ঢাকায় সূর্যোদয় হয় ৫:৩০ থেকে ৫:৪০ এই সময়ে। কিন্তু সাজেকে সূর্য নাকি ৩:৩০ এ ওঠে? জীবনে শুনেছেন এমন ঘটনা যে এমন ছোট একটা দেশে দুই ঘণ্টা আগে-পরে সূর্য ওঠে! চলুন সেই অদ্ভুত পাগলামির গল্পটা শুনি।
এবারই প্রথম সাজেক যাওয়া নয়। আগেও গিয়েছি। কিন্তু সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখা হয়নি। তাই এবার আর যাই হোক এই অপার্থিব দুটি মুহূর্ত কিছুতেই মিস করা যাবে না বলে সবাই বেশ এক রোখা আর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছি।
সাজেক পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে গেল। এদিকে দুপুরের খাবার এখনো খাওয়া হয়নি। লাঞ্চ করতে বসলে আর সূর্যাস্ত দেখা যাবে না, আবার ক্ষুধায় সবার কাহিল অবস্থা। কে কী করবে বা না করবে এটা ভেবে ভেবে অস্থির। শেষমেশ যেটা হলো, পুরো দল ছন্নছাড়া হয়ে পড়লো লাঞ্চ আর সূর্যাস্তের দোটানায়। কিন্তু যারা সূর্যাস্ত উপভোগে গেল তারাও শেষ পর্যন্ত হেলিপ্যাডে পৌঁছাতে পারল না আর যারা লাঞ্চ করতে থেকে গেল তারাও ওই সময়ই লাঞ্চ করতে পারল না।

সূর্যাস্ত দেখা হলো গাছ, পাতা আর আদিবাসীদের আবাসের ফাঁক ফোঁকর থেকে যে যেভাবে আর যতটুকু পারে। সন্ধায় দুপুরের খাবার খেতে খেতে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল, সূর্যাস্ত ঠিকঠাক পেলাম না সেটা নাহয় মানলাম। কিন্তু আগামীকালের সূর্যোদয় কিছুতেই মিস করা যাবে না। বেশ আগেভাগেই হেলিপ্যাডে গিয়ে পৌঁছাতে হবে।
রাতের খাবার সেই ১১:৩০টায়। সন্ধ্যায় ভর পেট খেয়ে এর আগে আর খাওয়াও সম্ভব নয়। রাতের খাবার খেতে খেতে আলোচনা হচ্ছিল ঠিক কটা নাগাদ উঠলে সূর্যোদয় উপভোগ একটুও বাদ যাবে না? অনেক আলাপ আলোচনা আর যুক্তি তর্কের শেষে ঠিক হলো, ভোর ৪টায় ওঠা হবে। ৪:৪৫ এ সূর্য উঠবে। সেভাবেই আলোচনার শেষ হলো এবং রাতের খাবারেরও।
ভ্রমনে এসে যতই খাই, আড্ডার ছলে একটু চা না খেলে কী হয়? তাই রাতের খাবারের ক্লান্তি দূর করতে একটু জিরিয়ে, চায়ের ফরমায়েস দেয়া হলো। চা চক্রের ভিতরেই কোত্থেকে কে যেন শুনে এলো যে সাজেকে সূর্য নাকি অনেক আগে থেকেই দেখা যায়! একেবারে পাহাড়ের উপরে থেকে দেখবো বলে নাকি আরও আগেই আকাশ লাল-নীল-কমলা, মোট কথা “বেণীআসহকলা” রঙ ধারণ করে!
তবে কখন উঠতে হবে? এই নিয়ে সবাই মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। এরই ভিতরে আরও একটা খবর কানে এলো, সেটা হলো হেলিপ্যাডে যদি আগে আগে পৌঁছানো না যায়, তবে সামনে জায়গা পাওয়া যাবে না। আর সূর্যোদয়ও ঠিক মতো দেখা যাবে না। পেছন থেকে নাকি লাফিয়ে লাফিয়ে সূর্য দেখতে হবে!
তবে ছবি তোলা? তার কী হবে? এইসব ভাবনায় আগের দুশ্চিন্তা কয়েকগুণ বেড়ে টেনশন আর মানসিক অস্থিরতায় রূপ নিল! এবং সিন্ধান্ত নেয়া হলো সবাই রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে একটু ফ্রেশ হয়ে, রাত ৩:৩০ এর মধ্যে বেরিয়ে হেলিপ্যাডের একদম সামনের জায়গা দখল করতে নেব!

