সনাতন ধর্মে মনসা লৌকিক সর্পদেবী। তাঁর পূজা প্রধানত বাংলা ও উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে প্রচলিত। বঙ্গদেশে পুরনো মনসা মন্দির খুঁজে পাওয়া এখন দুুর্লভ ব্যাপার স্যাপার। নেট ঘাটতে ঘাটতে এই রকম একটা মনসা মন্দিরের সন্ধান পেলাম শরীয়তপুর পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের ধানুকা গ্রামে। ময়ূর ভট্টের মনসা বাড়ী বা ধানুকা মনসা বাড়ী হিসেবেই এটি মানুষের কাছে বেশি পরিচিত। নতুন জায়গা, হাতে তেমন তথ্য নেই। তাই বলে কী পথিক বসে থাকবে? কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হয়ে গেলাম অজানার উদ্দেশ্যে। বাড়ী আমার মুন্সীগঞ্জ, তাই মাটির টানে জানি পদ্মার ওপারে শরীয়তপুর।
যথারীতি মাওয়া ঘাট থেকে ছোট লঞ্চে উঠলাম। উত্তাল পদ্মার বাতাস খেতে খেতে চলে আসলাম মাঝির ঘাট। এখান থেকে অটো রিক্সা ঠিক করলাম সারা দিন ঘোরার জন্য। লিস্টে আর কিছু স্থাপনা আছে তবে ৬০০ বছরের পুরনো এই মন্দিরটিই চুম্বকের মতো আর্কষিত করছে। রিক্সাওয়ালা মামাও ভালো কিসিমের মানুষ। উনি বেশ অবাক এত জায়গা থাকতে শরীয়তপুর এসেছি এই মন্দির দেখতে। যথারীতি চলে আসলাম সদরে, তিনু মাস্টারের বাড়ী খুজে পেতেও কষ্ট হলো না। কিন্তু মন্দিরগুলো দেখার পর বেশ হতাশ হলাম।

ছবি – আশিক সারওয়ার
৬০০ বছরের পুরনো স্থাপনা অযত্নে অবহেলায় প্রায় ধ্বংসের পথে। দূর থেকে কিচির মিচির শব্দে মনে করেছিলাম পাখি ডাকছে। পরে টের পেলাম ইহা ইঁদুরের কিচ কিচ শব্দ। মন্দিরের ভেতরে বিকট গন্ধ। সাপের ভয়ে আর ঢুকলাম না ভেতরে। পুরো কমপ্লেক্সে পুরানো ৫টি স্থাপনা আছে। বেশির ভাগই সুলতানী মোগল আমলে তৈরি। এই স্থাপনা পাঁচটি যথাক্রমে ছিল দুর্গা মন্দির, মনসা মন্দির, কালি মন্দির, নহবতখানা ও আবাসিক ভবন। প্রাচীনকালে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই বাড়ীতে মনসা দেবীর পূজো করতে আসতো বলে ময়ূর ভট্টের এই বাড়ী মনসা বাড়ী হিসাবে চারদিকে প্রচারিত হয়।
এই বাড়ীর নাম মনসা বাড়ী নামকরনেরও একটি লোক শ্রুতি আছে। এই বাড়ীর এক কিশোর বাগানে ফুল কুড়াতে গিয়ে একটি বিরাট বড় সাপ দেখতে পায়। পর পর তিন দিন দেখার পর চর্তুথ দিন সাপটি কিশোরের পিছে পিছে বাড়ীর আঙিনায় এসে নৃত্য শুরু করে। ভট্টবাড়ীর লোকজন ভয় ও বিস্ময়ে বিষয়টি প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। রাতে মনসা দেবী স্বপ্নে নিজের দর্শন দিয়ে নতুন করে মনসা মন্দির স্থাপন করে তার পূজো করার নির্দেশ দেন। তখন থেকে এই বাড়ীর নামকরণ করা হয় মনসা বাড়ী।

ছবি – আশিক সারওয়ার
গল্পের শুরুতেই ময়ূর ভট্টের নাম এসেছে। মনসা বাড়ীর পূর্ব পুরুষের ইতিহাসও কিন্তু বেশ ইন্টারেস্টিং। অনেকটা কল্পনা আর মিথের মিশেল। মিথ শুনতে সব সময়ই ভাল লাগে, যদি না সেটা ইতিহাসের সাথে সাংঘার্ষিক হয়। কিংবদন্তি বলে, তৎকালীন সময়ে ভারতের কৌনজ রাজ্য থেকে ভট্টাচার্য নামক এক বিত্তশালী পরিবার এই ধানুকা গ্রামে প্রবেশ করে৷ এত দূর থেকে কেন এই অঞ্চলে এসে বসতি গড়েছিল তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদেরই উত্তর পুরুষ ময়ূর ভট্ট।
ময়ূর ভট্ট যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন তখন তার বাবা মা তীর্থের জন্য কাশি’র উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তখন নদীর গতিপথ পরিবর্তন না হওয়ায় এই শরীয়তপুর প্রাচীন বিক্রমপুরের একটি অংশ ছিল৷ কবি কালিদাশ তার ‘রঘুবানসা’ গ্রন্থে এই অঞ্চলকে গঙ্গানদীর প্রবাহের দ্বীপ দেশ বলে আখ্যায়িত করেন।

