ঝিনাইদহের বারোবাজার দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান। এই বারোবাজারে রয়েছে সুলতানী আমলের ৫০০ থেকে ৬০০ বছর পুরনো অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের যে স্থানে বারোবাজার অবস্থিত তার আশেপাশে ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্ত আঁকলে যে স্থান ধরা পড়ে তার মধ্যেই রয়েছে ১৩/১৪টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
এই নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে আজ থেকে ৫০০ বছর পূর্বে এই অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধ সুলতানী জনপদ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন শাসনামলে এই জনপদ ক্রমশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ গত শতকের আশির দশকে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বারোবাজার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি খনন করে এসব অত্যাশ্চর্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করেন। আশপাশের জনপদ সমতল থাকলেও শুধু এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল।
মাটির উঁচু ঢিবি তৈরি করে এই নিদর্শনগুলো ঢেকে রাখার অর্থ কোনো এক শাসনামলে এইসব নিদর্শন লোক চক্ষুর আড়ালে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, অথবা কোনো শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে এর নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণকারীরাই মাটিচাপা দিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল।
ঘটনা যাই হোক, সে সময়ের সঠিক ইতিহাস যেহেতু জানা যায় না, তাই অনুমান করে নিজের মতো গল্প সাজানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।
সম্প্রতি বারোবাজারের বিভিন্ন জায়গায় থাকা বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পরিদর্শন করেছি এবং ইতোমধ্যে ঐতিহ্যবাহী গোড়ার মসজিদ সম্বন্ধে আপনাদের জানিয়েছি। আজ আপনাদের নিয়ে যাব বারোবাজারের আরেক ঐতিহ্যবাহী মসজিদে।
আমাদের এবারের গন্তব্য বারোবাজার গলাকাটা মসজিদ। ঐতিহ্যবাহী গোড়ার মসজিদ দেখার পর আমি আর ডাক্তার বিল্লাল চাচা রওনা করব গলাকাটা মসজিদের উদ্দেশ্যে। এমন সময় আবার বৃষ্টি! গোড়ার মসজিদের গেটের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। এর মধ্যে এক মুরুব্বী চাচাকে পেয়ে গেলাম পপকর্ন হাতে। মুরুব্বির কাছ থেকে পপকর্ন কিনে বৃষ্টি দেখছি, আর ভুট্টার খই খাচ্ছি। বৃষ্টির গতি যেন বেড়েই চলেছে। বিল্লাল চাচা বলছিলেন, আজ বোধহয় আর যাওয়া হবে না। এভাবে বৃষ্টি যদি ঝরতে থাকে তাহলে কীভাবে যাওয়া সম্ভব?
কিন্তু না, প্রকৃতি মুখ তুলে চাইল। টানা ১০ মিনিট ঝরার পর বৃষ্টি থেমে গেল। আমাদের বাইক আবার চলতে শুরু করলো। এবার গন্তব্য গলাকাটা মসজিদ।
এই মসজিদের সম্পূর্ণ নাম গলাকাটা দিঘী ঢিবি মসজিদ। নামটি ভাঙলে তিনটি অংশ পাওয়া যায়: গলাকাটা, দিঘী এবং ঢিবি। মসজিদটি মূলত একটি বিশাল দীঘির পাড়ে অবস্থিত, যে দিঘীর নাম গলাকাটা দিঘী। এখান থেকে মসজিদের নামকরণ হয়েছে গলাকাটা মসজিদ।
মসজিদ সংলগ্ন এই বিশাল দিঘীটি খানজাহান আলীর হাতে নির্মিত অথবা তার সমসাময়িক সময়ে নির্মিত বলে জনশ্রুতি আছে। দ্বিতীয় অংশটি হলো ঢিবি। বারোবাজারের আর সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মতো এই বিশাল মসজিদটিও মাটির ঢিবির নিচে লুকানো ছিল। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মাটির ঢিবি খনন করে মসজিদটি আবিষ্কার করে।
