একটি দেশের সমৃদ্ধির অনেকখানি নির্ভর করে সেই দেশের সঠিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের যথাযথ সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেগুলো আকর্ষণীয় করে তুলে ধরার উপরে। ইতিহাস আর ঐতিহ্য সঠিক ও আকর্ষণীয়ভাবে একটি প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারলে সেই প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবে।
এভাবে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের মাঝে সেই দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি জানার, দেখার আর উপলব্ধি করার আগ্রহ ও আকর্ষণ তৈরি হবে। যেটা এক সময় সেই দেশের আদি ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি নানাভাবে সে দেশের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।

এর মধ্যে অন্যতম হলো সঠিক ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরে সে দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো। যেটা আমাদের পাশের দেশ ভারত খুব ভালোভাবে করছে। আর তাদের সেসব ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি উপভোগ করতে শুধু তাদের দেশের বর্তমান প্রজন্মই নয়, সারা বিশ্ব থেকে তরুণরা ছুটে আসছে প্রতিদিন।
যেটা তাদের সেসব ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি সংরক্ষণের পাশপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, সর্বোপরি সমৃদ্ধিতে কী দারুণ প্রভাব ফেলছে, সেটা আমরা যারা ভারতের নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে যাই, তারা সবাই জানি, হয়তো সেভাবে ভেবে দেখিনি। আজ আমাদের তেমন একটি ঐতিহ্য আর সেই ঐতিহ্যকে ঘিরে আমাদের পর্যটনের একটি সম্ভাবনার গল্প বলবো। যেটা খুব বেশী না হলেও, অল্প করে হলেও আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি পর্যটন শিল্পেও দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। তবে এবার গল্পটা বলি।

ফিরছিলাম সব সময়ের প্রিয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কোণা চষে বেড়িয়ে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর একটার মধ্যে রাবি দেখা শেষ করে, হালকা লাঞ্চ করে নওগাঁর দিকে রওনা দিলাম বাসে করে। বাসে ওঠার পরেই মনে হলো, আরে হাতে তো বেশ সময় আছে। তাহলে যদি সম্ভব হয় আর খুব দূরের পথ না হয়, তবে নওগাঁর একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা কুসুম্বা মসজিদ দেখে যাওয়া যায় কিনা?
বাসের হেল্পারকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালো একদম রাস্তার প্রায় কাছেই কুসুম্বা গ্রাম! বাস থেকে নেমে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পেয়ে যাবো কুসুম্বা মসজিদ। তাহলে তো আর কথাই নেই। বলে রাখলাম যেন কুসুম্বা নামিয়ে দেয়। রাজশাহী থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরের কুসুম্বায় নামিয়ে দিল ঠিক এক ঘণ্টা পরে। একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই বামের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলল একটু সামনেই।
মিনিট দুই হাঁটার পরেই গাছের ফাঁকা দিয়ে একটু দূরে বেশ পুরনো গম্বুজ চোখে পড়লো। বুঝতে বাকি রইলো না যে ওটাই সেই ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদের গম্বুজ। যেটার ছবি আমাদের দেশের একটি জাতীয় মুদ্রা পাঁচ টাকার নোটে আছে।

ঠিক পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম মসজিদের কাছে। কী দারুণ পাথরের কারুকাজে মণ্ডিত ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে সমহিমায় দাড়িয়ে থেকে নিজের ঐতিহ্যকে জানানা দিয়ে যাচ্ছে, আফগান শাসক গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহর আমলের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে। সেই সময়ের এই মসজিদ আজও তার আপন মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। পুরো মসজিদটা কালো পাথরের উপরে নানা রকম নকশায় তৈরি।
যার বাঁকানো ছাদ বাংলার কুঁড়ে ঘরের আদলে নির্মিত। সামনে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ আর দক্ষিণ পাশেও রয়েছে পথ যা এখন পাথরের খিলান দিয়ে বন্ধ করা। মসজিদের ছাদে গোলাকার ছয়টি গম্বুজ রয়েছে। কথিত আছে, মসজিদের একটি নির্ধারিত জায়গায় মহিলাদের জন্য রয়েছে নামাজের স্থান।

