ভারতের উত্তর-পূর্বের ছোট্ট আদিবাসী অধ্যুষিত এক লুকানো এলাকার নাম নাগাল্যান্ড। এই এলাকাটি খুব বেশী পরিচিত না সবার সাথে। তবে বিভিন্ন রকম আদিবাসী ও এলাকাভিত্তিক দাঙ্গার জন্য এই এলাকায় অনেকে প্রবেশ করতে চান না সাধারণত। কিন্তু প্রতি বছর এই প্রদেশে সব থেকে প্রাচীন একটি অনুষ্ঠান হয়, যার নাম হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল।
এখানকার ১৬টিরও বেশি আদিবাসী ও জন-মানুষের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এই আদি অন্ত জানার জন্য, একবারের জন্যে হলেও এই ফেস্টিভ্যালে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। তবে অনেকের মতে এই উৎসবে এক সাথে সম্পূর্ণ নাগাল্যান্ডকে ভালোভাবে জানার মতো সুবিধা থাকে। সব থেকে বড় অসুবিধা হলো নাগাল্যান্ডের মানুষের সহজে নাগাল্যান্ডের বাইরে যেতে চান না আবার বাইরের প্রদেশের মানুষও তাদের খুব একটা ভালো চোখে দেখে না।

প্রায় ২০০ বছর আগে নাগাল্যান্ডের মানুষেরা সভ্য হতে শুরু করে। তৎকালীন বৃটিশ শাসনের সময়। তবুও নাগাল্যান্ডের আদিবাসী অঞ্চলটি তাদের বাধাধরা সংস্কৃতির বাইরে বের হতে পারেনি। তাই বেশ কিছু অঞ্চলে এখনো রয়ে গিয়েছে আদিমতার ছাপ। তাই এসব অঞ্চলে বাইরের অঞ্চলগুলো থেকে এসে বসবাস করা লোকের সংখ্যা খুবই কম।
একটা সময় নাগাল্যান্ডের আদিবাসীদের অন্যতম প্রধান খেলা ছিল মানুষের মস্তক ছেদন। তারা যুদ্ধ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শত্রুর মাথা ছেদন করত এবং সেগুলো পুরষ্কার হিসেবে ঝুলিয়ে রাখত বাড়িতে। আজ বহু বছর পরেও অনেকেই তাদের এই সব সংস্কৃতি মেনে নিতে হিমশিম খান।

কোহিমা, নাগাল্যান্ডের রাজধানী। অন্যান্য প্রদেশের রাজধানীর মতো বিশালতা ও আধুনিকতার ছাপ এখানে কম। কোহিমা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরেই কিসিমা ভিলেজ। অনেকের কাছে কিসিমা হেরিটেজ ভিলেজ নামেও পরিচিত এই ছোট গ্রামটি। প্রতি বছর পহেলা ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এই গ্রামে উদযাপিত হয় হর্নবিল উৎসব।
২০০০ সালের পর থেকে নাগাল্যান্ড সরকারের তত্ত্বাবধায়নে এই উৎসবে চলে আসেন পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ। প্রায় অক্টোবর মাস থেকে শুরু হয় এই উৎসবের তোড়জোড়। তখন থেকেই কটেজ, হোটেল বা হোমস্টেগুলো বুকিং শুরু হয়ে যায় এবং নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কমবেশী সকল কটেজ বুক হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষকদের ঘরে তখন উৎসবের তোড়জোড় চলে।

এখানকার আদিবাসীদের মধ্যে অনেকগুলো গোত্র ও সম্প্রদায় রয়েছে। আও, আঞামি, কনয়াক, আামি, চাকেসাং, কানিয়াক, কিক, কাচারি, শুমি, চাং, লাথা, চির, তাংল সহ আরো অনেক সম্প্রদায়। হর্ণবিল উৎসবে এসব জাতির সকলেই তাদের নির্ধারিত ও রীতিনীতি সম্বলিত পোশাক ও গহনা পরে অনুষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়ে থাকেন।
সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে, নাগাল্যান্ডের মানুষদের এই পোশাক-আশাক, গয়না ও সাজসজ্জাগুলো সম্পূর্ণ তারের মৌলিক ধারণা থেকে এসেছে। অর্থাৎ স্বতন্ত্রভাবেই তারা তাদের এই সংস্কৃতির রেওয়াজ করে চলেছে। অনুষ্ঠানের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় বিভিন্ন রকম ক্রিয়া অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটি নাগা জাতীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও আনন্দের তাই সকল জাতি এক হয়েই রীতি রেওয়াজ অনুসরণ করে এই উৎসব পালন করে থাকেন।

