ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় নগর সভ্যতার নিদর্শন বগুড়ার বরেন্দ্রভূমি মহাস্থানগড়ে আবিষ্কার হয়েছে। মহাস্থানগড় প্রাচীন পুণ্ড্রনগরীর বর্তমান নাম যা বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানার অন্তর্গত। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে পুণ্ড্রনগর গড়ে উঠেছিল।
এখানে ৪ হাজার বছরের পুরনো স্থাপনা আছে। শক্তিশালী মৌর্য, গুপ্ত এবং অন্যান্য রাজারা তাদের প্রাদেশিক রাজধানী হিসাবে মহাস্থানগড় ব্যবহার করতেন। পাল রাজাদের মূল রাজধানী হিসেবে পুণ্ড্রনগর ব্যবহৃত হয়েছে। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে অনুমান করা হয়, জনহিতৈষী মৌর্য সম্রাট অশোক পুণ্ড্রনগর শাসন করেছেন।
ব্রাক্ষ্ম লিপিতে পুণ্ড্রনগরে দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের শস্য ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করার আদেশ লিপিবদ্ধ আছে। এ কথাও বলা আছে, সুদিন ফিরে আসলে প্রজাসাধারণ যেন আবার তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেন। এই বিশাল শহরের ধংসস্তুপ করতোয়া নদীর পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত যা শুধু বগুড়া নয় বরং গোটা বাংলাদেশের অতীত ঐতিহ্য ধারণ করে।

প্রায় ২,৪০০ বছর আগে বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে গড়ে ওঠে পুণ্ড্রনগর। অন্যান্য দ্বিতীয় নগরসভ্যতার মতো এটিও একটি সমৃদ্ধ নগর ছিল। তাই সেটি ছিল দুর্গপ্রাচীর ও পরিখা দ্বারা সুরক্ষিত। কালের পরিক্রমায় পুণ্ড্রনগর ধ্বংস হয়ে মাটির নিচে চাপা পড়ে ঢিপি ও জঙ্গলে পরিণত হয়।
দেশপ্রেমিক ফকির মজনু শাহ মহাস্থানগড় জঙ্গল থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করতেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিক আলেকজান্ডার কানিংহাম মহাস্থানগড় জরিপ করে অনুমান করেন এখানকার মাটির নিচে লুকিয়ে আছে বিখ্যাত পুণ্ড্রনগরের ধংসাবশেষ।
শুরু হয় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ। আবিষ্কার হতে থাকে নগরের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, অলংকার, মুদ্রা, পোড়ামাটির শিল্পকর্ম, লিপি প্রভৃতি। ৫-১০ মিটার উঁচু দুর্গপ্রাচীর পরিবেষ্টিত খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের নগরকেন্দ্রটি ছিল উত্তর-দক্ষিণে ১,৫২৩ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১,৩৭১ মিটার।

পুণ্ড্রনগর ছিলো পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী শহর। এর সঙ্গে বাণিজ্যিক কারণে ভারত মহাসাগরের অনেক নগর বন্দরের যোগাযোগ ছিল। ফলে বহু বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেন ঘটেছিল। উর্বর ভূমি ও করতোয়া নদীর মাধ্যমে যোগাযোগের ফলে পুণ্ড্রনগর এলাকায় ঘনবসতি ছিল।
সপ্তম শতকে চীন দেশের পরিব্রাজক ও ধর্মযাজক হিউয়েন সাঙ পুণ্ড্রনগর এলাকায় ২০টি বৌদ্ধবিহার ও ১০০টি ব্রাক্ষ্ম মন্দির দেখেছিলেন। প্রাচীন বৌদ্ধবিহারগুলোকে আধুনিককালের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করা যায়।

