পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ (নোনা পানির) বন সুন্দরবন। কর্মসূত্রে ও বেড়াতে অনেকবারই সুন্দরবন যাওয়া হয়েছে। কিন্তু দুটো বিষয়ের আক্ষেপ রয়ে গিয়েছিল। প্রথমটা বাঘ দেখা। রাজকীয় এ প্রাণীটি নি:সন্দেহে এ বিশাল বনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। কয়েকবার খুব কাছাকাছি থাকা সত্বেও বাঘ মামার দেখা পাইনি। এমনকি কাদার উপর বাঘের একেবারে তাজা ছাপ এবং বাঘের গায়ের গন্ধও পেয়েছি। কিন্তু বাঘ হাওয়া। নৌকা থেকে নেমে বাঘের পায়ের ছাপ অনুসরণ করার মতো নির্বুদ্ধিতা বা দু:সাহস হয়নি।
আর আরেকটি ছিল মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখা। সুন্দরবনের কোল ঘেঁষা জনপদের মানুষদের একটি দলকে মৌয়াল বলে যাদের প্রধান পেশা সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ। প্রায় ২,০০০ মানুষ এ পেশায় জড়িত বলে ধারণা করা হয়। যুগ যুগ ধরে তারা সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করে সেগুলো বিক্রি করে জীবন ধারণ করে। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ মৌয়ালদের এ পেশার পদে পদে রয়েছে বিপদ আর মৃত্যর সম্ভাবনা।
সুন্দরবনের অন্যতম বুদ্ধিমান প্রাণী বাঘ। ইতোমধ্যে বাঘ বুঝে ফেলেছে বনের আগুন ও ধোঁয়ার অর্থ হচ্ছে তাজা মাংস! তাই মধুর চাক কেটে দ্রুত কেটে পড়তে হয় মৌয়ালদের। কিন্তু সব সময় শেষ রক্ষা হয় না। নৌকায় ওঠার আগেই হামলা করে বাঘ, ধরে নিয়ে যায় দলের কাউকে। এ কারণেই সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালীন গ্রামে আছেন অনেক বাঘ বিধবা। এছাড়া অনেক বিষাক্ত সাপ মধু খাওয়ার জন্য গাছে ওঠে। তাদের সামনে পড়লেও বিপদ। বাঘ ও সাপ ছাড়াও রয়েছে জলদস্যুদের উৎপাত। একবার তাদের কাছে ধরা পড়লেই হলো। বিশাল টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তবেই মিলবে মুক্তি। আর এজন্য মৌয়ালদের হারাতে হয় তাদের শেষ সম্বল। মৌমাছির কামড় তো তাদের কাছে ডালভাত।
যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরি। ইউএসএইড ও উইনরক ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় সুন্দরবনে কাজ করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক মধু বিশেষজ্ঞ এড লেভি। আরকানসাসের অধিবাসী এড মধু নিয়ে কাজ করেন ৪৩ বছরেরও বেশি সময়। পৃথিবীর ৪০টিরও বেশি দেশে তিনি মধু নিয়ে কাজ করেছেন। এছাড়া ঘুরে বেড়িয়েছেন ১২০টি দেশে। নিজেই উৎপাদন করেন প্রতি বছর ২,০০০ কেজি মধু। তার এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল সুন্দরবনের মধু আহরণের ব্যপারে একটি রূপরেখা তৈরী করা যেটাকে ব্যবহার করে বনবিভাগ যেন একটি টেকসই মধু সংগ্রহমালা নীতি প্রণয়ন করতে পারে।
এ সফরের একটি অংশ ছিল সঠিকভাবে মধু আহরণ করার জন্য মৌয়ালদের প্রশিক্ষণ দেয়া। এর মধ্যে রয়েছে মধুর চাক কাটার বিষয়, মধু সংগ্রহের পাত্রের বৈশিষ্ট্য, প্রটেকটিভ ক্লথিং তৈরী ও ব্যবহার, মধুর সংরক্ষণের কৈাশল ইত্যাদি। তারই অংশ হিসেবে একটি বাস্তব প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। পুরো বিষয়টি অনুবাদ করে শোনানোর দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের করমজলের কাছে আগে থেকেই মধুর চাক দেখে রাখা হয়েছিল। আগের দিন বিভাগীয় বন কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করে অনুমতি নিয়ে রাখি।
