আমরা যারা পরিবার নিয়ে কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় যাই, বিশেষ করে সাথে যদি ছোট স্কুলগামী বাচ্চা থাকে তাদের জন্য একটি অতি আবশ্যকীয় ভ্রমণ বা বিনোদন কেন্দ্র কলকাতার সাইন্স সিটি। এবার প্রথমবার পরিবার নিয়ে তাই শুধু কলকাতাতেই ভ্রমণ করবো বলে ঠিক করেছিলাম।
আর সেই কলকাতা ভ্রমণের আবার অন্যতম একটা জায়গা ছিল পরিবার, বিশেষ করে ছেলেকে নিয়ে সাইন্স সিটি দেখা। ছেলের আবদার অনুযায়ী একটি ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম। ভাগ্য বেশ সুপ্রসন্ন ছিল বলে ট্যাক্সি ড্রাইভার মিটারে যেতেই রাজি হলো দেখে ভ্রমণের শুরুতেই মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠল।
আমাদের ট্যাক্সি চলতে শুরু করল। রোববারের সাপ্তাহিক ছুটির দিনের ফাঁকা কলকাতার ঝকঝকে রাস্তায় সাঁই সাঁই করে। চারদিকের সবুজ, স্নিগ্ধ সকালের ঝিরঝিরে বাতাস, মুক্ত মাঠে কিশোরদের খেলাধুলা, পার্ক স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেডের নীরব নিস্তব্ধতা ভেঙে ছুটে চলছিল আমাদের ট্যাক্সি।
ময়দান, রেসকোর্স, বিদ্যাসাগর সেতু, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ফ্লাইওভারের নানা রকম রোমাঞ্চকর বাঁক পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত সাইন্সসিটির মূল ফটকে। মিটারে ট্যাক্সি ভাড়া উঠেছিল ২৬৮ টাকা (ভারতীয়)। তবে অন্য কোনোদিকে না ঘুরে সরাসরি গেলে ১২০ থেকে ১৫০ টাকায় হয়ে যেত। আর বাসেও যাওয়া যায় ১০ টাকার মধ্যেই।

প্রবেশ মূল্য নিয়ে ভাবনা ছিল কিছুটা সেটা দূর হলো, মূল ফটকের কাছে গিয়ে দেখলাম সবার প্রবেশ ফি একই রকম ৪০ টাকা। বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলাম এ যাত্রাও। ঢুকে পড়লাম মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে, কাঙ্ক্ষিত সাইন্সসিটিতে। ঢুকতেই চোখে পড়লো চারপাশের সবুজের মাঝে মাথা উঁচু করে আছে প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! তবে ইস্পাতের কাঠামোয় তার প্রতিকৃতি। মুগ্ধতার শুরু এখানেই, কী রকম?
এই যে এলাম সাইন্স সিটিতে কিন্তু এ যে দেখছি চারপাশে শুধু সবুজ সবুজ আর প্রকৃতির নির্মল আলিঙ্গন! গাছে গাছে, পাতায় পাতায়, সবুজে-লালে-নীলে-গোলাপি-বেগুনী আর হলুদ ফুলে ফুলে ছেঁয়ে আছে পুরো সাইন্স সিটির যতদূর চোখ যাচ্ছে। সেই অসীম আর নির্মল প্রকৃতির মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে ছোট বড় নানা স্থাপনা, ভীষণ নান্দনিকতায়।
কোথাও থিয়েটার, কোথায় মঞ্চ, কোথাও সৌরজগতে নানা আবিস্কার আর আয়োজন, কোথাও জ্যোতির্বিদ্যার ব্যবচ্ছেদ, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিতের জটিল জটিল সমস্যার নানা উপায়ে সহজ আর উপভোগ্য সব সমাধান, যা আকৃষ্ট করবে যে কাউকেই।

যেমন এই আমার মতো বিজ্ঞানে অজ্ঞকেও মুগ্ধ করেছে বা মুগ্ধ হতে বাধ্যই করেছে। তাহলে ছোটরা আর যাবে কোথায়? ওদের তো পাগল হবার উপক্রম প্রায়। একবার এদিকে দৌড়ায় তো আরেকবার ওইদিকে। একবার উপরে হাঁ করে থাকিয়ে থাকে তো একবার নিচের কোনো রহস্যময় কুয়ার ভেতরে খুঁজে বেড়ায় কোনো নতুন রোমাঞ্চ।
একবার মঙ্গলের গোলাপি আকাশ দেখে মুগ্ধ হয় তো একবার প্লুটোর ক্ষুদ্রতায় নিজেকে মেলায়, সূর্যের সাথে তুলনা করে! মোট কথা এক অদ্ভুত ধাঁধায় পড়ে যায় ওরা। কোনটা নেবে আর কোনটা ছাড়বে? কোথায় আগে যাবে আর কোথায় পরে? ওদের এই শেখার পাগলামি দেখাটাও যে কোনো বাবা-মায়ের জন্য ভীষণ আনন্দের আর প্রাপ্তির বটে।

