তাজমহল ভারতের সেরা নিদর্শনগুলোর একটি। প্রতিবছরই এর কারণে লাখ লাখ মানুষ ঘুরতে আসে আগ্রা শহরে। মানুষ যতটা কল্পনা করতে পারে তার চেয়েও বেশি সুন্দর এই ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো। তবে বেশিরভাগ পর্যটকই আগ্রায় এলে শুধু তাজমহল দেখেই চলে যায়। আসলে অতিরিক্ত ভিড়ের কারণেই তাজমহল দেখা শেষেই বেরিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু তাজমহল আগ্রার অনেকগুলো চমৎকার জায়গার একটি মাত্র। আগ্রায় রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন আগ্রা কেল্লা, চমৎকার সুন্দর ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধিস্তম্ভ, ফতেহপুর সিক্রি, মেহতাব বাগসহ অসংখ্য মুগ্ধ করার মতো গন্তব্য।
নিচে আগ্রার সেরা নিদর্শনগুলোর একটি তালিকা দেওয়া হলো।
তাজমহল
তাজমহলের ছবি দেখেনি এমন মানুষ পৃথিবীতে কমই আছে। কেউ হয়তো দেখেছে ইতিহাসের বইয়ে, কেউবা পোস্ট কার্ডে, আবার কেউ বা সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো পোস্টে। ছবিতে তাজমহল দেখতে যতোটা সুন্দর, আগ্রায় অবস্থিত এই নিদর্শনটি বাস্তবে দেখতে তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর, মোহনীয়।
এই স্থাপনাটি স্থাপিত হয় সপ্তদশ শতকে। সন্তান জন্মদানের সময় প্রাণপ্রিয় জীবন সঙ্গিনীর মৃত্যুর পর তার সম্মানে এই সাদা স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করেন মোঘল সম্রাট শাহজাহান। এই স্থাপনাটি সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল প্রায় ২০ বছর এবং এটি নির্মাণে শ্রম দিয়েছে বিশ হাজারেরও বেশি শ্রমিক।
তাজমহল দেখতে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে সকাল সকাল যেতে পারলে বেশি ভালো হয়। সূর্যোদয়ের সময় ভবনটি থেকে দীপ্তি ছড়ায়। পর্যটকরা পূর্ব ও পশ্চিম গেট দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে এই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে। ঢোকার পর প্রথমেই চোখে পড়বে সুসজ্জিত বাগানগুলো। যেখানে রয়েছে শান্ত পানির ধারা। শান্ত পানিতে তাজমহলের প্রতিবিম্ব দেখতে পাওয়া যায়। এরপর রয়েছে তাজমহলের মূল ভবন। সাদা মার্বেলে তৈরি নিখুঁত প্রতিসম্যতার সাজে সাজানো ভেতরের দৃশ্যটা মুগ্ধ করতে বাধ্য যে কোনো পর্যটককেই।

তাজমহল; image source – planetware.com
এছাড়াও দেখার মতো রয়েছে তাজমহলের পশ্চিম পাশে থাকা তাজমহল মসজিদ, আর পূর্ব দিকে মূল ভবনের প্রতিসাম্য ধরে রাখার জন্য নির্মিত হয়েছে জাওয়াব মসজিদ।
আগ্রা ফোর্ট
শুধু তাজমহলই আগ্রার একমাত্র ইউনেস্কো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট নয়। এখানে রয়েছে শতাব্দী পুরোনো লাল বেলেপাথরে তৈরি আগ্রা ফোর্টও, যেটি একসময় ছিল মোঘল শাসকদের সাম্রাজ্যিক শহর।
আগ্রা ফোর্টে ঘুরে দেখা মানে শহরের ভিতরে থাকা আরেক শহরে ঘোরা। আগ্রা ফোর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দালানগুলোর একটি হলো জাহাঙ্গীর হল। এই প্রকান্ড প্রাসাদটি নির্মাণে হিন্দু-অনুপ্রাণিত কৌশল এবং মধ্য এশীয় স্থাপত্য কৌশল দুটোই অনুসরণ করা হয়েছে। সেজন্যেই এই ভবনটিকে দেখতে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে। এছাড়াও এই প্রাসাদের ভিতরে রয়েছে স্বর্ণখচিত সেন্ট্রাল কোর্ট, রাজ পরিবারের নারীরা এখানেই তাদের সময় কাটাত।

