ন্যাশনাল জিওগ্রাফি বা ডিসকভারি আমাদের অনেকেরই প্রিয় চ্যানেল। এসব চ্যানেলে প্রায় দেখা যায় হিংস্র জন্তু জানোয়ার যারা বনভূমিতে শিকার করছে অন্য বন্যপ্রাণীকে। বনের পরিবেশে তাদের টিকে থাকার লড়াই আর বনভূমিতে বিভিন্ন আচরণ এই টিভি চ্যানেলগুলোকে এত বেশি জনপ্রিয় করছে। বাস্তবেও কিন্তু দেখা সম্ভব এগুলো। এজন্য আপনাকে যেতে হবে অাফ্রিকায়।

চিড়িয়াখানা আর সাফারির মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে চিড়িয়ানায় বন্য প্রাণীকে খাঁচায় আবদ্ধ রাখা হয় আর সাফারিতে নিজেরা গাড়ীর মধ্যে মোটামুটি আবদ্ধ থাকতে হয়, বন্য প্রাণীরা নিজেদের মতোই আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়।
সাধারণত সাফারিগুলোতে ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ী ব্যবহার করা হয়, যাতে বনভূমির এবড়োথেবড়ো পথে চলতে কোনো সমস্যা না হয়। আর রাতে রাখা হয় নিরাপদ ক্যাম্প সাইটে।

সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় সাফারির তালিকা করলে মাসাই মারার স্থান প্রথম দিকেই হবে। নানা কারণে অসম্ভব জনপ্রিয় এই সংরক্ষিত অঞ্চলটি। কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবি থেকে ২৭০ মাইল দূরে অবস্থিত বনাঞ্চল সেরেংগেতি অঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেরেংগেতির মূল অংশ যদিও তানজানিয়ায় পড়েছে মাসাই মারা কেনিয়ার মধ্যে পড়েছে।

মাসাই এ অঞ্চলের আদিবাসিদের নাম, আর মারা তাদের ভাষা। আদিবাসীদের সম্মান জানানোর জন্যই তাদের নামেই এ বনাঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে। সেরেংগেতি অঞ্চলের মধ্যে জায়গার তুলনায় মাসাই মারাতেই বন্যপ্রাণীর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। যে কারণে সহজেই দেখা মেলে চিতা, সিংহ, জিরাফ, ওয়াইল্ড বিস্ট, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, জেব্রা সহ অসংখ্য প্রাণীর। এছাড়াও এখানে রয়েছে ৫৭০টির বেশি প্রজাতির পাখি।

আফ্রিকার সবচেয়ে বিখ্যাত ওয়াইল্ড বিস্ট মাইগ্রেশন শেষ হয় মাসাই মারাতে গিয়ে। জুলাই থেকে অক্টোবরে এ মাইগ্রেশন দেখতে সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকরা ভিড় জমায় কেনিয়াতে।
এক সাথে ২০ লাখ ওয়াইল্ড বিস্ট ও ২.৫ লাখ জিরাফ এ সময় দেশান্তরি হয়ে সেরেংগেতি প্রতিবেশের তানজানিয়া অংশ থেকে কেনিয়ায় চলে আসে। জন্ম দেয় ৫ লাখেরও বেশি নতুন বাচ্চার। সবাই কিন্তু নিরাপদেই যেতে পারে না।

বনভূমিতে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মাংসাশীদের শিকার হয় তারা। জলের মধ্যে রয়েছে বিশালাকৃতির কুমির, আর স্থলের বিভিন্ন জায়গায় ওঁত পেতে থাকে চিতা আর সিংহ। একটু অসাবধান হলেই এদের খাদ্যে পরিণত হতে হয়।
আছে ভয়ংকর হায়েনারাও। এছাড়া দিনের বেলা বিষাক্ত সাপেরাও ঘুরে বেড়ায়। আফ্রিকান জংগলের স্বাদ নিতে হলে এ ধরনের সাফারি ছাড়া কোনো উপায় নেই।

জংগল সাফারিগুলো এমনভাবে পরিকল্পণা করা হয় যাতে নিরাপদে বনভূমিতে ৪/৫ দিন কাটিয়ে আপনি সারা জীবন মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে পারেন। আপনার গাড়ি কখনো চলে যাবে বড় কোনো জিরাফের দলের পাশ দিয়ে।
কখনো বা দিগন্ত বিস্তৃত জেব্রা ও ওয়াইল্ড বিস্টের দলের সামনে গিয়ে পড়বেন। হিংস্র বন্যপ্রাণীরা তো গাড়িকে পাত্তাই দেবে না। উল্টো গাড়ির ছাদে বা বনেটে চড়ে বসতে পারে চিতা বা সিংহ।

