মানুষ আমরা, আর মানুষ মাত্রই রোমাঞ্চপ্রিয়। ইট পাথর আর কালো ধোঁয়ার এই শহরে বসবাস করতে করতে মাঝে মাঝেই আমাদের দম বন্ধ হয়ে ওঠে। বিশুদ্ধ অক্সিজেনের খোঁজে আমাদের শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। আমরা ছুটে চলি সবুজের পথে, দেশের আনাচে কানাচে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল যতটাই রুক্ষ, দক্ষিণাঞ্চল ঠিক ততটাই সজীব আর সবুজ। তাই বিশুদ্ধ অক্সিজেনের লোভে ভ্রমণপিপাসুরা সাধারণত দেশের এই অঞ্চলটাকেই বেছে নেন। আর সেই দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি পর্যটক আর রোমাঞ্চকারীদের জন্য এক প্রকার স্বর্গরাজ্য।

আলুটিলা গুহা
মনের পিপাসা মেটাতে ছুটে চলা মানুষের কাছে পাহাড় আর গুহা বরাবরই আকর্ষণীয় স্থান। প্রকৃতির অন্যতম রহস্যময় সৃষ্টি এই গুহা অনেকের কাছেই আবার বেশ ভীতিকর জায়গা। এরকমই একটি রহস্যময় গুহা অবস্থিত খাগড়াছড়ি জেলার আলুটিলা পর্বতের পাদদেশে।

আলুটিলা পাহাড়কে ‘টিলা’ বলা হলেও আদতে এটি একটি পর্বতশ্রেণী যার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,০০০ ফুট। আলুটিলার পূর্বনাম ছিল আরবারী পর্বত।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুর্ভিক্ষের সময় এখানকার স্থানীয়রা এই পর্বত থেকে প্রচুর বুনো আলু সংগ্রহ করত ক্ষুধা নিবারণের জন্য। তখন থেকেই এই পর্বত আলুটিলা নামে পরিচিত হতে শুরু করে। এখনো এখানে প্রচুর পরিমাণে বুনো আলু পাওয়া যায়।

যেভাবে যাবেন
খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে মাটিরাঙ্গা উপজেলার আলুটিলা পর্যটনকেন্দ্রে আলুটিলা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই গুহা। খাগড়াছড়ি সদর থেকে চাঁদের গাড়ি, বাস অথবা সিএনজিতে করে আলুটিলা গুহায় যেতে পারেন।
রিজার্ভ চাঁদের গাড়ি ভাড়া ৮০০-১,০০০। দশ টাকার টিকেট কেটে গেট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে বিশালাকার শতবর্ষী বটগাছ। সেখান থেকে মশাল সংগ্রহ করতে হবে। মশাল মূল্য দশ টাকা।

পুরো খাগড়াছড়ি শহরের এক অদ্ভুত ভিউ দেখতে পাবেন এখানটায়। দৃশ্যগুলো এতটাই চমৎকার এক মুহূর্তের জন্য মনে হবে এটি বাংলাদেশ নয়, ইউরোপের কোনো সুন্দর শহর। আকাশ, পাহাড়, সবুজ আর মেঘ মিলেমিশে অপরূপ চোখ জুড়ানো দৃশ্যের সৃষ্টি করে। সেখান থেকে প্রায় ৩৫০টি সিঁড়িধাপ বেয়ে নিচে নেমে পৌঁছে যাবেন আলুটিলা গুহামুখে।
কিন্তু কিছু বছর পূর্বেও এখানে কোনো সিঁড়িপথ ছিল না তখন সরু পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নেমে গুহা ভ্রমণ করতে হতো। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে বানানো হয়েছে এই সিঁড়িপথ ফলে আলুটিলা গুহা ভ্রমণ অনেকটাই সহজতর হয়ে গেছে।

