চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরটি খুব বড় নয়। শহরের কাছ ঘেঁষেই মহানন্দা নদী। শহর থেকে বের হবার রাস্তায় মহানন্দা নদীর ওপর প্রথম মহানন্দা সেতু পড়ে। তখন আমাদের লক্ষ্য হলো ভারতে সীমান্ত। সাঁই সাঁই করে পাশের বাহনগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে আমাদের বয়ে নিয়ে যাওয়া হায়েস। এরই মধ্যে পড়লো সেতুটি।
গাড়ির মধ্যে বসেই বুঝতে পারলাম, এই সেতু আর তার নিচ দিয়ে বয়ে চলা নদীটি মোটেও সাধারণ কিছু নয়। আসলে নদীটিই সেতুকে মহিমান্বিত করেছে। গাড়ির জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে দু’চোখ ভরে দেখে নিচ্ছি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। মনে প্রশ্ন জাগে, কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে সর্পিলাকার এই নদীর জলধারা?

অথচ খুব ভালো করেই জানি এর উত্তরটা। ছোট থেকেই সাধারণ জ্ঞান বইয়ে পড়ে এসেছি, ভারতের গঙ্গা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। তার একটি অংশ চলে গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিকে। যা মহানন্দা নামে পরিচিত। পরে এই মহানন্দাই অন্য অংশের সাথে মিলিত হয়ে পদ্মা রূপ ধারণ করেছে।
সেতু পেরুনোর আগেই ইভা বলে উঠলো, ‘আমরা এই ব্রিজে নামবো না? মহানন্দা দেখবো না?’
কী করে যেন আমার মনের কথাটাই বললো সে। কিন্তু রিসাত বললো, ‘এই রোদে ব্রিজে নেমে ভালো লাগবে না আপু। আমরা বিকেলে দ্বিতীয় মহানন্দা ব্রিজে যাব, ওখান থেকে এই ব্রিজের নিচেই নিমগাছি নামের একটা জায়গায় নিয়ে যাব। খুব ভালো লাগবে তখন।’

আমিও মাথা নেড়ে সায় দিলাম। যেকোনো নদীর ধারের বিকেল মানেই আলাদা একটা পরিবেশ। মন ভালো করা বাতাস বয়ে আনে নদী। সেই হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে সত্যিই খুব চমৎকার লাগবে।
চাঁপাইয়ের সবগুলো জায়গা ঘুরে বেড়াতে আমাদের দুপুর পেরুলো কেবল। তখন বাজে তিনটা। এই ভরদুপুরে নদীর ধারে যাব? কিন্তু গরমে সবাই এত ক্লান্ত যে একবার যদি বাসায় ফেরে তাহলে আর বেরুতে পারবে না। রিসাত বললো, ‘এখন দ্বিতীয় মহানন্দা ব্রিজের কাছে ঘুরে যাই। বিকেলে যদি ভালো লাগে তাহলে প্রথম ব্রিজটায় যাব।’
তাই সই। এসি গাড়ির ঠাণ্ডায় বসে ঝিমুতে ঝিমুতে চলে এলাম মহানন্দা ব্রিজে। ঘুমহীন রাতের জার্নি, আর চাঁপাইয়ের অসম্ভব গরমের ক্লান্তি সবার মধ্যেই জেঁকে বসেছে। তাই রাস্তার দৃশ্য আর দেখা হয়নি।

এখানে এসেও একই অবস্থা। কেউ গাড়ি থেকে নামবে, তো কেউ নামবে না। তন্দ্রাবেশ কাটেনি আমারো। মনে হচ্ছিল, ধুর যাব না! এখানে বসে ঘুমাই। তবুও কী মনে হতে চোখ রগড়ে নেমে পড়লাম। চারপাশে তাকিয়ে বুঝলাম, না নামলে বিশাল মিস করতাম।
ব্রিজ থেকে একটু দূরে ঢালে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গাড়ি। মহানন্দা বয়ে চলছে আপন গতিতে। তার পাশের বালুকাময় বিশাল চর পুরোটা ছেয়ে আছে সাদা-সবুজে। কাশবন যেন নিজের সবটুকু রূপ ফুটিয়ে তুলেছে এই বেলায়। আহা! এই কাশবনের শোভা দেখে তাসমি-ইভা বাচ্চাদের মতো দৌড়ে নেমে গেল মহাসড়ক থেকে। ব্লক দিয়ে বাঁধানো ওই খাড়াই পথ তাদের আটকাতে পারলো না।

