কলকাতাকে বলা হয় সিটি অফ জয়, অর্থাৎ আনন্দ বা উচ্ছ্বাসের শহর। আগে দুবার হিমাচল প্রদেশে পর্বত অভিযানের উদ্দেশ্যে কলকাতা গেলেও শহর কলকাতা আর স্থানীয় বাঙালি, তাদের দৈনন্দিন যাপন প্রক্রিয়ায় কলকাতার সখ্য সম্পর্কে জানার মতো সুযোগ তৈরি হয়ে ওঠেনি। পার্শ্বদেশীয় বাঙালিদের সম্পর্কে জানার ইচ্ছে থেকে আমি কলকাতা যাই তাদের জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা পাবার আশায়।
আর সেই সুবাদেই ফটোগ্রাফার ঈথা চাকমা আমার সফরসঙ্গী হিসেবে যোগ দেন। ভারতীয় বাঙালিদের জীবন যাপন সম্পর্কে জানার পাশাপাশি আমাদের কলকাতা সফরের মূল কারণ থাকে স্ট্রিট ফটোগ্রাফি। পরিকল্পনা মাফিক পহেলা সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখ ভোরে আমরা যশোর থেকে কলকাতার দিকে রওনা হই এবং দুপুর নাগাদ কলকাতা পৌঁছে যাই।
ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতির অনেকাংশে মিল থাকলেও কলকাতার স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হিন্দি, ইংরেজির ব্যবহার বেশী দেখে বেশ অবাকই হয়েছিলাম বটে। তবে কী পড়ে সেটা খুঁজতে গেলে আমাদের মানে বাংলাদেশিদের সাথে বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ, ভারতবর্ষের ইতিহাস, যাপন প্রক্রিয়া, অর্থনীতি, ধর্ম বা সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ সামঞ্জস্য রয়েছে।
আর খাবারের দিকটাও অনেক অংশেই মিলে যায়। এরপর আমি রাস্তায় বের হই তাদের যাপন প্রক্রিয়া দেখা বা বোঝার জন্য। ইন্টারনেট থেকে অল্প কিছু উপাত্ত আর চিত্রের আশ্রয় নিয়ে রাস্তায় আলোকচিত্র বা স্ট্রিট ফটোগ্রাফির জন্য বের হই আমি, আমার সঙ্গী ও কলকাতার স্থানীয় এক বন্ধু।

তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়া প্রথম দিন আমরা এসপ্ল্যানেড, নিউমার্কেট, ইডেন গার্ডেন, রেসকোর্স ও গঙ্গার পাড়ে গিয়ে ছবি তুলি। লোকাল ট্রেনে, বাসে বা ফেরিতে মানুষের তীব্র ভিড় আর ব্যস্ততা চোখে পড়ে শহর কোলকাতার প্রতিটি আলাদা রাস্তায়, গলিতে বা নদীতে। এই গঙ্গা নদী আবার হুগলী রিভার নামে পরিচিত অনেকের কাছে। কলকাতা শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া এই নদী-ই ছিল এই শহরের গোড়া পত্তনের মূলে।
নদীর পশ্চিম দিকটায় রয়েছে হাওড়া জেলা আর হুগলী জেলা। পূর্ব দিক জুড়ে শহর কলকাতা। সব মিলিয়ে কলকাতা শহরের ব্যপ্তি বহুদূর পর্যন্ত। সন্ধ্যা নামার সময়টায় শহর ঘেঁষে গঙ্গার পাড় অসম্ভব সুন্দর রূপ নেয়। বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে আকাশের রঙিন আলো প্রতিফলিত হয় গঙ্গার বিশাল জলরাশিতে। অনেকেই নেমে পড়েন গঙ্গার পবিত্র স্নানে বা প্রার্থনায় দাঁড়িয়ে পড়েন মাতারূপি গঙ্গার হাঁটুজলে। এই স্নান দৃশ্য দেখে নিয়ে আমরাও ঘরে ফিরি সেদিনের মতো।

কলকাতায় দ্বিতীয় দিন, সেদিন খুব ভোরে উঠেই আমরা চলে আসি হাওড়া। এই ভোরের হাওড়া যেন অন্য এক কলকাতা। রাস্তাঘাটগুলো ভরে থাকে শূন্যতার শোকসভায়। আর নদীর ঘাটে শুরু হয় অর্চনা। হাওড়া ব্রিজের পূর্ব পার্শে মল্লিক ঘাট আর মল্লিক ফ্লাওয়ার মার্কেট। অন্যান্য সব কিছুর মতো এখানে বসে পবিত্র সব ফুলের হাট।
সস্তা দামে পূজো বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য অনেকেই দূর দূরান্ত থেকে ফুল কিনতে চলে আসেন সকাল সকাল। এত ব্যস্ততার ভিড়ে ছবি তোলার জন্য অসাধারণ সুযোগ তৈরি হয়, আলো ছায়ায় ভরা এই বিশুদ্ধ ফুলের ছোট নগরীতে।

