ধরুন মানালি থেকে রাতের বাসে করে দিল্লি ফিরেছেন। বিকেল, সন্ধ্যা বা পরদিন দিল্লি থেকে ট্রেনে কলকাতা বা অন্য কোনো প্রদেশে যাবেন। হতে পারে একা, গ্রুপের সাথে বা পরিবার নিয়েই। কিন্তু এই মুহূর্তে আপনি হোটেল নিতে চাইছেন না কিছুতেই। বা তেমন বাজেটও নেই যে মাত্র তিন চার ঘণ্টা বা এক বেলার জন্য একটা হোটেল রুম নেবেন শুধু ব্যাগপত্র রাখার জন্য।
হোটেল নেবার তো তেমন প্রশ্নই নেই যদি বিশেষ কোনো কারণ বা কারো কোনো রকম বিশেষ অসুবিধা না থাকে। কারণ আপনি তো এই সময় হোটেলে শুয়ে বসে থেকে সময় নষ্ট করবেন না। দিল্লিতেই কোথাও না কোথাও ঘুরবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। অথবা দিল্লি থেকে ট্রেন বা কারে করে আগ্রা গিয়ে আবার ফিরে এসেই ট্রেন ধরবেন। তাহলে এই লম্বা সময়ের জন্য বিশাল ব্যাকপ্যাক, লাগেজ বা অন্যান্য মালামাল কী করবেন?

লকার রুমের লাগেজের স্তুপ। ছবিঃ লেখক
এটা নিয়ে, এই ব্যাগপত্র আর লাগেজ নিয়ে আমরা কোথাও যেতে বা আসতে নানা রকম বিড়ম্বনায় পড়ে থাকি। আর আজকাল ভারতের নানা প্রান্তে যাবার সময় হলে তো কথাই নেই। কলকাতা গেলেন দুপুরে, আপনার ট্রেন বা প্লেন হয়তো সেই রাতে। হোটেল নিতেও ইচ্ছা করে না পয়সা খরচ করে, আবার ব্যাগপত্র বা লাগেজ হাতে হাতে করে টেনে নিতেও মেজাজ দারুণ খারাপ হয়ে যায়। এমনকি পরিবারের নানা জনের সাথে এই ব্যাগ টানা নিয়েই লেগে যায় খিটিমিটি হয়তো। এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।
এটা হয়, হবেই। কারণ সকল প্লেন আর ট্রেন টিকেট তো আর একদম আপনার আমার মনের মতো কাটায় কাটায় হবে না। হতেই পারে না। আরও যদি করেন একটু কম দামের সুবিধাজনক কোনো বাহন বা শ্রেণীর টিকেট, তাহলে তো কথাই নেই। আপনার মতো না চলে ওদের নির্ধারিত সময়ের কাটা ধরে চলতে হবে আপনাকে। তাহলে এক বেলার জন্য লাগেজের কী হবে? রুম নেয়ার কোনো ইচ্ছাই নেই অযথা পয়সা খরচ করে, আবার টানতেও ইচ্ছা করছে না একেবারেই। দারুণ একটা বিড়ম্বনায় পড়ে যাই আমরা অনেকেই।

লকার রুমের সিরিয়াল দিল্লী স্টেশনে। ছবিঃ সংগ্রহ
আমি বেশ কয়েকবার এই সমস্যায় পড়ে যখন একা একা বা সলো ট্র্যাভেল শুরু করলাম তখন এই ব্যাগ নিয়ে ঝামেলা মুক্ত থাকার উপায় খুঁজে বের করলাম। প্রথমে কলকাতার হাওড়া স্টেশনে, পরে কেরালায়, তারপরে ব্যাঙ্গালুরুতে, এরপর দিল্লী, গোয়া, জয়পুরসহ প্রায় সব স্টেশনেই। আর তারপর থেকেই আমার আর আমাদের বেড়ানোর ব্যাগ টানার কষ্ট অনেকটাই কমে গেছে। কমে গেছে অযথা হোটেলের খরচ, কমে গেছে খিটমিটি, মনোমালিন্য, বেড়েছে হৃদ্যতা, পাওয়া গেছে বেশী ঘুরে দেখার সময় আর পেয়েছি দারুণ প্রশান্তির উপায়।
লকার রুম। হ্যাঁ, স্টেশনের লকার রুম আমাদেরকে দিয়েছে এই পরম প্রশান্তির উপায় আর সেটাও নিতান্তই অল্প খরচে। মাত্র ২০-২৫ রুপী দিতে হয় একটি ব্যাগ ২৪ ঘণ্টা লকার রুমে রাখার জন্য ছোট বা মাঝারি ধরনের ব্যাগের ক্ষেত্রে। এরপর থেকে আমরা কোথাও যাবার সময় কলকাতা পৌঁছে শিয়ালদহ বা হাওড়া যে স্টেশন থেকে আমাদের ট্রেন ছাড়বে, সোজা সেখানে চলে যাই। লকারে ব্যাগপত্র রেখে দিয়ে ফাঁকা হাতে আরাম করে বেরিয়ে পড়ি শহরে অন্যান্য কাজগুলো সেরে ফেলতে, এক্সচেঞ্জ করতে বা আরও যদি কোনো কাজকর্ম থাকে সেগুলো শেষ করে স্টেশনে ফিরে ফ্রেশ হয়ে তারপরে ব্যাগপত্র লকার থেকে তুলে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসি।

