সাধুর আশ্রম থেকে বেরিয়ে যে দিক থেকে এসেছি তার উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছু দূর যেতেই পাকা রাস্তার শেষ। সেখান থেকে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই তিন রাস্তার মোড়। একটি রাস্তা সোজা চলে গেছে, আর অন্যটি বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে। মোড়ের পাশেই রয়েছে একটি বড় গাছ।
দুপুর গড়িয়ে গেছে এখনো পেটে কোনো দানা-পানি পড়েনি। সেই সকাল থেকে সামান্য পাউরুটি কলা খেয়ে আছি। এই ঈদের দিনে কপালে বুঝি এমন রুজিই লেখা ছিল! যা হোক, কপাল চাপড়ে লাভ নেই। তাই গাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আমার পা আর চলতে চাইছে না, দেখি কোনো গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যায় কিনা!

গাছের গোঁড়ায় বসে বসে আশ্রমের সেই ভাঙাচোরা ঘাটটি দেখছিলাম। এখান থেকে ঘাট সহ পুকুরের পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। ‘কি জানি কে বানিয়েছিলো এই ঘাট, এমন অস্বস্তিকর ঘাট কেউ বানায়, যেখান থেকে পানি খাওয়া যায় না!’– ক্ষুধার যন্ত্রণা আর অসম্ভব রকম পানির তৃষ্ণায় এমন সব আউল-ফাউল চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমন সময় দেখতে পেলাম উঁচু নিচু মাটির রাস্তায় লাফিয়ে লাফিয়ে একটি ৮০ সিসি বাইক আসছে। বাইকটাকে দেখে আমার মনে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল।
হাত উঁচু করতেই বাইকটা দাঁড়িয়ে গেলো। বাইকে চালক সহ আরো একজন লোক রয়েছে। এর পর আমি উঠলে কি এই বাইক চলবে! এ নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ হচ্ছিল। তারপরও বিপদে যখন পড়েছি উদ্ধার তো পেতেই হবে। তাই তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলাম।
বাইক চালক বেশ ভালো ছিল। তাই এ বেলা রক্ষা পেলাম। বিলের ভেতর দিয়ে মাটির রাস্তা বেয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তবেই পাকা রাস্তার দেখা পেলাম।

আমার রুজিতে আজ ভালো খাবার না থাকলে কী হয়েছে, অন্য দিক থেকে ভাগ্যটা আজ ভীষণ রকম ভালো। তাই রাস্তার মাথায় যেতেই একটি মাজারের দেখা পেলাম।
জায়গাটির নাম ভেল্লাবাড়ি। মাজার পেরিয়েই ভেল্লাবাড়ি বাজার। তাই আগে মাজারে না ঢুকে খাবারের খোঁজে গেলাম। বাজারে মাত্র একটি খাবার হোটেল খোলা আছে, তাও আবার দোকানদার মশায় সামনে মিষ্টি সাজিয়ে বসে আছেন।
ভাত পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই তিনি এক গাল হাসি দিয়ে বললেন, আজকে ভাত রান্না করিনি, ভাই। ঈদের দিন কি কেউ হোটেলে খায়! তার এই কথা শুনে আমি আর কিছু বলতে পারছিলাম না। তাই চুপচাপ সেখান থেকে চলে এলাম।

রাস্তার পাশে একটি শিঙাড়ার দোকান চোখে পড়ল। আপাতত পেট ঠাণ্ডা করার দরুণ সেখান থেকে কিছু শিঙাড়া খেয়ে নিলাম। তারপর গেলাম মাজারের দিকে। এতক্ষণে আসরের আযান হয়ে গেছে। তাই মুসল্লিরা সব নামাজ পড়তে যাচ্ছে। দেখলাম তারা মাজার সংলগ্ন মসজিদের দিকেই যাচ্ছে। তাই আমি আর মসজিদ বা মাজার এলাকায় ঢুকলাম না।
রাস্তা থেকে দেখলে ভেতরের পরিবেশটা বোঝা যায় না। আমি পরবর্তীতে রীতিমতো আফসোস করেছি, কেন যে ভেতরে গেলাম না! ভেতরে একজন আউলিয়ার সমাধিসহ মুঘল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত দুই-তিনটি গম্বুজ রয়েছে। যদিও বারবার সংস্কারের ফলে মসজিদটি তার পুরনো রূপ হারিয়েছে, তবু গম্বুজ তিনটি তো দেখা যেত!

