সংবাদপত্র খুললে প্রেমের জন্য আত্মহত্যার গল্প কম পাওয়া যায় না। ইতিহাসেও এমন ঘটনা বিরল নয়। তবে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী আত্মহত্যা করতে পারে এমন কাহিনী তো তেমন শোনা যায় না!
এখন আমি বলছি এমন একটি গ্রামের গল্প যেখানে পাখিদের আত্মহত্যা একটি সাধারণ ঘটনা। আগস্ট থেকে নভেম্বর তথা শরৎ ও হেমন্তের প্রতি রাতে যেখানে দলে দলে নানা প্রজাতির পাখিরা এসে আত্মাহুতি দেয় শিকারির অগ্নিকুণ্ডে।

গ্রামটির নাম জাটিঙ্গা বা জাতিঙ্গা। জাটিঙ্গা শব্দটি জেমে-নাগা উপজাতির ভাষা, যার অর্থ ‘বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার পথ’। এই নামে এখানে একটি নদীও রয়েছে।
জাটিঙ্গা ভারতের আসামের উত্তর কাছাড় জেলার সদর শহর হাফলংয়ের অদূরে অবস্থিত একটি গ্রাম। হাফলং একটি পাহাড়ের নাম। স্থানীয় দিমাশি ভাষায় হাফলং শব্দের অর্থ হলো ‘উইপোকার তৈরি করা ছোট পাহাড়’।

জানা যায়, প্রায় শতাধিক বছর আগে জেমে-নাগা উপজাতির কিছু লোক জাটিঙ্গায় একটি কাজে গিয়েছিল। তখন তারা কিছুদিনের জন্য এখানে অবস্থান করে। এ সময় তারা খোলা স্থানে আগুন জালিয়ে রাত কাটাত। একদিন তারা একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পায়। তারা দেখে, একই জাতির পাখিরা দল বেঁধে নিচে নেমে আসছে আর তাদের জ্বালানো আগুনে আত্মাহুতি দিচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে জেমে নাগা উপজাতির লোকেরা শয়তানের কারসাজী মনে করে ভয় পেয়ে যায় এবং অতি সত্বর সেখান থেকে পলায়ন করে।

বর্তমানে এখানে জৈন্তা উপজাতির লোকেরা বসবাস করে। পাখির আত্মহুতির বিষয়টি তারা ঈশ্বরের দান বলে মনে করে। বছরের নির্দিষ্ট মৌসুমে তারা দলে দলে বের হয় পাখি শিকারের আশায়। এ সময় তারা মশাল জালিয়ে পাখিদের জন্য অপেক্ষা করে। যখন দলে দলে পাখি এসে মাটিতে পড়ে, তখন শিকারির দল তাদেরকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।
তবে না মারলেও পড়ে যাওয়ার পর কোনো পাখি আর ওড়ার চেষ্টা করে না। অনেকে এই সব পাখিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। কারণ মাটিতে পড়ার পর থেকে তাদের জবুথবু অবস্থা হয়ে যায়। কোনো পাখিই তেমন একটা খেতে চায় না। এসময় তাদের মনে বেশ আতঙ্ক কাজ করে এবং অভুক্ত অবস্থায় থাকতে থাকতে এক পর্যায়ে মারা যায়।
জৈন্তা উপজাতির লোকেরা তাদের শিকার করা পাখিগুলো রান্না করে খায়। এছাড়া অনেক সময় এসব পাখি দিয়ে ভুরিভোজেরও আয়োজন করা হয়।

জাটিঙ্গার পাশেই রয়েছে হাফলং, যা জাটিঙ্গার আকাশ থেকে তিন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। অদ্ভুত হলেও সত্য যে, এই পাখিগুলোকে শুধুমাত্র জাতিঙ্গাতেই আত্মহত্যা করতে দেখা যায়। হাফলং এত কাছে হওয়া স্বত্বেও তারা কখনো সেখানে যায় না।
পাখিদের আত্মহত্যা করার কারণ হিসেবে অনেকে অনেক কথা বলেন। স্থানীয় জাইনতিন জনগোষ্ঠীর ধারণা এই ঘটনার পেছনে দুষ্টু আত্মার ভূমিকা রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন এটা একটা ভুতুড়ে ব্যাপার।
পাখি বিশারদগণ এই রহস্যের জট খুলতে গিয়ে কখনোই একমত হতে পারেননি। এ বিষয়ে আসামের একজন পাখি বিশারদ আনোয়ারউদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘এটা ঠিক আত্মহত্যা না। সত্যি ঘটনা হলো, পাখিরা আলোর প্রতি প্রচণ্ড আকৃষ্ট হয় এবং সেই আলোর উৎসের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় যে কোনো কঠিন বস্তুর সঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা যায়।’
আনোয়ারউদ্দীন চৌধুরীর এই মতামতের সাথে অনেকেই একমত পোষণ করেছেন। তবে অনেকে আবার দ্বিমতও পোষণ করেছেন। এ বিষয়ে কেউ কেউ বলেন আত্মহত্যাকারী পাখির গায়ে কোনো ক্ষত চিহ্ন পাওয়া যায় না।