লাগেজ রাখার ক্যাবিনেট। ছবিঃ লেখক
ঠিক একই কাজ করি দিল্লীতে যদি ট্রেন ট্রানজিট থাকে। মানে দিল্লী নেমেছি বা দিল্লী থেকে কোথাও যাবো ট্রেনে এমন সব ক্ষেত্রে। এবার জয়পুর থেকে দিল্লী ফিরেও সেটাই করেছি। জয়পুর থেকে দিল্লী ট্রেন থেকে নেমেছি সকাল ৬:৩০ এ। আমাদের কলকাতার ট্রেন সেই বিকেল প্রায় ৫টায়। হোটেল নিয়ে হাজার খানেক টাকা খরচ করার পক্ষে কেউই নই। সেই টাকায় দিব্বি দিল্লী ঘুরে, খেয়ে দেয়ে ট্রেনে ওঠা যাবে।
যে কারণে আমরা দিল্লী স্টেশনের লকার রুমে সবার ব্যাগপত্র বা লাগেজ রেখে চলে গিয়েছিলাম প্রায় সারাদিনের জন্য। সারাদিন আরাম করে ঘুরে ঘুরে, খেয়ে, কেনাকাটা করে স্টেশনে এসে ফ্রেশ রুমে ফ্রেশ হয়ে আরাম করে গোসল সেরে ব্যাগপত্র লকার থেকে নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম। ব্যাগ প্রতি মাত্র ২০ রুপির বিনিময়ে পেয়েছিলাম এই আরাম, এই স্বাধীনতা আর খিটমিটহীন বেড়াতে পারার আনন্দ। ব্যাগ টানার উটকো ঝামেলা থেকে পেয়েছিলাম মুক্তির স্বাদ।

সময় ও আকার ভেদে মূল্য তালিকা। ছবিঃ সংগ্রহ
আহ যে কোনো চাপ থেকে মুক্তি জিনিসটা সব সময়ই দারুণ আরামের আর উপভোগের। সেটা স্বীকার করি আর নাই করি। মন তো জানে।
তবে হ্যাঁ লকারে ব্যাগ রাখতে হলে যে ব্যাপারগুলো মাথায় রাখতে হবে সেগুলো হলো- যে স্টেশনের লকারে ব্যাগ রাখবেন সেই স্টেশন থেকে কোথাও যাবার ট্রেন টিকেট থাকতে হবে। লাগবে আপনার পরিচয়পত্রের কপি বা পাসপোর্ট ( বিদেশীদের জন্য)। থাকতে হবে ব্যাগে নিজের লক করা বা তালা লাগানো, যেটা চাবি দিয়ে খুলতে হবে। পূরণ করতে হবে একটা নির্ধারিত ফর্ম। নাম, পাসপোর্ট নাম্বার আর টিকেটের পিএনআর নাম্বার দিয়ে। ব্যাগে লিখতে হবে একটা কোড, যেটা ফরমে থাকে। একটা কপি নিজের কাছে আর একটা কপি যে ব্যাগ রাখবেন তার সাথে। ব্যস, হয়ে গেল কাজ। এবার ব্যাগ রেখে বেরিয়ে যান মুক্তির স্বাদ নিতে, ফাঁকা হাতে ঘুরে বেড়াতে। আর বেড়ানো শেষ হলে ২৪ ঘণ্টা বা এর কম সময়ের জন্য ২০ বা ২৫ রুপী দিয়ে নিজের ব্যাগ তুলে নিন নিজের কাছে রেখে দেয়া রশিদ জমা দিয়ে।

সংগৃহীত ছবি
এবার অনেক সমালোচক প্রশ্ন করবেন জানি। ভাই, এই যে লকারের তথ্যটা তো আপনি এক বা দুই লাইনেই দিয়ে দিতে পারতেন, এতো ত্যানা পেঁচাইলেন ক্যান ভাই? এত কিছু পড়ার টাইম নাই। ধুর খালি সময় নষ্ট হইলো। জ্বী ভাই, যারা এই প্রশ্ন করবেন এই লেখা তাদের জন্য নয়। কারণ আমরা কোনো কিছু নিজেদের হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি না করলে বা নিজের জীবনের সাথে না ঘটলে সেটার মর্ম বুঝি না।
তাই এইভাবে নানা আঙ্গিকে, নিজেদের কয়েকটি অভিজ্ঞতার কথা ভাগাভাগি করে বলার চেষ্টা করলাম। কারণ এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই পড়েন জানি, কেউ ধরে বা বুঝিয়ে দেয়নি বলে উপলব্ধি করতে পারি না। তাই নিজের কিছু উদাহরণ দিয়ে এত বিশাল রচনা লিখলাম শুধু লকার রুমের সুবিধা নিয়ে।
Pingback:স্টেশনের লকার রুম, খুচরো ভ্রমণের স্বস্তি - Neo Travel