আমাদের যাত্রা শুরু হয় মোংলা থেকে। নৌকা নিয়ে রওনা দেবার আধা ঘণ্টা পরে বানিয়া-শান্তা বাজারে এসে নৌকায় তুলে নেয়া হয় কয়েকজন মাউয়ালিকে। তাদের ভেতর ছিলেন ওমর হাওলাদার। সুন্দরবনের পূর্ব ঢাংমারী গ্রামের সবচেয়ে বিশেষজ্ঞ মৌয়াল সে। আবার যাত্রা শুরু। অবশেষে গন্তব্যস্থল করমজলের অদূরে পৌঁছে যাই আমরা। প্রথমেই তাদের বোঝানো হয় কীভাবে কী করতে হবে। মৌয়ালদের উৎসাহের শেষ নেই। কত প্রশ্ন! কত জিজ্ঞাসা।
অবশেষে আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এবার ওমর গাছে চড়ে এডের নির্দেশিত পদ্ধতিতে মধু কাটবে। এ সময়টার জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম গত ৬ মাসেরও বেশি সময়। প্রথমেই কাঁচা ও শুকনো দু ধরনের পাতা দিয়ে তৈরী করা হলো মশাল। সে মশালে আগুন দেয়ার পর সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলা হলো।
আমি আর এড প্রটেক্টিভ পোশাক পরে গাছের সামান্য দূরে কাদার মধ্যেই দাড়ালাম। একসাথে উত্তেজনা আর ভয়। আমার গায়ে কালো আলখাল্লা ধরনের পোশাক। এড আগেই জানিয়েছিল যে পোশাকের রংটা কালো না হয়ে সাদা হওয়া উচিত ছিল। কারণ মৈামাছি কালো অপছন্দ করে। কিন্তু যাকে বানানোর জন্য বলা হয়েছে সে ভুল করে কালো কাপড় দিয়ে বানিয়েছে। অগত্যা ওই পোশাকই আমাকের পরতে হয়েছিল।
মশালে আগুন ধরানোর পর ধোঁয়া বের হতে শুরু করল। ওমর, আমি, এড, আরেকজন মৌয়াল ছাড়া একজন মহিলা মৌয়ালও ছিল সেখানে। দূর থেকে তিনি ওমরকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। ধুমা হচ্চে না (ধোঁয়া হচ্ছে না) জানালেন সেই মহিলা মৌয়াল। ওমর ততক্ষণে তর তর করে গাছের মগডালে উঠে পড়েছে। প্রথমেই দেখলাম মৌচাকে কেমন যেন স্রোত বয়ে যাচ্ছে। আসলে ধোঁয়ার কারণে মৌমাছিরা ছুটোছুটি শুরু করে দিয়েছে। ওমর ততক্ষণে আগুন আবার ধরিয়েছে। এবার শুরু হল সত্যিকারের ছোটাছুটি। কিছু মৌমাছি সরে যেতেই ওমর খালি হাতেই পরিষ্কার করতে শুরু করল মৌচাক! তারপর এডের দির্দেশিত পন্থায় এক টুকরো কেটে নিচে ফেললো, তারপরই গাছ থেকে নেমে যেতে শুরু করল।
ছত্রভঙ্গ মৌমাছিরা ছুটে আসল আমার দিকে। মৌমাছির গুঞ্জনে আতঙ্কে আমি অস্থির হয়ে গেলাম। এর মধ্যেই কয়েক’শ মৌমাছি আমার সারা গায়ে লেপ্টে আছে। হাতের গ্লাভসের মধ্যে একসাথেই ঢোকার চেষ্টা করছে ৪/৫ টা মৌমাছি। আরেকটা মৌমাছি আমার বাম হাতের আংগুলে গ্লাভস ভেদ করে হুল ফুটিয়ে দিল। ব্যথায় এবং আতঙ্কে আমার ভিডিও করা বন্ধ হয়ে গেল। আরেকটু হলেই দৌড় দিচ্ছিলাম। পাশ থেকে এড সাহস যোগালো, জানালো দৌড়ালে আমি মৃত্যু ডেকে আনব। আস্তে করে হাতের মৌমাছিগুলো সরিয়ে দিলেন তিনি। তারপর আমাকে আস্তে আস্তে ওখান থেকে সরে আসতে বললেন। পুরোপুরি জ্ঞান আমার তখনও লোপ পায়নি। মাথা ঠাণ্ডা করে আস্তে আস্তে সরে আসলাম সেখান থেকে।
ততক্ষণে বাকী মৌমাছিরা আমার পোশাক থেকে সরে গেছে। এড বলল এজন্যই কালো রংয়ের পোশাক পরতে নিষেধ করেছিল। হাতের আংগুল ফুলে কলাগাছ হয়নি সত্যি কিন্তু কলার সমান হয়ে গেছে। একজন মৌয়াল এসে মধু লাগিয়ে দিয়ে বলল, চিন্তা করবেন না, সেরে যাবে। আমরা ফিরে আসলাম আমাদের নৌকায়। পরে মনে হলো মৌমাছি হুল না ফোটালে পুরো বিষয়টা অসম্পূর্ণই থেকে যেত। এডের কাছ থেকে জানলাম এদেশের মধুর অপার সম্ভাবনার কথা। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন মধুর গুণগত মান নিশ্চিত করা এবং টেকসই মধু সংগ্রহ নীতিমালা। যাতে করে মৌয়াল এবং সুন্দরবন দুটোই উপকৃত হবে।
ফিচার ছবি: এড লেভি