আগ্রা ফোর্ট; image source – planetware.com
এছাড়া কেল্লায় পর্যটকদের ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে আঙ্গুরি বাগ, খাসমহল, মুসাম্মান বুর্জ এবং দিওয়ান-ই-খাস। পুরো আগ্রা ফোর্ট ঘুরে দেখতে প্রায় কয়েক ঘন্টা সময় লাগে। সকালে তাজমহল ঘুরে আসার পর বিকালে ঘুরে দেখার জন্য সবচেয়ে সেরা গন্তব্য আগ্রা ফোর্ট।
ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধি
যমুনা নদীর ধারেই রয়েছে আগ্রার আরেকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধি। এই স্মৃতিস্তম্ভে রয়েছে পারস্য থেকে মোঘল সাম্রাজ্যের খেদমত করতে আসা মির্জা গিয়াস বেগ এবং তার স্ত্রীর দেহাবশেষ।
কথিত আছে, গয়নার বাক্স আকৃতির এই সমাধিটিই তাজমহলের প্রধান অনুপ্রেরণা। সেজন্যেই এটিকে ‘বাচ্চা তাজ’ নামেও ডাকা হয়। লাল বেলেপাথর এবং মার্বেলে তৈরি এই স্থাপনাটির প্রতিটি কোণাতেই রয়েছে ১৩ মিটার উঁচু ষড়ভুজাকৃতির মিনার।

ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধি; image source – planetware.com
এই স্থাপনাটির মূল আকর্ষণ হলো মার্বেলের দেয়ালে মূল্যবান রত্নপাথর খচিত ফুলেল নকশার সাজসজ্জাটা। রয়েছে অনেক জ্যামিতিক প্যাটার্নের নকশা, ফুলদানি এবং কাপের খোদাই করা চিত্র এবং মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ছেয়ে থাকা নাজুক ফুলের তোড়ার সাজ। এই সমাধিটি দেখলে তাজমহলের ভিতরের দৃশ্যের কথাই মনে পড়বে।
এত সৌন্দর্যমন্ডিত হওয়ার পরও আগ্রার অন্যান্য নিদর্শন থেকে এখানে পর্যটকদের ভিড় অনেক কমই হয়। ভিড় এড়িয়ে কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন পুরোপুরি উপভোগ করতে চাইলে ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধিই সেরা গন্তব্য।
মেহতাব বাগ
তাজমহলের ব্যাপ্তিটা যমুনা নদীর অন্যপাশে থাকা মেহতাব বাগ পর্যন্তও পড়েছে। মেহতাব বাগ একটি বর্গাকৃতি উদ্যান। প্রতিটি পাশেই ৩০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই উদ্যানটি। মোঘলদের নির্মাণ করা ডজনখানেক উদ্যানের মধ্যে এটিই এখন পর্যন্ত টিকে রয়েছে। পার্কে বেশ কিছু ফুলেল গাছ এবং উদ্যানের ছাপ দেওয়ার জন্য ঝোপ রয়েছে।
নব্বই দশকের মধ্যভাগ থেকে এখন পার্কের অবস্থা অনেক ভালো হয়েছে। ঐ সময়টায় পার্কটা বালির ঢিবি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। মেহতাব বাগ পুনসংস্কারের জন্য আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া প্রচুর পরিশ্রম করছে। প্রতিনিয়তই তারা পার্কে মোঘল আমলে জন্মানো গাছ রোপণ করছে।

মেহতাব বাগ; image source – planetware.com
উদ্যানের দৃশ্যপটটি তাজমহলের বাগানের সাথে একই রেখায় থাকায় ছবি তোলার জন্য আগ্রার সেরা স্থান এটি। বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময় এখানের দৃশ্যপটকে অপার্থিব মনে হতে পারে।
ফতেহপুর সিক্রি
তাজমহল থেকে মাত্র এক ঘন্টা গাড়ি দূরত্বে অবস্থিত এই শহরটি একসময় ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। সন্তান জন্মের ব্যাপারে সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করায় সুফি সাধক শেখ সেলিম চিশতির সম্মানে এই শহরটি নির্মাণ করেন সম্রাট আকবর। তবে পানির সরবরাহ কমে যাওয়া শহরটি একসময় পরিত্যক্ত করা হয়।

ফতেহপুর সিক্রি; image source – planetware.com
তবে লাল বেলে পাথরের এই ঘোস্ট টাউনটি এখনো ভালোভাবে সংরক্ষিত হয়ে আছে। নিঃসন্দেহেই দিনের বেলায় ভ্রমণের জন্য সেরা একটি গন্তব্য এটি। এখানে দেখার মতো স্থাপনার মধ্যে রয়েছে জামে মসজিদ। এই মসজিদটিই আসলে এই শহরে সম্পন্ন করা প্রথম দালান। এরপর রয়েছে সম্রাট আকবরের তিন বধূর জন্য নির্মিত তিনটি প্রাসাদ।
ভিতরে থাকা ভাঙা রাস্তাটা ধরে কিছুটা এগুলেই দেখা যাবে হিরন মিনার। আরো ভিতরে রয়েছে দিওয়ান-ই-আম। এর মেইন গেটের পাশেই রয়েছে আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের চারটি গ্যালারি পরিপূর্ণ হয়ে আছে মোঘল সাম্রাজ্যের সম্পদে।
Feature image source : lonelyplanet.com