আমাদের ডুয়ার্স ভ্রমণে লাটাগুড়ির সোনার বাংলা রিসোর্ট, ঘন অরণ্য, রাস্তার দুইপাশে সবুজের সমুদ্র, নীরবতা সবকিছু এতই ভালো লেগেছে আর স্পর্শ করেছে যে, ইচ্ছে হচ্ছিল পুরো ট্রিপের সবসময় বা সব দিনগুলোই এই নির্জনতায় কাটিয়ে দেই। কিন্তু অন্যান্য ভ্রমণসঙ্গীরা পরদিনই দার্জিলিং যেতে চান। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক, কারণ তাদের কেউই আগে দার্জিলিং যায়নি। আমি তো বহুবার গিয়েছি, তাই তাড়না কম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল লাটাগুড়ি বা ডুয়ার্স থেকে দার্জিলিং যেতে হলে অবশ্যই প্রথমে শিলিগুড়ি যেতে হবে, তারপর দার্জিলিং। সেক্ষেত্রে লাটাগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি রিজার্ভ ট্যাক্সি বা জীপ ভাড়া পড়বে অন্তত ৩,০০০ রুপী। কারণ যেখানেই জীপ নেয়া হোক না কেন, যাওয়া আর আসার ভাড়া দিতে হয়। এটাই নিয়ম, তাতে আপনি ফিরে আসেন বা নেমে যান। কীভাবে আর একটু কমানো যায়, যাবার ভাড়া সেটা ভাবতে আর নিস্তব্ধ রাতে লাটাগুড়ি বাজারের ছোট্ট হোটেলে একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালো, ট্রেনে চলে যান না কেন?
ট্রেনে? শুনেই তো আমি চমকিত। এখান থেকে যদি শিলিগুড়ি ট্রেনে যাওয়া যায় তবে তো সেটা দুর্দান্ত হবার কথা। বেশ ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলো, এই বাজারের একটু সামনে গেলেই হাতের বামে একটি রাস্তা ধরে ২-৩ মিনিট হাঁটলেই ট্রেন স্টেশন। লাটাগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি ভাড়া মাত্র ২০ রুপী জনপ্রতি। ওয়াও আর পায় কে? ঠিক করা হলো পরদিন সকালে উঠেই সবাই মিলে ব্যাগপত্র নিয়ে লাটাগুড়ি স্টেশনে চলে যাবো। পাছে আবার বনগাঁ লোকালের মতো সিট নিয়ে ধস্তাধস্তি করতে হয়।
পরদিন সকালে, শিশির মেখে আর কুয়াশা জড়িয়ে, অটোতে করে লাটাগুড়ি স্টেশনে গিয়ে পৌঁছালাম। গিয়ে দেখি একই অবস্থা, বিশাল একটা স্টেশনের পুরোটা জুড়ে শুধু আমরা কজনাই মাত্র যাত্রী। বাহ, ভীষণ প্রিয় ট্রেন ভ্রমণে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম, যে এত বড় একটা স্টেশনে আমরা ছাড়া আর কোনো যাত্রী নেই। ট্রেনের সময় হতে ঢের দেরি আছে, তার উপর খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রায় ৩০ মিনিট দেরিতে ট্রেন আসবে, তার মানে সকাল ৯:১০ এর ট্রেন আসবে সকাল ৯:৪০ এ। আর তখন মাত্র ৮:৩০ বাজে। তার মানে হাতে পুরো এক ঘণ্টা সময়।
উহ এমন অরণ্যের মাঝে, এত অপূর্ব একটা স্টেশনে, অসাধারণ একটা সকাল একদম মনের মতো কাটানোর সুযোগ দ্বিতীয়বার পাবো কিনা কে জানে? তাই তারিয়ে তারিয়ে, সবাই মিলে দারুণ একটা ঘণ্টা কাটালাম, লাটাগুড়ি স্টেশনের মাধুর্যতায়। দুইপাশের অরণ্যের শেষে কিছুটা বসত বাড়ির লোকালয়। সবুজে আচ্ছাদিত স্টেশনে প্রথমে মনের সুখে চলল ফটো সেশন। এঁকেবেঁকে, হেলে-দুলে, হেঁটে-বসে, সোজা হয়ে, হেলান দিয়ে, ইটের সাথে পাথরের মাঝে, লোহার ভাঁজে ভাঁজে আর সবুজের ফাঁকে ফাঁকে। তবুও যেন ছবি তোলার সাধ মেটে না কারো।
তোমরা ছবি তোল ভাই, আমি চললাম, নিজের মতো করে ফাঁকা স্টেশনের দুইপ্রান্ত দেখে নিতে। স্টেশনের দুইপ্রান্তের যতদূর চোখ যায় সোজা রেল লাইন চলে গেছে একপাশে ডুয়ার্সের জঙ্গলের ভেতরে আর অন্যপাশে জলপাইগুড়ি চা বাগানের বুক চিরে। ঝকঝকে লাল-হলুদ স্টেশনের মাঝখান থেকে হাঁটা শুরু করলাম যেদিকে সোজা রেললাইন, বেঁকে ঢুকে গেছে ডুয়ার্সের জঙ্গলের ভেতরে। এত বড় আর একই সাথে এমন নির্জন স্টেশন এর আগে আর কখনো চোখে পড়েনি।
দুইপাশের অল্প বসতির লোকালয়ের সবুজের মাঝ থেকে প্রথমবার সূর্য চোখ মেলে তাকালো। হিম শীতে এমন রোদের পরশ দারুণ একটা আরামের অনুভূতি দিল। এবং সেই সাথে প্রথমবারের মতো মনে হল, আরে সকালে তো কিছুই খাওয়া হয়নি। এই কথা মনে পড়তেই ক্ষুধা যেন পাগল করে তুলল প্রায়। ফিরতি পথ ধরে প্রায় ছুটে গেলাম, অন্যদের কাছে আর স্টেশনের মাঝখানে যেখানে সবাই বসে আছে। দেখি কিছু চা-বিস্কিট পাওয়া যায় কিনা?