ভেল্লাবাড়ি মাজারটি মূলত শাহ বাগু দেওয়ান (র) এর মাজার। এটি ভেল্লাবাড়ি গ্রামে অবস্থিত হওয়ায় একে সবাই ভেল্লাবাড়ি মাজার বলে। অনেকেই মনে করেন, মাজার ও মসজিদটি মুঘল আমলে স্থাপন করা হয়েছিল। তাই বর্তমানে এটি একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি।
এখানে মসজিদ বা মাজার সংলগ্ন একটি পুকুর রয়েছে। আর পুকুরের পাড়েই রয়েছে লাল কাপড়ে ঢাকা একটি সমাধি। এটি শাহ বাগু দেওয়ানের (র:)-এর সাথীদের সমাধি। এটি পাকা রাস্তা থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। আমি তো প্রথমে ভুল করে এটাকেই মূল মাজার মনে করেছিলাম।

ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। বাঙালির ভাতের ক্ষুধা কি আর শিঙাড়ায় মেটে! মাজার থেকে খুব দ্রুতই বেরিয়ে পড়লাম। ভেল্লাবাড়ি বাজারে এসে দেখি সেখানে কোনো গাড়ি নেই। অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে অবশেষে একটি ইজি বাইক পেলাম। তবুও তার এক কথা, লালপুর যেতে হলে ডাবল ভাড়া দিতে হবে। আমার পেটে টান, তাই কী আর করার, রাজি হয়ে গেলাম।
ইজি বাইক চলছে আর আমি ড্রাইভারের পাশের ছিটে বসে ঝিমাচ্ছি। পাশ থেকে ড্রাইভার ধাক্কা দিয়ে বললেন, ভাই ঘুমাবেন না, পড়ে যেতে পারেন। আমি মনে মনে বলছিলাম, ঘুম কী আর সাধে আসে রে, ভাই! আমার মতো বোকা ট্যুরিস্ট হলে বুঝতেন। একে তো হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে গিয়ে রাতে ঘুমাতে পারিনি। তারপর আবার দিনভর না খেয়ে দৌড়াচ্ছি। মনোবল না থাকলে কখন রাস্তায় পড়ে থাকতাম!

রীতিমতো প্রায় আধ ঘণ্টা পর লালপুরে পৌঁছালাম। এখানকার রাস্তা-ঘাট ভিজে। মনে হয় কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে। এখনও আকাশের অবস্থা বেশি একটা ভালো না। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। আমি ইজি বাইক থেকে নামার আগেই এসব বিষয় লক্ষ করেছিলাম। এসময় আরো একটি বিষয় লক্ষ করলাম, এখানকার অধিকাংশ ভ্যানের হ্যান্ডলের সামনে একটি করে ছোট ঝুড়ি বাঁধা। ঝুড়িগুলো সম্ভবত হস্ত নির্মিত, যা কুটির শিল্প বা হস্ত শিল্পের প্রচলনের স্বাক্ষর বহন করে। লালপুরে সম্ভবত এখনো কিছু হস্ত শিল্পের প্রচলন রয়েছে।
গাড়ি থেকে নেমে হোটেল খুঁজতে শুরু করলাম। বেশ খোঁজাখুঁজি করেও কোনো লাভ হলো না। এখানেও বেশিরভাগ খাবার হোটেল বন্ধ। যেগুলো খোলা আছে সেখানে ভাত বাদে আর সব আছে! বেশ ঘুরে-ফিরে শ্রান্ত হয়ে এক মিষ্টির দোকানে গিয়ে বসলাম। সেখানে বসে বসে দোকানীর সামনে নিজের হতাশা ব্যক্ত করছিলাম।
এমন সময় পাশ থেকে দোকানের এক কর্মচারী এসে বলল- স্যার, আমাদের খাবার থেকে কিছু খাবার বেঁচে যেতে পারে। আপনি চাইলে সেখান থেকে কিছু খেয়ে নিতে পারেন। আমি কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আর অস্ফুট স্বরেই বললাম, যদি বেশি থাকে তবে দাও!