গাড়ি থেকে ব্যাকপ্যাক নামাতে নামাতে বিকেল পাঁচটা গড়িয়ে গেল। যেখানে জীপ আমাদের নামিয়ে দিল তার ঠিক পাশেই একটি ভাঙা ভবন পেরিয়ে অন্য ভবনের তিন তলায় গোমুখ যাবার অনুমোদন দেয়ার অফিস। যেটা সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত। এখানে দুপুর ২টা থেকে সন্ধা ৬টা পর্যন্ত গোমুখ প্রবেশের অনুমোদন দেয়া হয় আর সকালের স্লটে সকাল ১০টা পর্যন্ত।
মূল পাসপোর্ট দেখিয়ে, পাসপোর্টের একটা ফটোকপি জমা দিয়ে নির্ধারিত ফরম পূরণ করে অনুমোদন রেজিস্টারে নাম এন্ট্রি করে একটা অনুমোদন পত্র দেয়া হয়। যেখানে যে বা যারা একই সাথে গাঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ যাবে তাদের বিস্তারিত লেখা থাকে। কতদিনের জন্য যাচ্ছে, কবে ফিরবে, কীভাবে থাকবে? নিজেদের তাঁবু না অন্যদের তাঁবু বা স্থাপনায় সবকিছুর বিস্তারিত লেখা থাকে।

গোমুখ ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। ছবিঃ লেখক
আর হ্যাঁ যাদের বয়স পঞ্চাশ বছর বা তার উপরে তাদের সবার আগে মেডিকেল চেকআপ করিয়ে নিয়ে, সুস্থতার সনদ পেয়ে তবেই গোমুখ যাবার অনুমোদন নিতে হয়। তবে সে জন্য খুব বেশী ঝামেলা পোহাতে হয় না। নিচেই মেডিকেল সনদের জন্য নানা রকম প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষার জন্য একটি ছোট্ট মেডিকেল রুম, ডাক্তার ও দরকারি ওষুধপত্রসহ সরঞ্জামের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখান থেকে সনদ নিয়ে, অন্যান্য দরকারি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অনুমোদন নিতে হয় সবাইকেই।
তাই আমরাও সেইসব নিয়ম মেনে নিয়ে কলকাতার দুই বয়স্ক দাদার মেডিকেল টেস্ট বা শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে অফিস থেকে গোমুখ যাবার অনুমোদন পত্র নিলাম। তবে এখানে আর একটা ব্যাপার স্পষ্ট করে বলা উচিৎ যেটা অফিস থেকে জানিয়েছে এবং যে নিয়মের কারণে একজন সেদিন গোমুখ যাবার অনুমোদন পত্র পায়নি। সেটা হলো, একাধিক ব্যক্তির কোনো গ্রুপ হলে গাইড বাধ্যতামূলক নয়। তবে একা একা কেউ ট্রেক করতে পারবে না। একা একা যেতে হলে অবশ্যই কোনো না কোনো গাইডের অধীনে যেতে হবে।
আর একটা বিশেষ নির্দেশনা হলো, একই সাথে গ্রুপে যে কজন এন্ট্রি ফরম পূরণ করবে, একই সাথে তাদেরকে ফিরতে হবে। কেউ একদিন আগে বা একদিন পরে ফিরবে সেটা করা যাবে না। এবং একটি গ্রুপ হলে যে কোনো একজনকে সবার দায়িত্ব নিতে হবে, যেন ফেরার পথে সেই ব্যক্তি সবাই একই সাথে ফিরেছে সেটা যেন নিশ্চিত করে যায়।

অফিস ঘরে অনুমোদনের অপেক্ষায়। ছবিঃ লেখক
এই জায়গাতে এসে আমার একটু খটকা লেগেছে আবার কিছু সুবিধা পেয়েছি বলে সেই দায় মেনেও নিয়েছি বা নিতে হয়েছে। কারণ কিছু পেতে হলে কিছু অবশ্যই দিতে হয়। এটাই নিয়ম, এটাই স্বাভাবিক। আমি একা ছিলাম, গাইড নেবার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না। কলকাতার দুই দাদার সাথে ট্যাগ হওয়াতে আমরা একটা গ্রুপ হয়ে গিয়েছিলাম। যে কারণে গাইড না নেয়াতে কারো কোনো আপত্তি আসেনি। বেশ সহজেই অনুমোদন পেয়ে গিয়েছিলাম একটি ফরম ও সকলের পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দিয়ে নাম এন্ট্রি করে।