কথিত আছে, সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেন (১০৮২-১১২৫) যখন গৌড়ের রাজা ছিলেন তখন এই গড় অরক্ষিত ছিল। মহাস্থানের রাজা ছিলেন নল যার বিরোধ লেগে থাকত তার ভাই নীলের সাথে। এসময় ভারতের দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র নামক স্থান থেকে এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ এখানে অাসেন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে।
কারণ তিনি পরশু বা কুঠার দ্বারা মাতৃহত্যার দায়ে অভিশপ্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই এই দুই ভাইয়ের বিরোধের অবসান ঘটান এবং রাজা হন। এই ব্রাহ্মণের নাম ছিল রাম। ইতিহাসে তিনি পরশুরাম নামে পরিচিত।
দুর্গের অভ্যন্তরে খনন করা টিলাসমূহ হলো-
গোবিন্দ ভিটা
এটি জাদুঘরের উল্টোদিকে অবস্থিত। তৃতীয় থেকে পনেরশো শতাব্দীর মধ্যেকার দুইটি মন্দিরের অবশিষ্ট এখানে আবিষ্কার করা হয়।

তোতারাম পণ্ডিতের ধাপ
এটি পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত। এখানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি বৌদ্ধ বিহারের অবশিষ্টাংশ খুঁজে পাওয়া যায়।
ইস্কান্দারের ধাপ
এটি দুর্গ এলাকার ৩.৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বাঘাপুর গ্রামে রংপুর-বগুড়া মহাসড়কে অবস্থিত। এখানে কার্তিকা নামে একটি কষ্টি পাথরের মূর্তি পাওয়া যায়।
খুলনার ধাপ
চাঁদ সাগরের স্ত্রী খুল্লানার নামে নামকরণ করা এই জায়গাটি দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণে চেঙ্গিসপুর গ্রামে অবস্থিত।

ভীমের জঙ্গল
বগুড়ার উত্তর-পূর্ব থেকে আরম্ভ হয়ে উত্তরে দামুকধারের বিট নামক স্থান পর্যন্ত এই জায়গাটি বিস্তৃত। এই জায়গাটির সাথে সামরিক এলাকার মিল পাওয়া যায় কেননা এখান থেকেই থেকে দেশের পূর্বাংশের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা হতো।
জগির ভবন
এই জায়গাটি ক্ষেতলাল সড়কের ৩ মাইল পশ্চিমে বাগতাহালিতে অবস্থিত। এখানকার পবিত্র স্থানগুলো দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
অররা
এটি মাসান দীঘির ওপরে অররা গ্রামে অবস্থিত।

তেঘর
এটি চাদিনা হাটের উত্তরে অবস্থিত।
রোজাকপুর
গোকুল থেকে পশ্চিমে যাওয়ার পথে আপনাকে হরিপুর গ্রামের পশ্চিম দিয়ে যেতে হবে। রোজাকপুর গ্রাম চাদনিয়া হাটের কাছে বগুড়া ক্ষেতলাল সড়কে, পশ্চিম হরিপুরে এবং সমরাই বিলের পশ্চিমে অবস্থিত।
মাথুরা
এটি পূর্ব বুমানপাড়ায় অবস্থিত যা পূর্ব গড় পর্যন্ত বিস্তৃত। মাথুরা গ্রামটি উত্তরে অবস্থিত।
মহাস্থানগড় জাদুঘর
মহাস্থানগড়ের অভ্যন্তরে এটি একটি ছোট এবং সমৃদ্ধ জাদুঘর। এটির চারপাশটি অনেক সমৃদ্ধ। এখানে হিন্দুদেবতাদের মূর্তি, পোড়ামাটির অলংকার ও থালা বাসন এবং পাল আমলের কিছু তাম্র মূর্তি আছে। এখানকার বাগানটি বেশ আকর্ষণীয়। রবি ও সোমবার সকালে এই জাদুঘরটি বন্ধ থাকে এবং প্রতিদিন দুপুর ১২:৩০ থেকে দুপুর ২:৩০ পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতি। মূল প্রবেশপথটি দুর্গের কাছেই অবস্থিত।