ছবি – আশিক সারওয়ার
এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার সাথে নৌকা বেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের বর্তমান সময়ের মতো ছিল না৷ দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা পথে এক বনের ধারে এসে ভট্ট মাতার প্রসব বেদনা উঠলো। বনের ধারেই জন্মগ্রহণ করলো একটি ফুটফুটে দেব শিশু। তাহার মাতা পিতা ধর্ম ও দেবতাদের গুরত্ব দিয়ে একটি শাল পাতায় তাদের সন্তানকে আচ্ছাদিত করে কাশির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। কাশী পৌঁছে তারা দেবতার উদ্দেশ্যে পূজো দিলেন।
সে দিন রাতেই তারা স্বপ্নে দেব-দর্শন পেলেন। দেবতারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট নয়। তাহারা বিচলিত হয়ে জানতে চাইলো কেন তাদের আরাধনা দেবতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। জবাবে দেবতারা বললো মানুষে জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরে দ্রুত সেই বনের ধারে ফিরে গেলেন। এখানে এসে দেবতার কৃপা দেখে তারা অবাক। এক ঝাক ময়ূর তাদের পাখা মেলে শিশুটিকে আচ্ছাদন করে রেখেছে। ময়ূরের আশ্রয়ে বেঁচে ছিল বলে তার নাম রাখা হলো ময়ূর ভট্ট। তাই অনেক স্থানীয়রা বাড়ীটিকে ময়ূর ভট্টের বাড়ী বলেও চেনে। আর তিনু মাস্টার এই বংশের উত্তর পুরুষ। বর্তমানে মনসা বাড়ীর দেখভাল উনিই করছেন।
মনে খুব আশা নিয়ে তিনু মাস্টারের খোঁজে বাড়ীর অন্দর মহলের এক নারীকে জিজ্ঞেস করলাম। ভাগ্য আমার সহায় ছিল, পেয়ে গেলাম তিনু মাস্টারকে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফিরে যাই সেই ২০১৫ সালে, শীতের কোনো এক সকালে। বসে আছি তিনু মাস্টারের বাড়ীর আঙিনায়। খেজুরের রস আর ভাপা পিঠা খেতে খেতে আলাপ করছি ভট্টদের ইতিহাস নিয়ে৷ নতুন করে তো কিছু জানার নেই। তবে উনি আমাকে পিতলের মনসা মূর্তি দেখালেন। উনার কোন পূর্ব পুরুষদের আমলে মূর্তিটি হারিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু অলৌকিক ভাবে জেলেরা মাছ ধরার সময় কীর্তিনাশা নদী থেকে মূর্তিটি উদ্ধার করে। তারা এই মূর্তিটি পুনরায় মনসায় বাড়ীতে ফিরত দিয়ে যায়৷
পাঠক আপনাদের মনে প্রশ্নের পাক খেতে পারে এই কীর্তিনাশা নদীটি আবার কোথায়৷ কীর্তিপাশা জমিদার বাড়ীর আশেপাশে কি? তা নয়। পদ্মার অপর নাম যে কীর্তিনাশা। জেনে রাখুন, বিসিএস পরীক্ষায় কাজে আসবে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ভাষা সৈনিক ও জেলার ইতিহাস গবেষক মাস্টার জালাল উদ্দিন আহম্মেদ ঐতিহাসিক এ বাড়ি থেকে কাঠের বাঁধাই করা ও তুলট কাগজে লিখিত পুঁথি উদ্ধার করেন। যার কয়েকটি কপি নেপালে পাঠানো হয়। আজও বেশ কয়েকটি কপি এখনো শরীয়তপুর জেলার বেসরকারি পাবলিক লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে।

ছবি – আশিক সারওয়ার
আপনারা যারা মাওয়া ঘাটে ইলিশ মাছ খেতে আসেন সময় পেলে চলে যেতে পারেন এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটা দেখতে। এছাড়াও শরীয়তপুরের আশেপাশের উপজেলায় বেশ কিছু পুরনো স্থাপনা আছে, রুদ্রকর মঠ, বুড়ীর হাট মসজিদ এর মধ্যে অন্যতম। গল্পে গল্পে ফেরার সময় হয়ে গেল৷ ৭নং ওয়ার্ডের এই ধানুকা গ্রাম স্মৃতি পটে সুখের হরমোন তৈরি করে নিল। যা এত বছর পরেও এন্ডোরফিনের কাজ করছে। ৬০০ বছরের প্রাচীন ধানুকা মনসাবাড়ী আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজও ধুঁকে ধুঁকে ডাকে ইতিহাস পিপাসুদের৷ তোমরা কি শুনতে পাও সেই ইতিহাসের ডাক?
ভালো লাগলো।