মল্লিক ঘাট আর মল্লিক ফ্লাওয়ার মার্কেটে ছবি তুলে দুপুর দুটো নাগাদ আমরা ট্রামে চেপে চলে যাই কলেজ স্ট্রিটে। রাস্তার মাঝ দিয়ে চলা ছোট ছোট ট্রেনের মতো বাহনগুলো মনে করিয়ে দেয় জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি, আর ভিড়ে ভরা শহর থেকে অল্প সময়ের জন্য স্বস্তি।
কলেজ স্ট্রীট কলকাতার একটা ঐতিহ্যবাহী এলাকা। এখানে নামার সাথেই চোখে পড়ছিলো এর আদিমতা। পুরনো স্থাপনা, মান্না দে’র কফি হাউস, রাস্তার দুপাশ দিয়ে সারি সারি বইয়ের দোকানগুলো নতুন অভিজ্ঞতা দিচ্ছিলো আমাদের।

কফি হাউস থেক কফি, পাকোড়া, আবার কফি খেয়ে আমরা ছবি তুলতে তুলতে চলে এলাম জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের বেশীরভাগ সময় কেটেছে এই বাড়িতে। এখন বাড়িটিকে করা হয়েছে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে জাদুঘরে ছবি তোলা নিষেধ, কিন্তু বাইরে কুপন কেটে ছবি তোলা যায়।
এ বাড়িতে না ঢুকলে জীবনে এত কম সময়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনলিপি জানতে পারতাম না কখনো। ঘণ্টা তিনেক ধরে জাদুঘরের সব কিছু অবাক হয়ে দেখলাম। এর পর আবার ফিরে এলাম রাস্তায়। রাস্তা থেকেই খেলাম কচুরি, চউমিন, তড়কা। এগুলো কমবেশি সব জায়গায় পাওয়া যায় কলকাতার। সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত লাগছিলো দুজনের। তাই সেদিনের মতো ফিরে গেলাম বন্ধুর বাড়িতে।

০৩/০৯/২০১৮, ভোর ছয়টা। কলকাতায় তৃতীয় দিন। ট্রেনে চাপলাম বাগ বাজারের উদ্দেশ্যে। লক্ষ্য কুমারটুলি। কুমারটুলি হচ্ছে মাটি বা পাথরের মূর্তি গড়ার অন্য ঐতিহাসিক এক এলাকার নাম। এখানে রয়েছে প্রায় তিনশত স্টুডিও। যেখানে দক্ষ কারিগরেরা মমতা দিয়ে প্রতিমা আর দেশী বিদেশী মূর্তি বানিয়ে থাকেন। এখানে গেলে চারদিকে চোখে পড়বে শত সহস্র মূর্তি, কাদামাটির মিশ্রণ আর তাদেরকে, যারা পরম মমতায় দেবতাদের ফুটিয়ে তোলেন হাতে-মাটিতে।
খুব সকাল থেকেই এখানে শুরু হয় প্রতিমা গড়ার কাজ। আর অল্প পরিমাণ টাকা দিয়ে ছবি তোলার একটা পার্মিশন নিয়ে আমরা শুরু করলাম ছবি তোলা।

দুপুরের পর এখানকার রাস্তা থেকেই খুব কম দামে খেয়ে নিলাম ভাত, শুক্তো আর মুরগির তরকারি। এরপর বাগ বাজার গঙ্গার পাড়ে এসে ফেরিতে উঠলাম। এই ফেরিগুলো থেকে দেখা যাবে নদীর দু’পাশের ব্যস্ত কলকাতা। ফেরিতে হাওড়া ঘাটে নেমে ঢুকলাম হাওড়া স্টেশন। ভারতের অন্যতম একটি বড় স্টেশন এটি। আমি এর আগে বহুবার এখানে এলেও সফর সঙ্গী ঈথা দিদিকে ঘুরিয়ে আনলাম।
এরপর আবার ফেরিতে চড়ে চলে এলাম ফেয়ারলি ঘাটে। সেখান থেকে ছবি তুলতে তুলতে আবার পার্কস্ট্রিট এসে কফি-হাউসে গেলাম দ্বিতীয় দিনের মতো। ততক্ষণে শহরের আলো ঢেকে আসছে অন্ধকারে। ছবি তোলা, আড্ডা দেয়ার পুরোনো জায়গাটা আঁচ ফেলবে মনে, কফিতে আঁচ না ফেললেও। কফি-হাউসটা মূলত আড্ডা দেয়ার জন্য জনপ্রিয়, সুন্দর স্বাদের কোনো বিশেষ কফির জন্য নয়।
কলকাতা পৌঁছে চতুর্থ দিন আমরা ইতস্ততভাবে ছদ্দর স্ট্রিট আর ময়দান এলাকা ঘুরেছি। ছদ্দর স্ট্রিট গ্রাফিতির জন্য বেশ বিখ্যাত স্ট্রিট ফটোগ্রাফারদের কাছে। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা থাকে রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, সচেতনতামূলক, বিজ্ঞাপন, ধর্মীয় গোছের মূর্ত বা বিমূর্ত চিত্র। রঙবেরঙের দেয়ালগুলোর দিকে আপনা আপনি ক্যামেরা উঠে যাবে যে কোনো ছবিয়ালের বা চিত্রকরদের মনে ঘটতে পারে ভাবনার উদ্রেক।