কাশের নরম আর মোলায়েম স্পর্শে মনে পড়ে যাবে কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার কয়েকটা পঙক্তি।
‘পুচ্ছ তোলা পাখির মতো
কাশবনে এক কন্যে,
তুলছে কাশের ময়ূর-চূড়া
কালো খোঁপার জন্যে।
প্রথম কবে ফুটেছে কাশ
সেই শুধু তা জানে,
তাই তো সে তা সবার আগে
খোঁপায় বেঁধে আনে।’
কাশবনে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, গায়ে কাশফুলের রোয়া ধারণ করে উঠে এলাম নিচের বেলাভূমি থেকে। প্রচণ্ড রোদ আর গরম না থাকলে যে আরো অনেকটা সময় এখানে থাকতাম, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আগেই বলেছি, বিকেলে রিসাত আমাদের একটা জায়গায় নিয়ে যাবে, যেটা বিখ্যাত কোনো দেখার জায়গা নয়। কিন্তু ও আগেই বলেছিল এখানে এলে ভালো লাগবে। একটা বিকেলে এখানে কাটাতে সত্যিই ভালো লাগবে। নিমগাছি জায়গাটা দেখে মনে হলো, এরকম জায়গা আমার বহু দিনের চেনা। চারকোণা ব্লক দিয়ে বাঁধাই করা নদী তীর, ভাঙন রোধ করার জন্য এভাবে বাঁধানো।
যেহেতু শরৎকাল, তাই রাস্তা থেকে প্রায় ৩০ ফুট নিচে পানি এসে ব্লকের গায়ে ছোট ছোট ঢেউয়ে আছড়ে পড়ছে। সত্যি সত্যিই ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঢেউগুলো ভাঙছে। একেবেঁকে চলে যাওয়া নদীটি যেন উচ্ছল কিশোরীর মতো। তার ধার ঘেঁষে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তাটিকে উচ্ছল কিশোরীর বান্ধবীর ভূমিকায় অনায়াসে বসানো যায়। তবে বান্ধবীটির উচ্ছলতার বদলে আছে গাম্ভীর্য। তার দুই ধারের গাছের সারি সেই গাম্ভীর্যে এনে দিয়েছে আলাদা মাত্রা।

রাস্তার এক ধারে নদী, অন্য ধারে ছোট ছোট গ্রাম আর ফসলী জমি। নদীর অপর পাশে দূরের গ্রাম দেখা যায়। সেই সাথে আছে বিস্তীর্ণ আমবাগান। আমার পরিচিত নদী তীরের দৃশ্যে কেবল এই আমবাগানটি নেই। এছাড়া বাকি সবটুকুই উপস্থিত।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে রাজশাহী হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দূরত্ব ৩১৯.৪ কিলোমিটার। চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার দুটো পথ আছে। সড়কপথ আর রেলপথ। সড়কপথে যেতে হলে ঢাকার যেকোনো স্থান থেকে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে- সায়েদাবাদ, গাবতলি কিংবা উত্তরা। এসব জায়গা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেতে পারবেন এসি বা ননএসি বাসে। নন এসি বাসগুলো হলো- হানিফ, শ্যামলী, দেশ ট্রাভেলস, একতা, গ্রামীণ ট্রাভেলস, সৌদিয়া, ন্যাশনাল, তুহিন, আকিব ইত্যাদি। ভাড়া পড়বে ৫৮০ টাকা। বাসে অন্তত সাড়ে সাত ঘণ্টা লাগবে। জ্যামে পড়লে, আরো বেশি।
ট্রেনে যেতে হলে আগে থেকেই টিকিট কেটে রাখতে হবে। কমলাপুর কিংবা এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে উঠতে পারবেন। ভাড়া ৩৮০ টাকা। ট্রেনের নাম পদ্মা। বেশ ভালো ট্রেন। কমবেশি সাত ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন।
তারপর চাঁপাইনবাবগঞ্জ টার্মিনাল থেকে রিকশা বা অটোয় চলে যেতে পারবেন নিমগাছি আর প্রথম বা দ্বিতীয় মহানন্দা ব্রিজ।

কোথায় থাকবেন
যদি একদিনের ট্যুর প্ল্যান করেন, তাহলে রাতের ট্রেন বা বাসে গিয়ে সারাদিন ঘুরে রাতেই ফিরতে পারবেন। তখন ওখানে থাকার চিন্তা না করলেও হবে। এরপরও যদি আপনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে রাত্রিযাপন করতে চান সেক্ষেত্রে আপনার জন্য রয়েছে খুব ভালো একটা অপশন। বড় ইন্দারা মোড়ে পাবেন একটা তিন তারা আবাসিক হোটেল। নাম, স্কাই ভিউ ইন।
সতর্কতা
প্রকৃতি আমাদের সম্পদ। সেসব দেখতে গিয়ে আশেপাশে ময়লা ফেলে আসবেন না। নিজের দেশকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। নিজে না শুধরালে, অন্যজনের কাছে তা আশা করা বোকামি। আপনি নিজেই যদি দর্শনীয় জায়গাগুলো পরিষ্কার না রাখেন, অন্যজন রাখবে তা কী করে প্রত্যাশা করেন?
Feature image – ইভা