ঈশ্বরদী আসার সময় পাকশি রেলওয়ে স্টেশনটিকে বেশ ভৌতিক মনে হয়েছিল। আমি এই রেল স্টেশনের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় কখনোই কোনো ট্রেন দেখিনি। আর অবাক ব্যাপার, প্রায় ৫০ বারের মধ্যে একবারও আমি সেখানে দিনের বেলায় যাইনি।
আজকে যখন সুযোগ পেয়েছি তখন দিনের বেলায়ই যাব আর সেখানকার রহস্যভেদ করব।
ঈশ্বরদী থেকে যখন রওনা দিয়েছি তখন বিকেল হয়ে গেছে। গতকাল রাতে যখন পাকশি/হার্ডিঞ্জ ব্রিজে গিয়েছিলাম তখন বেশ কয়েকবার গাড়ি বদল করতে হয়েছিল, কিন্তু এবার আর সেটা করতে হলো না। এবার রেল গেট থেকে পাকশির ডিরেক্ট গাড়ি পেয়ে গেলাম।
গতকাল রাতের সেই মায়াবী রাস্তাটিকে আজ বেশ মনোরম লাগছে। সময়ের ব্যবধানে সবকিছুই কী এমন হয়? কাল রাতে যাকে মায়াবী মনে হয়েছিল সেটা আজ আমার কাছে চিরচেনা মনে হচ্ছিল।

ইজিবাইক থেকে রাস্তার চারপাশের মাঠ-ঘাট-প্রকৃতি উপভোগ করছিলাম। এমন সময় চোখ পড়ল দূরের এক বিশাল গম্বুজের দিকে। রাস্তা থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, গম্বুজটি যেন মাঠের ওপারের এক সবুজ অরণ্যের ভেতর থেকে জেগে উঠেছে। সুউচ্চ এই গম্বুজটি আরেকটু হলেই হয়তো সোজা আকাশ ছুঁয়ে দিতো।
ইজি বাইক থামিয়ে সেখানেই নেমে পড়লাম। তারপর সামনের দিকে হেঁটে হেঁটে গম্বুজটির দিকে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিলাম।

কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই ডান দিকে একটা সরু রাস্তা পেয়ে গেলাম। রাস্তাটা সোজা ঐ গম্বুজের দিকে যায়নি তবে হয়তো এই পথ ধরেই ওদিকে যাওয়া যাবে। আমি এগোতে লাগলাম।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই রাস্তার পাশে একটা নার্সারি চোখে পড়ল। দেয়ালে লেখা, ফুরফুরা শরীফ নার্সারি, ফুরফুরা শরীফ জামে মসজিদ। এতক্ষণে আমি অনুমান করে নিয়েছি যে, ওটা মসজিদই হবে। তাই নার্সারির পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম।
২০-২৫ পা এগিয়ে যেতেই সামনে দেখতে পেলাম বিশাল আকৃতির গম্বুজওয়ালা সেই কাঙ্ক্ষিত মসজিদটি। মসজিদটি দেখতে বেশ সুন্দর। এত সুন্দর মসজিদ সচরাচর দেখা যায় না। প্রথম দেখাতে একে মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন বলে মনে হতে পারে।

মসজিদটি মুঘল আমলে নির্মিত না হলেও এটা যে মুঘল স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
মসজিদটির চারপাশে চারটি মিনার ও মাঝখানে একটি বিশাল গম্বুজ। তিন তলাবিশিষ্ট এই মসজিদটির গায়ে লাল রঙ করা, মিনারগুলো আকাশী রঙের আর গম্বুজটি সাদা। দূর থেকে গম্বুজটির বিশালতা বেশ আকর্ষণ করে।