ক্রিয়া অনুষ্ঠানের মধ্যে হয় তীরন্দাজি, কুস্তি ও এই অঞ্চলের কিছু মৌলিক অস্ত্র দিয়ে লড়াই। এছাড়া পাশাপাশি চলে নাচ গান। বিভিন্ন রকম আদিবাসী ও স্থানীয় গানের সাথে রঙবেরঙের পোশাক পরে চলে নাচের আসর। ছেলে মেয়ে বা বুড়ো থেকে শুরু করে সব স্তরের স্থানীয়রা এই নাচ গানের আসরে যুক্ত হয়ে যান। নাগাল্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় আরেকটি বিষয় হচ্ছে এখানকার রক গান।
এই ফ্যাস্টিভেলে ও বাইরে সব সময় চলে বিশাল রক গানের আসর। স্থানীয়, ভারতীয় ও বিদেশী শিল্পীরা আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন এই রক গানের আসরে। তাই ধীরে ধীরে এই ফ্যাস্টিভ্যলের সময় সীমা বাড়ছে। প্রথমত এক সপ্তাহে শেষ হলেও এই সময়ে দশ দিনে শেষ করা হয় এই উৎসব।

উৎসবের সময় প্রদর্শনী করা হয় স্থানীয় গয়না ও পোশাকের। অন্য কোনো অঞ্চলের মানুষ তাদের ভিন্নধর্মী এই সকল পোশাক ও গয়না দেখে সেগুলো ক্রয় করেন। গয়নাগুলোও তাদের মৌলিক ধারণার মতো স্থানীয় মালামাল দিয়ে তৈরি করা হয়।
বিভিন্ন রকম পশুপাখির চাপড়া, দাঁত, গাছ-গাছড়া, পাথর আর বাঁশ সম্বলিত থাকে অধিকাংশ গহনা ও পোশাকে। এছাড়া পাশাপাশি চলে চিত্র প্রদর্শনী। আধুনিক ক্যামেরা আলোকচিত্র থেকে শুরু করে রঙ তুলিতে আঁকা নাগাল্যান্ডের সাধারণ মানুষের জীবন যাপন সম্পর্কিত চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন চলে উৎসবের পাশাপাশি।

আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনী হলো স্থানীয়দের ঐতিহ্যবাহী পোশাক প্রদর্শনী। প্রায় ৩০টি ভিন্ন আদিবাসী গোত্রের লোকেরা তাদের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সেগুলোর প্রদর্শনী করে। এই পোশাকগুলোর অধিকাংশই হাতে বোনা অল্প কাপড়, বিভিন্ন পশুপাখির চোয়ালের হাড় ও বিভিন্ন জায়গার হাড় দিয়ে তৈরি করা হয়।
তারা বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে তাদের আদিম সত্ত্বাকে সবার সামনে প্রকাশের চেষ্টা করেন। এছাড়া চলে ভাস্কর্য তৈরির কাজ। নাগা উপজাতীরা ভাস্কার্যের কাজে খুব দক্ষ তাই এই উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে এই শিল্পের প্রসার। এভাবে তাদের অনুষ্ঠানগুলো, ঐতিহ্যবাহী খাবার ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ দশ দিনে শেষ হয় এই হর্নবিল উৎসব।
রুট ও খরচের খসড়া:
ঢাকা থেকে চলে আসতে হবে শিলং। এন্ট্রি পোর্ট ডাউকি থাকলে ভালো হয়। খরচ পড়বে ১,০০০-১,৫০০ টাকার মতো। শিলং থেকে গুয়াহাটি হয়ে চলে যেতে হবে নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমাতে। সারাদিন সময় লাগবে ও পাব্লিক বাসে খরচ হবে ৪৩০-৫০০ রুপির মতো।
এবার কোহিমা থেকে গাড়িতে করে কিসমা হেরিটেজ ভিলেজ। খাবার খরচ পড়বে প্রতিবেলা ১৫০-২০০ রুপির মতো। তবে প্লান করে গেলে বাংলাদেশ থেকে ১০ দিনের জন্য ২০ হাজার টাকার মধ্যে ভালোভাবে ঘুরে আসা যাবে।