বৃষ্টিতে আটকা পড়ে প্রায় সারাদিন আমরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকি এইদিন, কিন্তু বৃষ্টির কলকাতা এক অন্য রূপ নেয়। স্ট্রিট কুইন বলা হলুদ ট্যাক্সিগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়ায় হাতে টানা রিকশাগুলো। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের উচ্ছ্বাসে ভিজতে দেখেই প্রথমবার মনে হয়েছে কেন কলকাতা উচ্ছ্বাসের নগরী। এরপর হাঁটতে হাঁটতে ময়দান পাড়ি দিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে এসে ছবি তুলি।
ময়দানের পাশেই রেসের ঘোড়াগুলো নিয়ে ছোটাছুটি করে ঘোড়ামালিকেরা। আর পাশ দিয়েই বয়ে যায় প্রাচীন নগর কলকাতার সময়, নতুন আর পুরনো মানুষগুলো। সন্ধ্যা নেমে আসলে আমরা ফিরে আসি আশ্রয়ের জায়গাটাতে। রাতের কলকাতা দেখতে দেখতে আমরা ভাবতে থাকি আবার আসব এই উচ্ছ্বাসের শহরে, অন্য কোনো দিনে, অন্য কোনো সময়ে।
পঞ্চম দিন আমরা কলকাতা থেকে বের হয়ে পড়ি যশোরের উদ্দেশ্যে। এই গল্পগুলো আর প্রাণভরা উচ্ছ্বাস নিয়েই শেষ হয় আমাদের সেবারের কলকাতা সফর।
খরচের খসড়া:
কলকাতা পৌঁছে আমরা আমার বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। তাই থাকার খরচ লাগেনি। তবে সারাদিন বাইরে খেয়ে ঘুরে আমাদের দুজনের পাঁচ দিনে টোটাল খরচ হয়েছিল ২,৫০০ রূপির মতো। আমরা মূলত স্ট্রিট ফুড ট্রাই করেছি বেশী। এছাড়া কলকাতায় হোটেলে থাকার খরচ একটু বেশী মনে হয়েছে আমার কাছে সবসময়। গড়পত্তার হোটেলের জন্য ১,২০০ রূপি থেকে খরচ শুরু হয়।
শহরের ভেতর ট্রাম, বাস, ট্রেন, মেট্রো বা ফেরির যাতায়ত খরচ খুবই কম। এটা নির্ভর করে, কে কীভাবে চলতে পারবে তার উপর। ঢাকা-বেনাপোল বাস ভাড়া ৫৫০ টাকা (নন এসি)। পেট্রোপোল–বনগাঁ স্টেশন, অটো ভাড়া ৩০ রূপি। বনগাঁ-শিয়ালদহ স্টেশন ট্রেন ভাড়া ২৫ রূপি। ছবি তোলার জন্য কুপনের মূল্য ১০-২০০ রূপি পর্যন্ত হয়ে থাকে।
স্ট্রিট ফটোগ্রাফিক টিপস:
কলকাতার লোকাল সব বাহনগুলোতে অকল্পনীয় ভিড় থাকে। ক্যামেরা বা ব্যাগেজ সব সময় সাবধানে রাখতে হবে। কলকাতা অনেক বড় শহর। চার পাঁচ দিনে পুরো শহর কাভার করা অসম্ভব পর্যায়ে পড়ে স্ট্রিট ফটোগ্রাফারদের জন্য। তাই সময় নিয়ে যেতে হবে ও পারলে ভালো করে স্ট্যাডি করে যেতে হবে। পরিকল্পনা করে নির্দিষ্ট এলাকা ভিন্ন ভিন্ন দিনে কাভার করার চেষ্টা করলে সুবিধা হবে।
স্থানীয়দের সম্মান করতে হবে। কলকাতা পুলিশ সব কাজে বেশ সাহায্য করে থাকেন। কোনো ব্যাপারে বিভ্রান্ত হলে পুলিশের সাহায্য নেবার চেষ্টা করতে হবে। দরকার হলে অনুমতি নিয়ে ছবি তুলতে হবে ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কুপন কেটে ছবি তুলতে হবে।
কীভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে বেনাপোল বাসে এসে ইমিগ্রেশন শেষ করতে হবে। এর জন্য ভারতীয় যে কোনো পোর্টের ভিসা থাকলেই হবে। ইমিগ্রেশন সেরে ওপারে পেট্রাপোল থেকে সরাসরি কলকাতার বাস পাওয়া যায়। অথবা অটোতে করে বনগাঁ স্টেশনে গিয়ে কলকাতার ট্রেন ধরতে হবে। ফেরার পথেও একই রাস্তা। এছাড়া বিকল্প রাস্তা হিসেবে রয়েছে মৈত্রী এক্সপ্রেস, যা ঢাকা থেকে ছেড়ে যায় কলকাতার উদ্দেশ্যে।