মসজিদটির ঠিক সামনেই একটি বাস ভবন রয়েছে। সাইনবোর্ড অনুযায়ী, এটি হজরত মাওলানা আবু নসর মোহাম্মদ সওবান সিদ্দিকীর বাসভবন। এছাড়াও এখানে একটি মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোডিং রয়েছে। মাদ্রাসার একজন শিক্ষকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, এই মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে দাওরা হাদিস পর্যন্ত পড়ানো হয়।
প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার মসজিদ ও মাদরাসা প্রাঙ্গণে ‘ইসালে সওয়াব’ অনুষ্ঠিত হয়। এসময় এখানে ভারত সহ বিভিন্ন স্থান থেকে আগত প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। এছাড়া বছরে দুইবার ওয়াজ মাহফিলও অনুষ্ঠিত হয়।

এখানে যে খুব বড় ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় তার প্রমাণ স্বরূপ মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি বড় স্টেজ, যার উপরে কাবা শরীফের আদল লক্ষ করা যায়। এছাড়া একটি বড় হাউজ রয়েছে আর তার চারপাশে রয়েছে অনেকগুলো বসার স্থান। আমি দেখেই বুঝে গেলাম এটা ওজুখানা। অনেক আগে একবার বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে অনেক মানুষের ভিড় থাকায় ওজু করার জন্য এরকম হাউজ তৈরি করা হয়।
স্টেজের পাশেই রয়েছে একটি কুতুবখানা, যাকে আমরা লাইব্রেরী বলি। গম্বুজওয়ালা এই বিশেষ লাইব্রেরীটি সম্ভবত মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য।
কুতুবখানাটির সামনে গিয়ে দেওয়ালে ঝোলানো একটি ব্যানারে লেখা দেখলাম, এখানে ফুরফুরা দরবারের লিখিত সকল কেতাব পাওয়া যায়। লেখাটি দেখে স্বাভাবিকভাবেই আমার ধারণাটা পাল্টে গেলো। নাহ, এটা শুধু ছাত্রদের জন্য না। এটা মনে হয় পাঠাগার অর্থে লাইব্রেরী না, এটা বই বিক্রির লাইব্রেরী। আরবি না বোঝার দরুণ এমন ভুল বোঝা-বুঝি হলো।

কুতুবখানার সামনের দিকে দুইটি সুউচ্চ ভবন রয়েছে। এই ভবন দুটিই মাদ্রাসা ভবন। মাদ্রাসা ভবনের সাথে লাগোয়া রয়েছে মূল ফটক, যেখানে লেখা আছে ‘শরীয়তে ইসলাম গেট’। আর ফটক পেরিয়েই আবার সেই পাকা রাস্তা।
ফুরফুরা শরীফ
ফুরফুরা শরীফ পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলার জাংগী পাড়ায় অবস্থিত একটি মাজারের নাম। এটি মূলত হযরত মওলানা শাহ্ সূফী আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহির মাজার। জানা যায়, এই সুফি সাধক উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পীর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এছাড়া তিনি মুজাদ্দিদ-ই যামান, আমীরুশ শরীআত হিসাবে ভূষিত হয়েছিলেন। মুজাদ্দিদ-ই যামান অর্থ যুগ-সংস্কারক।
তবে এই যুগ সংস্কারক হযরত মওলানা শাহ্ সূফী আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলায়ইহি সাধারণত দাদা হুযুর কিবলাহ নামে মশহুর।

ফুরফুরা শরীফ জামে মসজিদ ও মাদরাসা
ফুরফুরা শরীফের নিয়ন্ত্রণাধীন এই মসজিদ ও মাদ্রাসাটি ফুরফুরা শরীফের কোনো এক হুজুর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং বর্তমানেও এটি ফুরফুরা শরীফের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে ট্রেনে গেলে পাকশি বা ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে নামতে হবে। তারপর সেখান থেকে ইজি বাইকে ফুরফুরা শরীফ মসজিদে যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে যদি বাসে যেতে চান তবে আপনাকে দাশুড়িয়া বাস স্ট্যান্ডে নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি করে রেল গেইট আসতে হবে। রেল গেইট থেকে ইজি বাইকে করে সোজা ফুরফুরা শরীফ মসজিদে যেতে পারবেন।
বি: দ্র: এটিকে কেউ কেউ পাকশি মাজার বা ফুরফুরা মাজারও বলে থাকে।
Feature Image: Achinto Asif