এ তো গেল স্থাপনার ভেতরে এসি রুমের নানা আকর্ষণের সামান্য কথা। কিন্তু বাইরের সবুজের মাঝে রয়েছে নানা রকম নান্দনিকতার অপূর্ব সম্মিলন। সমস্ত সাইন্স সিটি জুড়েই রয়েছে মিহি সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো।
চাইলেই বসতে পারেন অন্য কোনো কিছুর সাহায্য ছাড়াই। এতটাই পরিস্কার আর ঝকঝকে পুরো এলাকাটা। আর গাছের ছায়ায় ছায়ায় রয়েছে বসার জন্য ছোট ছোট বর্ণিল বেঞ্চি। ছোটদের জন্য রয়েছে দারুণ আকর্ষণের মোনো রেল, মাত্র ১০ টাকার বিনিময়।

আর ছোট বড় সকলের জন্যই সমান আকর্ষণীয় রোপওয়ে তো আছেই বিশেষ আকর্ষণের। এটাতে চড়ে আকাশের মাঝে ভেসে বেড়ানোর লোভ সামলানো মুশকিল যে কারো পক্ষেই। তাই গাছের ছায়ায় ছায়ায়, ঝিরঝিরে বাতাস গায়ে মেখে, হেঁটে হেঁটে পৌঁছালাম প্রায় অর্ধ কিলোমিটার দূরের সাইন্স সিটির শেষ সীমানায়। সবার মতোই মাত্র ৪৬ টাকাতেই টিকেট কাটা গেল জনপ্রতি। টিকেট কেটেই উঠে পড়তে পারেন রোমাঞ্চকর রোপওয়েতে।
সে এক দারুণ রোমাঞ্চ আর নতুন শিহরণ ছিল ভ্রমণের। খোলা আকাশের মাঝে হেলে-দুলে চলছে আমাদের তিন জনের লাল-নীল আর হলুদের মিনি কটেজ। উপরে খোলা নীল আকাশ, এখানে সেখানে ভেসে বেড়ানো গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘেদের ভেলা, মুক্ত বিশুদ্ধ মাতাল বাতাস, পাখিদের গা ঘেঁষে উড়ে চলা, নিচে সমস্ত সাইন্স সিটির সবুজের মাঝে মাঝে জেগে থাকা নানা কাঠামোর আধুনিক স্থাপনার নান্দনিক নিদর্শন। আর চারপাশে পুরো কলকাতা শহরময় পিপীলিকার মতো ছুটে চলা যানবাহন।

প্রায় ১৫ মিনিটের সেই শিহরণ আর নতুন রোমাঞ্চের শেষে যখন নামিয়ে দিল প্রায় প্রবেশমুখে, যেখান দিয়ে বের হতে হবে, ততক্ষণে চৈত্রের খরতাপে সবাই বেশ তৃষ্ণার্ত। বাইরে বা বাজারের যে মূল্য এখানেও সেইসব পণ্যের সেই একই মূল্য! দারুণ কিছু মুহূর্ত সেখানে কাটিয়ে, ঠাণ্ডা পানীয় আর স্ন্যাক্সে ক্লান্তি দূর করে, সর্বপোরি সবুজ শ্যামল নান্দনিকতার সাথে নানা রকম বর্ণিল সব স্থাপনার মাঝে, ঝকঝকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে একটা বেলা কাটিয়ে সবাই সাইন্স সিটি ভ্রমণের পূর্ণতায় পরিপূর্ণ হয়ে।
ঢাকা থেকে কলকাতায় যেতে পারেন বাসে বা ট্রেনে ১,০০০-১,৫০০ টাকা। হোটেল পাবেন ৮০০-১,৫০০ নন এসি ডাবল, আর এসি রুম পাবেন ২,০০০-২,৫০০ টাকায়। আর কলকাতায় খাবার খরচ বেশ কম ৩৫০-৪০০ টাকায় সারাদিন আর রাতের খাবার হয়ে যাবে।