স্বপ্নের টুমলিংয়ে এক স্বপ্নময় বৃষ্টিঝরা রাত কাটিয়ে খুব ভোরে, হ্যাঁ খুব ভোরেই আমরা আমাদের ট্রেক শুরু করেছিলাম। তখনো পৃথিবী জেগে ওঠেনি, পাহাড়েরা ঘুমিয়ে ছিল কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। রাতভর ঝরে পড়া বৃষ্টিতে ওরা পরিশ্রান্ত ছিল তাই বেশ গাঢ় ঘুমে ছিল তখনো। টুমলিং থেকে কালাপোখারি ১১ কিলোমিটার পথ। পুরোটাই এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের উপরে, চূড়া থেকে চূড়ায়, চড়াই আর চড়াই।
এই অপূর্ব, স্মরণীয় পাহাড়ি পথ পেরোতে কতগুলো পাহাড় যে পাড়ি দিতে হয়েছে গুণে রাখতে পারিনি। শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে থেকেছি সকাল ৬টা থেকে সেই দুপুর ২টা পর্যন্ত পুরো ৮ ঘণ্টা। তাকিয়ে থেকেছি পাহাড়ের এত এত রূপ, এমন অমোঘ আকর্ষণ, এত এত বৈচিত্র আর দুই দেশের পাহাড় ও পাহাড়ি মানুষদের একাত্মতা দেখে।
হ্যাঁ টুমলিং থেকে কালাপোখারি যেতে যে ১১ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যেতে হয়, সেই পথের পুরোটাই ভারত আর নেপালের মাঝ দিয়ে। এই ভারতে তো এই নেপালের পাহাড়ি পথে। একটা অদ্ভুত পথ সেটা। হয়তো হাঁটছেন ভারতের কোনো পাহাড়ের উপরে, কিন্তু যে পথে চলেছেন সেই পথটা নেপালের! আবার হয়তো চলেছেন নেপালের কোনো পাহাড়ের গায়ে গায়ে, কিন্তু যে পথে হেঁটে যাচ্ছেন সেটা হয়তো ভারতের মধ্যে! একটা অদ্ভুত সমীকরণ যেন, চাইলেই মেলানো যায় না, যাবে না। শুধু অবাক চোখে চেয়ে থেকে থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
এই পথটুকু এমন ছিল যে পাহাড়ের রিজ ধরে হেঁটে চলেছি, তার দুইপাশেই পাহাড়ের সারি বা সিঁড়ি। এখানে পাহাড়ের সিঁড়ি উঁচুতে ওঠেনি কোথাও, শুধু নিচেই নেমে গেছে কিন্তু আপনি যে পথে চলেছেন সেই পথটুকু আবার উঁচুতে উঠে গেছে। উঁচু থেকে আরও উঁচুতে, যেন আকাশ ছুঁতে চলেছেন আপনি একটু পরেই! পাহাড়ের সিঁড়ি একেবারে অনেকটা নিচে নেমে গিয়ে দূর থেকে আবার উঁচুতে ওঠা শুরু করে। যে পাহাড়ের সিঁড়ি এঁকেবেঁকে শেষ করে সবুজ পাহাড়, তারপর পাথুরে পাহাড়, কিছুটা রুক্ষ পাহাড়, তারপরে একেবারে শেষে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলে বরফের পাহাড় চূড়া, হিমালয়ে গিয়ে পৌঁছে যায় যে পাহাড়ের সিঁড়ি।
আর দূরের এই অপরূপ পাহাড়ের মন মাতানো আর ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদল করা পাহাড়ের কারুকাজ আর সাজ দেখতে দেখতে যদি কখনো ক্লান্ত লাগে, তবে কোনো এক পাহাড়ের পিঠে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন কিছু সময়ের জন্য। তখন চোখে পড়বে আপনার পথ চলা পাহাড়ের নানা রকম রঙ-রূপ আর সৌন্দর্য। যা এতক্ষণ দূরের পাহাড়ের সম্মোহনে চোখে পড়েনি আপনার। পাহাড়ে হেলান দিয়ে দেখবেন চারদিকে রডেডনড্রনের নানা রকম আকার, আকৃতি আর শেড। নাম না জানা কত রকম ছোট বড় পাহাড়ি ফুলের সমারোহ, শত রকমের পাহাড়ি গুল্ম লতার আহ্বান। রঙ বেরঙের নাম না জানা গাছপালা। আর যদি ভাগ্য হয় ভীষণ ভালো, তবে পথে যেতে যেতে গভীর অরণ্যের মাঝে চোখে পড়তে পারে দুর্লভ পাণ্ডা বা লাল পাণ্ডাও!