চারদিকে চোখ বুলিয়ে আবারো অবাক হলাম যে এটাই বোধহয় নিয়মিত ট্রেন চলে এমন একমাত্র স্টেশন যেখানে একটি চায়ের দোকান পর্যন্ত নেই। এমনটাও আগে কখনো দেখিনি। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দুই একটি ছোট দোকান থেকে বিস্কিট, কেক, আমুল আর জুস নিয়ে ফিরে এলাম। ততক্ষণে ট্রেনের টিকেট বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। সবাই মিলে টিকেট কেটে নিলাম। এরপর আবারো স্টেশনে হেঁটে বেড়াতে শুরু করে এক প্রান্তের প্রায় শেষ অরণ্যের দিকে যেতে যেতেই ট্রেন আসার ঘণ্টা বেজে উঠলো।
আর জেনে অবাক হলাম যে আসলেই এই স্টেশনে এই রকম দুই একটা ট্রেন ছাড়া আর কোনো ট্রেন আসে না বা যায় না কোথাও। সে কারণেই এখানে তেমন কোনো দোকান বা চায়ের স্টল গড়ে ওঠেনি। ভারতের একদম শেষ প্রান্তে বলে দূরপাল্লার কোনো ট্রেনের যাওয়া বা আসার প্রশ্নই তাই নেই। যে কারণেই এই লাটাগুড়ি স্টেশন সব সময়ই এমন নীরব, নিস্তব্ধ আর নিঃসঙ্গ, তবে আমাদের মতো সাময়িক ঘুরে বেড়ানো মানুষের কাছে দারুণ উপভোগ্য।
স্টেশনের শেষে আর অরণ্যের শুরুতে লাল লাইট জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকা সিগন্যাল হলুদ হয়ে জানিয়ে দিল, তোমাকে এখন পিছনে ফিরে যেতে হবে। ট্রেন আসছে। দ্রুত পেছনে ফেরার আগেই হলুদ আলো, সবুজ হয়ে গিয়ে আমাকে পিছনের পথে ফিরে আসতে বাধ্য করেছিল। স্টেশনের মাঝে ফিরে আসতে আসতেই ট্রেন চলে এলো। ব্যাগপত্র নিয়ে উঠে পরে আরও অবাক হয়ে গেলাম যে ফাঁকা প্লাটফর্মের মত ট্রেনটাও একদম ফাঁকা বলা চলে। আর আমরা যে কামরায় উঠলাম সেটা যেন আরও ফাঁকা। এতটাই ফাঁকা যে কে কোন সিটে বসবে সেটা নিয়েই ভাবনায় পড়েগেলাম। একবার এখানে, তো আর একবার ওখানে ছুটতে লাগলাম সবাই মিলে। বসেই যেন সাধ মেটে না।
কয়েক মিনিট পরেই ট্রেন দুলে উঠলো, ইঞ্জিনে ঝিকঝিক শব্দ তুলে ট্রেনকে ধীর লয়ে সামনে টেনে নিতে লাগলো, ফাঁকা স্টেশন থেকে ঘন অরণ্যের মাঝে। দূরে সরে যাওয়া লাটাগুড়ি স্টেশন, বসার জন্য নিঃসঙ্গ বেঞ্চি, কাছে দূরের ছোট্ট দোকান, স্টেশনের লাল-হলুদ বর্ণীলতা, পাখির কিচিরমিচির, আবেশে জড়ানো নিস্তব্ধতা যেন আমাকে ঘিরে ধরে রাখতে চাইছিল। কিছুতেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না এমন অসম্ভব ভালো লাগার নীরব আর নির্জন নিস্তব্ধতা ছেড়ে অন্য কোথাও।
দূরে সরে যাওয়া অপরূপ স্টেশনে দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই গেয়ে উঠেছিলাম-
যদি আর একটু সময় পেতাম,
পাশে থাকবার, কাছে ডাকবার, ছুঁয়ে থাকবার…
ফিচার ইমেজ- লেখক
Latagudi Bangladesh theke ki babe jate habe
ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি, শিলিগুড়ি থেকে লাটাগুড়ি