সবকিছু মিলে দারুণ নান্দনিকতায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে। দেখেই কেমন যেন একটা প্রশান্তিতে মন ভরে উঠবে আপনার। দারুণ একটা তৃপ্তি ছুঁয়ে যাবে আপনাকে। পাশে রয়েছে মুসল্লিদের সব সময়ের জন্য ছায়া দিয়ে যাওয়া এক বিশাল তেঁতুল গাছ, চারপাশে বাগান ছিল বোঝা যায়, যেখানে এখন সংস্কার কাজ চলছে।
মসজিদের সামনে রয়েছে বিশাল পাথরের উঠোন, মুসুল্লিদের বসে বসে সামনের বিশাল দীঘির নরম বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য। সেখানেও নানা রকম সংস্কার কাজ চলমান। চারপাশে তৈরি হয়েছে পায়ে হাঁটার রাস্তা। তবে যদি পাশের দীঘি বা কল থেকে পবিত্র হয়ে নামাজ পড়তে পারেন এক ওয়াক্ত তবে বোধহয় মনের প্রশান্তিটা আরও অনেক বেশী হবে।

তবে মসজিদের পাশপাশি এখানে রয়েছে আরেকটি অপূর্ব আকর্ষণ, সেটা হলো প্রায় ৭৮ বিঘার উপরে তৈরি করা বিশাল এক দীঘি! যার রয়েছে একাধিক শান বাঁধানো ঘাট, টলটলে পানি, চারদিকে সবুজের সমারোহ, নানা রকম মাছ আর দীঘির পাড়ে বসে সময় কাটানোর দারুণ এক বিলাসী আয়োজন। এত কিছু আছে শুধু নেই এই দারুণ ঐতিহ্যের তেমন কোনো সংরক্ষণ, নতুন প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরার কোনো প্রয়াস, না আছে সঠিক কোনো ব্যবস্থাপন।
অথচ এমন বিশাল একটা দীঘিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠতে পারে স্থানীয় একটা অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। ছোট ছোট কটেজ করা যেতে পারে দীঘির চারপাশ ঘিরে, যেখানে দূর-দূরান্তের মানুষজন এসে থেকে যেতে পারে একটি বেলা বা একটি দিন। যার সাথে রয়েছে সেই ষোড়শ শতকের এমন নান্দনিক একটা ঐতিহাসিক স্থাপনা। এমনকি এখানে যাওয়া-আসার যোগাযোগ ব্যবস্থাও যথেষ্ট ভালো। একেবারেই ঝামেলামুক্ত।

তবে এটা ঠিক যেহেতু শুধু কুসুম্বা মসজিদ দেখতে কেউ হয়তো হুট করে আসতে চাইবে না প্রচারণার অভাবে। তবে একই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও অন্যন্য রূপ উপভোগ করার পাশাপাশি দেখে আসতে পারেন ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ আর ৭৮ বিঘার বিশাল দীঘির নান্দনিকতা।
ঢাকা থেকে রাজশাহী অথবা নওগাঁ হয়ে কুসুম্বা যাওয়া যায়। নওগাঁ থেকে দূরত্ব ৩৩ কিলোমিটার আর রাজশাহী থেকে ৫২ কিলোমিটার। হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেখে কুসুম্বা হয়ে নওগাঁ থেকে ঢাকা, অথবা নওগাঁ থেকে পাহাড়পুর বা কুসুম্বা দেখে রাজশাহী হয়ে ফিরতে পারেন ঢাকা বা অন্য কোনো জেলায়। থাকা-খাওয়ার খরচ অন্য যে কোনো জেলা শহরের চেয়ে কম ছাড়া বেশী নয়।