কাজী নজরুল ইসলাম, বাঙালিদের কাছে খুব পরিচিত ও প্রিয় একটি নাম। আমাদের জাতীয় কবির শৈশব কেটেছে এ জেলার ত্রিশাল উপজেলার দরিরামপুর গ্রামে। কবির স্মৃতিবিজড়িত স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সংগ্রহশালা। নজরুল স্কুলজীবনে যে বটতলায় বসে বাঁশি বাজাতেন, তা বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থিত।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ২৩ বছরের সাহিত্য জীবনের একটি বিরাট অংশ ও নিজের বেড়ে ওঠার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল।

তাই ভালুকা এসেই ঠিক করেছিলাম, ময়মনসিংহের আর কোথাও ঘুরতে পারি আর না পারি, ত্রিশালে ঠিক যাব।
তাই-ই করলাম। প্রচণ্ড রোদ মাথার উপরে নিয়ে রওনা করলাম ত্রিশালের উদ্দেশ্যে। ভালুকা থেকে খুব একটা দূরে নয়। তবুও লোকাল বাসে ২৫ টাকা করে ভাড়া নিলো। ত্রিশাল নেমেই দেখি রাস্তার সামনে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় নাম সম্বলিত দুটি স্তম্ভ। ভেবেছিলাম, এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু ভ্যান ভাড়া শুনে আঁতকে উঠলাম।

আমরা চারজনে এসেছিলাম। ভ্যানগাড়ির ভাড়া পড়েছিল ৫০ টাকা। এই রাস্তাটা খুবই সুন্দর। কিছুক্ষণ পর পরই বিশাল বিশাল শিমুল গাছ চোখে পড়ছিল। গাছ ভর্তি আগুনরঙা শিমুল ফুল। আমার ইচ্ছে করছিল, ভ্যান থেকে নেমে শিমুলতলায় গিয়ে ছবি তুলি।
তিন কিলোমিটার পেরিয়ে ভ্যান আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নামিয়ে দিল। ভ্যান থেকে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়লো কবির বিখ্যাত “চল উন্নত মম শির” শিরোনাম সম্বলিত একটা স্মৃতিসৌধ ধরনের স্থাপনা।
এটির সামনে সবুজ ও লালচে গাছ লাগিয়ে বানানো হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা। পাশেই সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে ভাস্কর পলাশ শেখের বানানো জয় বাংলা ভাস্কর্য।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের প্রথম ও একমাত্র সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়। ২৫ একর জমিতে ২০০৭ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন প্রজন্মের কাছে কবিকে তুলে ধরতে এ বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমসহ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা চোখে পড়ার মতো।
ক্যাম্পাস পুরোটা ঘুরে দেখলাম। এক জায়গায় পেলাম “দুখু মিয়া বাংলো”। ক্যাম্পাসের জলাশয়ের পাশ ঘেঁষে আসার সময় পানিতে চোখে পড়লো কোনো এক হিন্দু দেবীমূর্তির অবয়ব। খানিকটা এগিয়ে গেলেই নজরুল মঞ্চ। প্রায়ই এখানে সভা সমাবেশ হয়। আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে সভা চলছিল।

আবার শুরু করলাম পথচলা। খানিক পরেই দেখতে পেলাম বিরাট এক বট গাছ। এই বট গাছের সাথে মিশে আছে কবির স্মৃতি, কবির ভালবাসা। স্কুল পালিয়ে এই বট গাছের নিচে বসে কবি আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলতেন।
এটি এখন নজরুল বট বৃক্ষ। দুই বাংলার নজরুল ভক্তদের কাছে এটি তীর্থস্থান। বট গাছের নিচে প্রায়ই বসে কবিদের আসর। আজ কবি নেই, কিন্তু এই বট গাছটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে কবির অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।
১৯১৪ সালে আসানসোল থেকে ত্রিশালের কাজীর শিমলা গ্রামের দারোগার বাড়িতে নজরুলকে নিয়ে আসেন কাজী রফিজউল্লাহ। কিছুদিন পর নজরুল জায়গির হিসেবে চলে যান একই উপজেলার বিচুতিয়া ব্যাপারী বাড়িতে। পাশের গ্রাম নামাপাড়ায় বিশাল বটতলায় বাজতো কবির বাঁশি।

বিচুতিয়া বেপারী বাড়ির আঙিনায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র ও নজরুল আর্কাইভ। বিচুতিয়া বেপারীর যে ঘরে নজরুল থাকতেন সেই শোবার ঘরটির মেঝে পাকা করে ওখানে স্থাপন করা হয়েছে নজরুল আর্কাইভ।
স্মৃতিকেন্দ্রের নিচতলায় রয়েছে ২০০ আসনের অডিটরিয়াম, দ্বিতীয় তলায় অফিস এবং তৃতীয় তলায় জাদুঘর-কাম-পাঠাগার, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে।
আঙিনায় স্থাপিত হয়েছে দুটি ‘নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র’। ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রথম কেন্দ্রটি এখন ধ্বংসের মুখে। নতুন করে ২০০৮ সালে নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে এটি। স্মৃতিকেন্দ্রের নীচ তলায় সম্মেলন কেন্দ্র। দু-তলায় রয়েছে কবির হাতে লেখা কবিতা, গান ও চিঠি রয়েছে। পাঠাগারে আছে প্রায় ১,৪০০ বইয়ের সংগ্রহ।
যেখানে বেশির ভাগই কবির লেখা বই ও ডায়েরি। এছাড়াও রয়েছে কবি নজরুলের বিরল সব ছবি, তার ব্যবহৃত পালঙ্ক ও গ্রামোফোন রেকর্ড সংরক্ষণ। ত্রিশালেই আছে দারোগাবাড়ি ও কবির স্কুল পালানো দিনগুলোর সেই স্কুল।

টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরি ঘরটি নজরুল গবেষণার জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। এখানকার নজরুল উদ্যানে কবির লেখা কবিতা, গান ও কাব্যে স্থান পাওয়া বিভিন্ন বৃক্ষরাজি দেশবরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, শিল্পী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে রোপণকৃত।
কেন্দ্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হওয়ার কারণে প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী আসে। গবেষণার উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত। দর্শনার্থীদের বিনোদন, বসার জায়গা ও লোকবল বাড়ানো উচিৎ এখানে। কথা বলে জানতে পারি এখানে মোট ১৮টি পদ রয়েছে কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৪ জন রয়েছে দেখাশোনার জন্য! অপ্রতুল লোকবল।
সঠিক পরিচর্চা না করলে এটি দর্শনার্থীদের টানতে পারবে না, আর নজরুলের আর্দশ, শিল্প সাহিত্যের সাথে পরিচয়ে সফল হবে না। আশা নিয়ে এসেও নিরাশায় ফিরে যেতে হবে নজরুল পিয়াসীদের।

কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ কি.মি দূরে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। ময়মনসিংহগামী যেকোনো বাসে উঠে নামবেন ত্রিশালে। ভাড়া পড়বে গাড়িভেদে ১৩০-২০০ টাকা পর্যন্ত। ত্রিশালে বাস থেকে নেমে, দুখুমিয়া বিদ্যালয় পার হয়ে ভ্যানগাড়ি বা রিকশায় করে যেতে হবে। ত্রিশাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় তিন কিলোমিটার। ভ্যানগাড়ির ভাড়া পড়েছিল ৫০ টাকা। ফেরার সময় রিকশায় ফিরেছি ভাড়া পড়েছে ৩০ টাকা করে।