের একদম চূড়ায়। যে চূড়াটা বেশ বিস্তৃত। যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি অন্য রকম বর্ণিল কটেজ। সুইজারল্যান্ডের বাড়ির আদলে তৈরি বলে এই জায়গার নাম সুইস কটেজ। পাহাড়ের চূড়ার দুইপাশে সারি করে তৈরি করা হয়েছে পর্যটকদের জন্য অনন্য আকর্ষণ আর অত্যাধুনিক এই সুইস কটেজ। সুইস কটেজের গল্প আর একদিন আলাদা করে বলবো। সময় নিয়ে সুইস কটেজ দেখে বের হলাম সেই পথচারীদের অনুসরণ করে।
এবার একটু নিচে নেমে, অন্য আর একটি পাহাড়ের চূড়ার দিকে যাচ্ছি। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম এবার যেখানে যাচ্ছি সেটা মিরিকের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়া! বাহ দারুণ তো, একটা অন্যরকম আনন্দের উচ্ছ্বাস বয়ে গেল নিজের ভেতরে। প্রায় ২০ মিনিট পাকা পথ ধরে উঁচুতে ওঠার পরে আসলেই একটি পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। যেখানে আছে একটি হ্যালিপ্যাডও। তার মানে আসলেই এটি সবচেয়ে উঁচু পাহাড় চূড়া।
সত্যি তাই, সেই পাহাড় চূড়ার লোহার বেঞ্চিতে বসে বসেই মেঘ ছোঁয়া যায়, মেঘেদের সাথে মিতালী করে ছবি তোলা যায়, সখ্য করা যায়। সেই পাহাড়ের চূড়ায় বসে বসেই দূরের সবুজ পাহাড়ের মাঝে গোলাপি রঙের সুইস কটেজের অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়, পুরো মিরিক শহর দেখা যায়, দেখা যায় দার্জিলিং, কালিম্পংসহ আরও ছোট ছোট শহরের অবস্থান। আর যদি ভাগ্য হয় খুব বেশি ভালো, যদি আকাশে না থাকে মেঘেদের আনাগোনা, তবে সেই পাহাড়ের চূড়ায় বসেই দেখা যেতে পারে দূরের হিমালয়ের শ্বেত শুভ্র রূপ, কাঞ্চনজঙ্ঘা।
এই ছোট্ট মিরিকে আর কী চাই বলুন? যদি অল্প সময়ে আর স্বল্প খরচে একই সাথে পাওয়া যায় মেঘেদের আমন্ত্রণ, পাহাড়ের আহ্বান, অরণ্যের অনন্যতা, চা বাগান সবুজ, লেকের সতেজতা, বনেদী কটেজ, দার্জিলিং, কালিম্পংয়ের রূপ আর যদি পাওয়া যায় বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়ার দর্শন।
যেভাবে খুব সহজে মিরিক যেতে পারেন:
ঢাকা থেকে বাংলাবান্ধা হয়ে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার বা রিজার্ভ জীপে এক থেকে দেড় ঘণ্টায় মিরিক। একদিন থাকলে খুব বেশি হলে জনপ্রতি খরচ হবে ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা, এর বেশি কিছুতেই নয়।
ফিচার ইমেজ- Bioskop-21.info