এই কথা শুনে এক বদ্ধ ভ্রমণ উন্মাদ প্রস্তাব দিল আজকে না হয় নাই ঘুমাই? কী দারুণ তারা ভরা আকাশ, অর্ধ কিন্তু ঝকঝকে চাঁদ, জোনাকির ঝিকিমিকি, পোকা মাকড়ের ভিন্ন ব্যঞ্জনা, মেঘেদের সমুদ্র সাজানো, কুয়াশার চাদর জড়ানো, আর? আবেগে আবেশে ভেসে যাওয়ার মতো মুহূর্ত! কী এমন হবে একরাত না ঘুমোলে? এমন রাত, এমন মুহূর্ত আর এমন বন্ধু বেষ্টিত ক্ষণ কি বার বার আসে? তাই আজ নাহয় জেগেই থাকি?
এইসব বর্ণনা শুনে একটু আবেগি না হয়ে কি পারা যায়? বাঁধা কি যায় দেয়া, উপভোগের অনুভূতিকে? যায় না বোধহয়, তাই বেশ কয়েকজন সহমতও পোষণ করলো, এই রাত জেগেই কাটাবে। রাস্তায় হেঁটে, আকাশ দেখে, তারা গুণে, জোনাকির আলো নিয়ে খেলা করে, চাঁদের সাথে কথা বলে, আর পাহাড়ে হেলান দিয়ে! বাহ কী দারুণ!

কিন্তু শেষমেশ রাত একটার পরে আর কাউকেই পাওয়া গেল না, শুধু সেই বদ্ধ ভ্রমণ উন্মাদ ছাড়া সবাই রুমে, ঘুমে। আর এক বদ্ধ ভ্রমণ উন্মাদ যা বলেছে সেভাবেই রাস্তায় হেঁটে হেঁটে, পাহাড়ের চূড়ায় শুয়ে বসে। ভালোবাসার জনের সাথে একা একা কথা বলে, মেঘ-কুয়াশায় জড়িয়ে গিয়ে, গান শুনে, মনে মনে গল্প লিখে রাত ৩টা বাজিয়ে দিল।
এরপর সবাইকে ডেকে তোলার দায়িত্বও নিল। এবং সেভাবেই রাত তিনটায় প্রায় সবাইকেই জাগালো। গোছগাছ হয়ে সবাই বের হতে হতে ৪:১৫ পেরিয়ে গেল। গল্প-কথা আর গানে গানে হেলিপ্যাডে পৌঁছানোর আগেই সেনাবাহিনীর বাধা! এত রাতে কোথায় যাচ্ছি? কেন সূর্যোদয় দেখতে?- এত রাতে? পাগল নাকি আপনারা! সূর্য কয়টায় ওঠে জানেন না? আপনারা সবাই তো শিক্ষিত, পরিপক্ক মানুষ, একবারও ভাবলেন না যে সূর্য তো সব জায়গাতেই একই সময় ওঠে!

৫:৪০ এ সূর্য উঠবে। আর এখন বাজে ৪:৩০! বুঝলেন কিছু? কতটা ঝুঁকিপূর্ণ পথ হেঁটে এসেছেন আপনারা? আপনাদের নিয়ে আর পারি না আমরা ইত্যাদি ইত্যাদি কথা শুনে সবাই শুধু একে অন্যের দিকে বেকুবের মতো তাকিয়ে ছিলাম। তারপর ইনিয়ে-বিনিয়ে দুই চারটা ফালতু আর অগ্রহণযোগ্য যুক্তি তুলে ধরে মুক্তি পেয়ে হেলিপ্যাডে গিয়ে পৌঁছাল সবাই।
এরপর পরবর্তী এক ঘণ্টা পূবের আকাশে চাতক পাখির মতো করে তাকিয়ে থেকে, অপেক্ষা অপেক্ষা আর অপেক্ষা… বর্ণিল সূর্যের জন্য অধীরতা, আকুলতা আর অমোঘ আকাঙ্ক্ষা। ক্ষণে ক্ষণে আকাশ হাসছে, তার রঙ পরিবর্তন করছে, কখনো গোলাপি, কখনো হালকা হলুদ, কখনো কমলা, কখনো লাল আবার কখনো বেগুনী!

অদ্ভুত সব রঙের বর্ণিল খেলা খেলতে খেলতে এক সময় সূর্যোদয়ের সময় পেরিয়ে যায়। কিন্তু সূর্য আর ওঠে না! কেন কী হলো? আকাশের রঙও যেন তার বর্ণিলতা হারালো। সূর্য আছে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু দেখা মিলছে না! আসলে পূবের আকাশ মেঘে ঢেকে গিয়ে সূর্যকে আড়াল করে রেখেছে!
এরপর যখন সূর্যকে দেখা গেল, সেদিকে আর তাকানোর উপায় ছিল না। আলোর বিচ্ছুরণ বা তেজ এতই ছিল!
কিন্তু সেই অধীর আগ্রহ আর অপেক্ষার মোহময় সূর্যোদয় অধরাই থেকে গেল……