এরপর আবার যখন হাঁটতে শুরু করবেন একটু বিশ্রামের পরে। দেখবেন পাহাড়ি পথ হুট করেই ঢুকে গেছে কোনো গহীন অরণ্যের মাঝে। যেখানে শত বছরের শ্যাওলা পড়া পুরনো গাছ অদ্ভুত কালো হয়ে গেছে, গাছের মাঝেই জন্মে গেছে কত রকম আগাছা, কোথাও কোথাও চলার পথ ভেসে যাচ্ছে পাহাড়ি অরণ্য থেকে নেমে আসা প্রবল ঝর্ণা ধারায়, যে ঝর্ণাধারা মিশেছে গিয়ে দূরের কোনো খরস্রোতা নদীর সাথে, যার কলকল ধনি ভেসে আসছে আপনার কানে, সুরের মূর্ছনা হয়ে। যে মূর্ছনা একটা অপূর্ব আবেশে জড়িয়ে ধরবে আপনাকে। ইচ্ছে হবে যদি ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকা যেত কিছুক্ষণ, যদি অনন্তকাল ধরে শোনা যেত এমন প্রকৃতির সুরের মূর্ছনা!
সেইসব ঝর্ণা, নদী আর ছুটে চলা জলের অপার্থিব সুরের মূর্ছনায় পথ চলতে চলতে এক সময় ঢুকে পড়বেন আরও গভীর অরণ্যের মাঝে, যেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে অন্য রকম রোমাঞ্চ। যেখানে সূর্যের আলো পর্যন্ত পৌঁছায় না ঠিকমতো, বিশাল বিশাল শত বছরের পুরনো গাছের ভয়াবহ সাপের মতো লতা ঝুলে পড়েছে অরণ্য থেকে আপনার পথ জুড়ে!
প্রথম দেখায় থমকে গিয়ে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক পা, এই বিশাল কালো আর জলজ্যান্ত কোনো সাপের মাথা বা লেজ বুঝি রাস্তায় চলে এসেছে এই ভেবে! কিন্তু একটু থমকে দাঁড়িয়ে ভালো করে যখন তাকাবেন তখন বুঝতে পারবেন, আরে পুরো পথ জুড়ে তো আর এত এত সাপ ছড়িয়ে থাকতে পারে না। ওগুলো আসলে প্রাচীন গাছের আগাছা আর লতা ঝুলে পড়েছে অরণ্য থেকে পথের মাঝে।
আবারো হাঁটা শুরু করতেই হয়তো ঝুপ করে নেমে পড়বে ঝুম বৃষ্টি, কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই। তখন এই পথের রোমাঞ্চ আরও বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। কারণ এমনিতেই আপনি ছিলেন প্রায় অন্ধকার এক অরণ্যের পথে, যেখানে সূর্যের আলো পর্যন্ত ঠিকমতো পৌঁছায় না, গাছে গাছে আগাছা আর ভয়াবহ সাপের মতো লতা ঝুলে আছে যেখানে সেখানে আর সেখানেই যদি ঝুম বৃষ্টি নামে তখন না চাইতেও আপনাকে আশ্রয় নিতে হবে কোনো এক প্রাচীন গাছের নিচে, বৃষ্টি থেকে একটু নিজেকে বাঁচাতে।
এইসব গাছের কাছে চোখ বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকাই ভালো, অথবা মনকে অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে পথের অন্যান্য সঙ্গীদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠতে পারেন, কারণ কত রকমের গা শিরশিরে পোকা মাকড় যে চোখে পড়বে তার কোনো হিসেব নেই কিন্তু! সাথে তো রয়েছেই যে কোনো সময় হিংস্র বন্য কোনো পশুর হুংকার!