আতংকিত হবার মতো কিছু নেই। আপনি নিরাপদেই থাকবেন। এছাড়া প্রশিক্ষিত গাইড আপনাকে আগেই বলে দেবে এ সময়গুলোতে কী করতে হবে। ইউটিউবে একটু ঘাঁটাঘাটি করলেই গাড়ির উপর চিতা বা সিংহের উঠে বসা বা গাড়িকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরার ভিডিও দেখতে পাবেন অনেক। অনেক সময় সিংহের দল এমনভাবে গাড়ি ঘিরে ধরে রাখে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে অনেকক্ষণ।

তবে শিকার দেখাটাই মনে হয় এ ধরনের সাফারির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। সিংহ, চিতা, হায়েনা বা কুমিরের শিকার করার দৃশ্য এতদিন শুধু টিভিতেই দেখেছেন, কিন্তু মাসাই মারাতে বন্যপ্রাণীর ঘনত্বের কারণে এ দৃশ্য দেখা যায় অহরহ। তবে অভিজ্ঞরা বলেন শিকার দেখতে যাওয়ার সেরা সময় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী। কারণ এ সময় আবহাওয়া শুষ্ক থাকে, বড় বিড়ালগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে শিকার ধরতে পারে।

বনভূমির মধ্যে থাকার জন্য গাড়ি নিয়ে ৪/৫ দিনের জন্য বেরিয়ে পড়বেন একেবারেই। তাই রাতে থাকতে হবে মাসাই মারাতেই। তবে থাকার ব্যাপারটাও অন্যরকম আকর্ষণীয় করে রাখা হয়েছে। জংগলের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে নিয়মিত দূরত্বে নিরাপদ এ সমস্ত ক্যাম্প। প্রতিদিনের সাফারি শেষে এরকমই কোনো এক ক্যাম্পে গিয়ে রাতে অবস্থান করে সবগুলো সাফারির গাড়ি।
কাঠের অবকাঠামোর আর তাঁবুর সরঞ্জাম দিয়ে তৈরি এসব ক্যাম্প আপনাকে ঘুরিয়ে আনবে ইতিহাসের পাতা থেকে। এছাড়া আফ্রিকার বিখ্যাত খাবার দাবার তো রয়েছেই। পথে আবার মাসাই লোকজনের সাথেও দেখা হবে, তাদের ঐতিহ্যবাহি নাচ-গানের পাশাপাশি তাদের গ্রামগুলো ঘুরে বনভূমির জীবন যাপন সম্পর্কে একটি পরিস্কার ধারণাও পেয়ে যাবেন।

তবে সাফারির খরচ কিন্তু কম না। নাইরোবি থেকে এ ধরনের সাফারিতে ৪-৫ দিনের জন্য খরচ পড়ে ৮০০ থেকে ১,২০০ ডলার। কী দেখবেন, কী ধরনের ক্যাম্পে থাকবেন, কী খাবেন এসব বিবেচনায় খরচ ওঠানামা করে। অনলাইনে আগে থেকে বুক না করে ওখানে পৌঁছে বুক করলে খরচ কিছুটা কমবে। আর যদি নিজেদের সংখ্যাটা ৫-৭ এর মধ্যে হয় তবে নিজেরাই গ্রুপ করে আয়োজন করতে পারবেন।
কেনিয়ার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে বাংলাদেশিরা কেনিয়াতে অন এরাইভাল ভিসার সুবিধা পান। নাইরোবিতে পৌঁছে আপনি ৫০ ডলারের বিনিময়ে ১ মাসের ভিসা পেয়ে যাবেন। আর যদি মনে করেন প্রতিবেশি ১/২টি দেশও ঘুরে আসবেন সেক্ষেত্রে ১০০ ডলার ইস্ট আফ্রিকান ভিসা নিয়ে নিতে পারেন। এ ভিসার মেয়াদ থাকবে ৯০ দিন, আর যতবার ইচ্ছে রুয়ান্ডা, উগান্ডা ও কেনিয়াতে ঢুকতে বেরোতে পারবেন।
ফিচার ইমেজ: masaimara.com