৬ ফুট প্রশস্ত গ্রামের পাকা রাস্তা ধরে আমাদের বাইক এগিয়ে চলেছে তাহেরপুরের উদ্দেশ্যে। ঝিনাইদহ জেলার বারোবাজারের তাহিরপুর রাস্তার পাশে বিশাল গলাকাটা মসজিদ অবস্থিত। দুপাশের সবুজ প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলেছি। পাশ দিয়ে দু’একটি ইজিবাইক, ভ্যান, অটোরিকশা এবং ইঞ্জিন চালিত ভ্যান চলতে দেখলাম।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম গলাকাটা মসজিদে। রাস্তার ডান হাতে খানিকটা নিচু জমিতে নেমে যেতে হলো গলাকাটা মসজিদ দেখতে। তবে রাস্তার উপরে দাঁড়িয়েই এক দৃষ্টিতে দেখে নেওয়া যায় বিশালাকৃতির এই মসজিদটি। গোড়ার মসজিদ দেখার মতো এই মসজিদটি দেখেও আমি সমান মুগ্ধ হয়েছি। তবে বলতেই হবে, গোড়ার মসজিদের চেয়ে এই মসজিদটি আয়তনে বেশ বড়।
মোট চারটি বড় আকৃতির প্লারের উপর এই মসজিদটি স্থাপিত। ইতোপূর্বে দেখা গোড়ার মসজিদের মতো এই মসজিদটিও বর্গাকৃতির। মসজিদের প্রতিটি দেওয়াল ২৫ ফুট উঁচু এবং ৫ ফুট চওড়া। গোড়ার মসজিদের মতো এই মসজিদেও তিনটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দিকের দেয়ালে রয়েছে সুন্দর তিনটি মেহরাব। দৃষ্টিনন্দন এই মেহেরাব তিনটি লতাপাতা, ফুল, ঘণ্টা, চেইন এবং এ জাতীয় নানা পোড়ামাটির কারুকাজে সজ্জিত।
তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মসজিদের ভেতরে কালো পাথরের তৈরি প্রায় ৮ ফুট উচ্চতার দুটি স্তম্ভ। মূলত এই স্তম্ভ দুইটি মসজিদের ছাদ ধরে রাখার কাজ করে। মসজিদের উপরে একই আকৃতির ৬টি গম্বুজ রয়েছে এবং কালো পাথরের স্তম্ভ দুটি ছয়টি গম্বুজের ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে।
মসজিদের চার কোনায় অবস্থিত চারটি পিলার ষড়ভুজ আকৃতির। মসজিদ থেকে চোখ সরালে ঠিক উত্তরে যে বিশাল গলাকাটা দীঘি রয়েছে তার শান্ত জল আপনাকে সুলতানী আমলের জৌলুস মনে করিয়ে দেবে।
আগের দিনে বড় মসজিদ নির্মাণ করলে তার সামনে এমন একটি দীঘি নির্মাণ করা হতো। কেননা মুসল্লিদের অজু-গোসলের জন্য জলাধার প্রয়োজন। তাছাড়া তখন তো এখনকার মতো আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না। তাই সব মসজিদের পাশে এমন বিশাল দীঘি খনন করা হতো। এই মসজিদটিও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এই দিঘির নাম কেন গলাকাটা হলো সে সম্বন্ধে খুব একটা জানা যায় না।
এই মসজিদ আবিষ্কৃত হবার পর এখানে সংরক্ষিত পঞ্চদশ শতাব্দীর হাতে লেখা কোরআন এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর আরো কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। এছাড়া মাটি খনন করে ৮০০ হিজরি সনের আরবি ও ফারসিতে লেখা কিছু পাথরের নিদর্শন পাওয়া যায়।
বারোবাজারের তাহেরপুর রাস্তার পাশে অবস্থিত এই গলাকাটা মসজিদ আমার ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন দেখার আকাঙ্ক্ষা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পরপর দুটি মসজিদ দেখার পর বারোবাজারের বাকি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখার আগ্রহ ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। আমার ভ্রমণের সাথে সাথে নিশ্চয়ই আপনাদেরও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব বারোবাজারের বাকি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলী থেকে সড়কপথে সরাসরি ঝিনাইদহের বাস পাওয়া যায়। পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা থেকে সড়কপথে ঝিনাইদহ পৌঁছানো সম্ভব। তারপর ঝিনাইদহ থেকে সড়ক পথের কালিগঞ্জ হয়ে বারোবাজারে পৌঁছানো যাবে। এছাড়া ঢাকা থেকে সড়কপথে যশোর পৌঁছে যশোর ঝিনাইদহ মহাসড়ক ধরে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে গেলে পাওয়া যাবে বারোবাজার।
আপনি চাইলে বিমানযোগেও আসতে পারেন। ঢাকা থেকে যশোর বিমানবন্দরে পৌঁছতে হবে। তারপর যশোর থেকে সড়কপথে বারোবাজার আসা যাবে।
ফিচার ইমেজ- wikimedia.org