পরশুরামের প্রাসাদ:
এখানে ৩টি আমলের প্রত্নতত্ত্ব রয়েছে।
৮ম শতকের প্রাপ্তির মধ্যে আছে পালা আমলে ভিসনুপাটটার পাথর।
১৫শ-১৬শ শতকের প্রাপ্তির মধ্যে আছে মুসলিম ঐতিহ্যের কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১৮৩৫ থেকে ১৮৫৩ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবহার করা দুইটি মুদ্রা পাওয়া যায়।
কীভাবে যাবেন
প্রথমে আপনাকে ঢাকা থেকে বগুড়া পৌঁছাতে হবে। রাজধানী ঢাকা থেকে বগুড়ার দূরত্ব প্রায় ২১৪ কিলোমিটার। বগুড়া থেকে মহাস্থানগড়ের দূরত্ব ৮.৬ কিলোমিটার। বগুড়া পৌঁছে আপনি এখানে বাস অথবা সিএনজি অটো রিকশায় আসতে পারেন।
বগুড়া বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর। রাজশাহী বিভাগের বগুড়া জেলায় এই শহরটি অবস্থিত। ঢাকা থেকে প্রায় ২২৯ কিলোমিটার দূরে বগুড়া অবস্থিত। আপনি সেখানে বাস এবং ট্রেনে পৌঁছাতে পারেন।

১। টি আর ট্রাভেলসঃ সকাল ৭টা থেকে শুরু করে রাত ১১:৩০ মিনিট পর্যন্ত প্রতি ৩০ মিনিট পরপর এটি বগুড়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ফোনঃ গাবতলি-০১১৯১-৪৯৪৮৬৫, মহাখালি-০১১৯১-৪৯৪৮৬৬
২। শ্যামলী পরিবহনঃ সকাল ৬টা থেকে শুরু করে রাত ১:০০টা পর্যন্ত প্রতি ১ ঘণ্টা পরপর এটি বগুড়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ফোনঃ আসাদ গেইট-০২-৯১২৩৪৭১, কলাবাগান-০১৭১১১৩০৮৬২, সায়েদাবাদ-০১৭১২৫৯৬৯৪০
৩। এস আর ট্রাভেলসঃ সকাল ৭:৩০ মিনিট থেকে শুরু করে রাত ১১:৩০ মিনিট পর্যন্ত প্রতি ৩০ মিনিট পরপর এটি বগুড়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ফোনঃ গাবতলি-০২-৮০১১২২৬, উত্তরা-০১৫৫২৩১৫৩১৮
৪। হানিফ এন্টারপ্রাইজঃ ঢাকা বাস স্ট্যান্ড, ফোনঃ ০৫১-৬০৯৪০, ৬০৮০৩, ০১৯১১-৫৬০৮৮২
কোথায় থাকবেন
বগুড়ায় থাকার ব্যবস্থা বেশ উন্নত। আপনি এখানে চার তারকা হোটেলও পেয়ে যাবেন।
১। হোটেল নাজ গার্ডেন
ঠিকানাঃ সিলিমপুর, বগুড়া-৫৮০০, বাংলাদেশ
ফোনঃ ৮৮-০৫১-৬২৪৬৮, ৬৬৬৫৫, ৬৩২৭২, ৬৪১৯৭, ৭৮০৮৮
২। পর্যটন মোটেল
বনানী মোড়, বগুড়া, ফোনঃ০৫১-৬৬৭৫৩
৩। আকবরিয়া হোটেল
ওয়েব সাইট: http://urbita.com/bangladesh/bogra/akboria-hotel
ঠিকানাঃ কাজী নজরুল ইসলাম রোড, থানারোড, বগুড়া, ফোন: ০১৭১৬-১৭৯৯৮২
বগুড়া শহরের আরও কিছু হোটেলের নাম:
১। হোটেল আল আমিন, নবাববাড়ি রোড
২। মোটেল নর্থ ওয়ে, শেরপুর রোড
৩। হোটেল রয়াল প্যালেস, উপশহর
৪। হোটেল সান ভিউ,শেরপুর রোড
৫। হোটেল সেফওয়ে, শান্তাহার মোড়
৬। হোটেল রাজমনি, বগুড়া রাজা বাজার
১০। হোটেল হানি ডে, বড় মসজিদ লেইন
১১। হোটেল আজিজ, কবি নজরুল ইসলাম রোড
তথ্যসূত্র: ৬ষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বই