স্থানীয় আদিবাসীরা এই গুহাকে ‘মাতাই হাকড়’ নামে ডেকে থাকে যার অর্থ দেবতার গুহা। সম্পূর্ণ পাথরের তৈরি প্রাকৃতিক এ গুহাটি খাগড়াছড়ির অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। সূর্যের আলো পৌঁছে না বলে রহস্যে ঘেরা এই গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল। তাই উপর থেকে দশ টাকার বিনিময়ে মশাল কিনে নেয়া আবশ্যক।
তবে ফোনের ফ্লাশ লাইট কিংবা টর্চ লাইটও ব্যবহার করতে পারেন। তবে গুহার আদিম অনুভূতি পেতে হলে মশালের বিকল্প নেই। গুহার পাথুরে তলদেশ ধরে বয়ে গেছে একটি ঝর্ণা। তবে গুহার পাদদেশ একদম পিচ্ছিল নয়। তাই নিরাপদভাবেই প্রকৃতির এই রহস্যময় সৃষ্টি অনুভব করতে পারবেন।

ভূ-গর্ভস্থ টানেলের মতো দেখতে গুহাটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ মিটার। গুহামুখের ব্যাস প্রায় ৫ মিটার। গুহার ভেতরের দেয়াল প্রায় ২ মিটার উঁচু এবং ১ মিটার প্রশস্ত। গুহাটিতে ঢুকতেই গা ছম ছম পরিবেশে এক ভূতুড়ে অনুভূতি অনুভব হবে। শীতল জলের প্রবাহমান পাথুরে মেঝেটি বেশ এবড়োথেবড়ো।
পাথর আর শিলা মাটির ভাঁজে গড়া রহস্যময় সুড়ঙ্গের ভেতর বিশাল বিশাল পাথর আর উঁচুনিচু মেঝে দেখে মনে হবে সিনেমার গুপধন খোঁজার কোনো রোমাঞ্চকর দৃশ্য। কিছুদূর হাঁটার পর গুহার ছাদ এতটাই নিচু হয়ে আসে যে নতজানু হয়ে হাঁটতে হয়। ১০-১৫ মিনিট হাঁটার পর দেখা মিলবে সূর্যের আলোর, পৌঁছে যাবেন গুহাটির অপর প্রান্তে।

গুহামুখের শুরুতে দেখা যায় ঝর্ণায় পানিতে বাঁধ দিয়ে জল জমিয়ে রাখা হয়েছে। স্থানীয়রা এ পানি খাওয়া ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে থাকে। নিচে নামার জন্য অনেক সিঁড়ি পাড়ি দিতে হলে গুহা থেকে পাহাড়ের উপর উঠতে অনেক কম সিঁড়ি পাড়ি দিতে হয়। গুহামুখের শেষপ্রান্তে অনেক ভঙ্গুর পাথর পড়ে থাকতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সাবধানে উপরে উঠে আসতে হবে। নইলে পা পিছলে পড়ে গিয়ে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।

আলুটিলা পাহাড়ের চারপাশের মন জুড়ানো ঘন সবুজের অরণ্যে স্মৃতি সংরক্ষণের কাজ শেষ করে কিছুক্ষণ দিগন্তে চেয়ে বসে বিশ্রাম নিতে পারেন। প্রাণ জুড়ানো দৃশ্যে প্রকৃতির নেশায় পেয়ে যাবে আপনাকে, যে নেশা থেকে বের হওয়া যায় না কখনোই। পাহাড়ের উপর কচি ডাবের পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারেন।
আলুটিলা গুহার পাশেই অবস্থিত প্রকৃতির আরেক অনবদ্য সৃষ্টি রিসাং ঝর্ণা। আছে হর্টিকালচার পার্কের ঝুলন্ত ব্রীজও। চাইলে এগুলোও ঘুরে আসতে পারেন একই দিনে। তবে সাজেকগামী দর্শনার্থীরা সাজেক থেকে ফেরার দিনে বাকেট লিস্টে আলুটিলা গুহাসহ রিসাং ঝর্ণা ও ঝুলন্ত ব্রীজ রাখতে পারেন।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা প্রকৃতির এই অনিন্দ্য সুন্দর গুহাটিকে দিনকে দিন ভ্রমণের অযোগ্য করে তুলছি। নিভে যাওয়া মশালের বাড়তি অংশটুকু ফেলার জন্য গুহার শেষ প্রান্তে নির্দিষ্ট জায়গা থাকলেও পর্যটকরা গুহার ভেতরেই তা ফেলছেন। এতে নষ্ট হচ্ছে আলুটিলা গুহার অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আমাদের সচেতনতাই পারে গুহাটির সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখতে। নিজে সচেতন হন, অন্যকে সচেতন হতে উৎসাহী করুন। হ্যাপী ট্রাভেলিং।