গোমুখ ট্রেক এর অনুমোদন ফরম। ছবিঃ লেখক
কিন্তু মনে মনে খটকা ছিল, আমি যেহেতু আগে এন্ট্রি করেছি আর তুলনামূলকভাবে কম বয়স্ক হওয়াতে, আমাকে ওদের দুজনের দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হয়েছিল! এবং অফিস থেকে বার বার বলে দেয়া হয়েছে যে ধীরে ধীরে যেন ট্রেক করি আর একই সাথে গিয়ে একই সাথে যেন ফিরে আসি। কাউকে রেখে কেউ যেন খুব বেশী এগিয়ে না যাই আর দলছুট হয়ে যেন হারিয়ে না যাই। মনে মনে এইসব নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও একা একা যাওয়ার অনুমোদন পেতাম না বলে এটা মেনে নিতে খুব একটা কষ্ট পাইনি।

গাঙ্গোত্রীর মেডিকেল রুম। ছবিঃ লেখক
অবশেষে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অনুমোদন ফরম হাতে নিয়ে নিচে নেমে হোটেল খুঁজে পেতে পথ ধরলাম। খুব বেশীদূর যেতে হলো না। গাঙ্গোত্রী প্রবেশের গেট থেকে সামনে এগিয়ে প্রথম হোটেলেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত দামে, আর মোটামুটি মানের হোটেল খুঁজে পেয়ে উঠে পড়লাম। ৪০০ টাকায় তিন জনের জন্য থাকার রুম। একটি ডাবল খাট আর একটি সিঙ্গেল। স্বাভাবিকভাবেই আমি সিঙ্গেল খাট আর দুই বন্ধু মিলে ডাবল খাট দখল করলাম যে যার মতো করে। ৪০০ রুপীর রুম ভাড়ার সাথে দেবে এক বালতি গরম পানি সন্ধ্যায় বা সকালে যখন আমরা চাই।
আপাতত আমার গরম পানি চাই না। আমার চাই একটা ভালো গোসল। কিন্তু বাথরুমে ঢুকে পানি তো পেলাম না, পেলাম যেন তরল বরফ! আসলেই তাই। গাঙ্গোত্রী চলে আসার উত্তেজনায় এতক্ষণ বুঝতে পারিনি যে এখানে কতটা ঠাণ্ডা। যেটা বুঝলাম বাথরুমে ঢুকে। অতঃপর কোনো উপায় না পেয়ে আর গরম পানি পেতে বেশ দেরি হবে কিন্তু গোসল না করে আর থাকা যাচ্ছে না দেখে অবশেষে সেই বরফ জলেই নিজেকে ভেজাতে হলো ঝটপট। কোনোমতে গায়ে কিছু পানি ঢেলে, সারাদিনের ধুলো-ময়লা ধুয়েই বেরিয়ে পড়লাম। নতুন কাপড়, সোয়েটার, জ্যাকেট, বুট পরে রেডি হলাম। বাইরে যাবো। গাঙ্গোত্রী দেখবো, হেঁটে বেড়াবো। গঙ্গার পাড়ে বসে থেকে সময় কাটিয়ে একদম ঘুমের সময় খেয়েদেয়ে রুমে ফিরবো বলে।

গাঙ্গোত্রী। ছবিঃ লেখক
আর তক্ষুনি মনে পড়লো, আমার অনেক দিনের “আরতি” দেখার সাধ। আর সাথে সাথে মনে পড়লো গাঙ্গোত্রী সন্ধ্যা আরতির কথা। এটা নাকি অনেক সুন্দর আর মনোরম হয়ে থাকে। সে কথা মনে পড়তেই ছুটলাম গঙ্গার পাড়ে, ভাগীরথীর কোলে মন্দিরের সন্ধ্যা আরতি দেখতে, গাঙ্গোত্রীর আরতি সন্ধ্যায়।
Thanks for your wonderful experience