তবে অরণ্যের এই বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই ঝটপট পা চালাতে হবে কাছের কোনো লোকালয়ে যত দ্রুত সম্ভব যাওয়া যায়। তবে সামনে রয়েছে আরও কষ্ট আর রোমাঞ্চ, হ্যাঁ টুমলিং থেকে কালাপোখারির পথটুকু এমনই পদে পদে নানা রকম, ধরন আর অনাজা, অচেনা রোমাঞ্চে ভরপুর।
হয়তো আপনি দ্রুত হেঁটে অরণ্য থেকে বেরিয়েছেন সূর্যের আলোময় কোনো ঝকঝকে পথে। মুখে হাসি ছড়িয়ে গেছে ভয়াবহ পথ শেষ করেছেন বলে, কিন্তু সামনের দিকে তাকাতেই আপনার সেই হাসি মিলিয়ে যাবে মুহূর্তেই! কেন না, এতক্ষণ গভীর অরণ্য হলেও, ঝমঝমে বৃষ্টি হলেও, পথে পথে নানা রকম ভয়াবহ পরিস্থিতি থাকলেও, সেই পথ ছিল প্রায় সমতল। মনে মনে ভয় থাকলেও শরীরে তেমন কষ্ট লাগেনি।
কিন্তু এবার? এবার সামনে তাকিয়ে হয়তো মুহূর্তের জন্য মুষড়ে পড়বেন, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে পাহাড়ি পথের একদম খাড়া উঠে যাওয়া দেখে। সবুজ অরণ্যের মাঝে, মাথার সিঁথির মতো সরু সাদা পথ উঠে গেছে, পাহাড়ের চূড়া থেকে চূড়ায়, যতদূর চোখ যায়। আপনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার আগেই মনে পড়বে এই পাহাড়ি পথগুলো পেরোলেই দেখা মিলবে বহুদিনের স্বপ্ন দেখা আর অনেক কল্পনার জাল বোনা সেই স্বপ্নের সান্দাকফুর বা সান্দাকফুর চূড়ার! কালাপোখারির। যেখান থেকে সান্দাকফুর চূড়া আর মাত্র ২-৩ ঘণ্টার পথ। যা চোখেই দেখা যাবে সারাক্ষণ, শুধু ওই পথটুকু পেরুলেই। তখনই আপনি নতুন উদ্যোম পাবেন, পাবেন নতুন প্রেরণা বাকি পথটুকু অনায়াসে পাড়ি দেবার।
এভাবে যখন কালাপোখারি পৌঁছে যাবেন, সব রকম ভয়, রোমাঞ্চ, অজানা শঙ্কা শেষে। ধোঁয়া ওঠা চা বা কফির কাপে ঠোঁট ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে মনে পড়বে ফেলে আসা পথের কথা, আচমকা ভয়ের কথা, সাপের মতো গাছ থেকে ঝুলে পড়া লতার কথা, ঝুম বৃষ্টিতে অজানা আশংকার কথা, মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে মুষড়ে পড়ার কথা, আর অবশেষে শত কষ্ট শেষে স্বপ্নের সীমানার কাছাকাছি পৌঁছে যাবার তৃপ্তি আর অর্জনের কথা। যে স্মৃতি, যে অভিজ্ঞতা, যে পথ, শুধু তখন নয়, সারাজীবন আপনাকে রোমাঞ্চে রোমাঞ্চিত করে তুলবে। যখনই আর যেখানেই মনে পড়বে। তখন সামনের যে কোনো বাধা, ভয়, শঙ্কা আর অনিশ্চয়তাকে জয় করার অনুপ্রেরণা যোগাবে প্রতিনিয়ত।
হ্যাঁ, টুমলিং থেকে কালাপোখারির পথটুকু পরবর্তী জীবনের যে কোন সমস্যায় এমনই অনুপ্রেরণাময়।
ফিচার ইমেজ- জয়দীপ
টুমলিং থেকে কালাপোখারি: বাঁকে বাঁকে রোমাঞ্চ

Loading...
sandakfu jaoar process ta ki? kivabe jabo, kotodin time lagbe, khoroch kmn janale upokrito hotam
শিলিগুড়ি থেকে মানেভাঞ্জন হয়ে সান্দাকুফু যেতে হয়। মোট ১০ দিনের মোট সময় লাগে, জনপ্রতি ৮-১০ হাজার টাকা খরচ হবে।