এক্ষেত্রে দুইটি প্রশ্ন সামনে আসে আর তা হলো, যদি এদের গায়ে ক্ষত না পাওয়া যায়, তবে এরা কীভাবে মারা যায়? আর যদি তারা পূর্বেই মারা যায় তবে তারা আলোর উৎসে পৌঁছায় কী করে? প্রশ্নগুলোর গ্রহণযোগ্য উত্তর এখনো মেলেনি।
অধিকাংশ গবেষক পাখিদের আত্মহত্যার জন্য বৈরি আবহাওয়াকে দায়ী করেছেন। তাদের মতে, চাঁদহীন কুয়াশাচ্ছন্ন রাতে টিপটিপে বৃষ্টির সাথে বাতাসের প্রবাহ প্রকৃতিতে একটি গোলমেলে অবস্থা তৈরি করে। আর এমন পরিবেশে পাখিরা আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না। এসময় তারা বাধ্য হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং আলোর উৎসের দিকে আকৃষ্ট হয়ে ছুটতে থাকে।
বর্তমানে জাটিঙ্গা গ্রামে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। এটি আসামের পর্যটন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মাণ করা হয়েছে। সন্ধ্যার পরে এখান থেকে পাখিদের আত্মহত্যার দৃশ্য দেখা যায়। প্রতিবছর নির্দিষ্ট মৌসুমে বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকদের আগমন ঘটে এই ওয়াচ টাওয়ারে।

পর্যটকেরা জাটিঙ্গাতে শুধুমাত্র পাখিদের আত্মহত্যার দৃশ্য দেখতে দেখতে যায় না। জাটিঙ্গা প্রাকৃতিকভাবেও বেশ সুন্দর একটি গ্রাম। এছাড়াও এখানকার উপজাতিদের জীবন-যাত্রার ধরনও নজর কাড়ার মতো।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পাখিদের আত্মহুতির অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে চাইলে আপনিও যেতে পারেন আসামের জাটিঙ্গা নামক গ্রামটিতে।
জাটিঙ্গার পাশেই রয়েছে হাফলং। এটি একটি চিত্রানুগ শৈল-শহর, এখান থেকে আপনি নীচে রামধনু দেখতে পাবেন।
জাটিঙ্গা যাওয়ার সময় অধিকাংশ পর্যটকই হাফলং পাহাড়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। হাফলং আসামের একটি অন্যতম পর্যটন স্থান।

আসামের আরো কিছু দর্শনীয় স্থান:
কামাক্ষ্যা মন্দির: এটি অনেকের কাছে তান্ত্রিকদের এলাকা হিসেবে পরিচিত। হিন্দু পুরান অনুসারে, ভগবান শিব যখন তাঁর পত্নি পার্বতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নৃত্যে মগ্ন হয়েছিলেন, তখন ভগবান বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে দেবীর মৃত দেহে আঘাত করেন। এসময় দেবীর দেহ ৫১টি খণ্ড হয়েছিলো, যার একটি খণ্ড বর্তমান কামাক্ষ্যা মন্দিরে পড়েছিল। তাই হিন্দু ধর্মে এই স্থানটিকে অনেক পবিত্র মানা হয়।
শিবসাগর: এটি প্রায় ২০০ বছর পুরনো একটি ঐতিহাসিক দীঘি, যা আসামের কেন্দ্রে অবস্থিত।
মাজুলী দ্বীপ: ব্রহ্মপুত্র নদের মধ্যস্থলে অবস্থিত এই দ্বীপটি পৃথিবীর বৃহত্তম নদী দ্বীপ।
মানস জাতীয় উদ্যান: মানস নদীর তীরে অবস্থিত এই উদ্যানটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান: একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
Feature Image: Youtube