দ্বিতীয় দিন সকালে খুব ভোরে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে টেন্ট থেকে বের হলাম। আমার হালকা স্লিপিং ব্যাগটি যে এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কর্মক্ষমতা হারিয়েছে সেটি বুঝতে পেরেই আসলে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ভোর পাঁচটা থেকে মূলত অ্যাক্টিভিটি শুরু হয় এখানে। সকালের চায়ের জন্য রাধুনী হাঁক দিতে লাগল। পর্যায়ক্রমে লাল চা এবং দুধ চা সকলের সামনে নিয়ে আসাই তাদের প্রথম কাজ।
আমি ব্যাগ থেকে কোনোমতে ছোট মগ বের করে প্রথমে লাল চা এবং পরে দুধ চা খেয়ে একটু রাস্তার দিকে গেলাম হাঁটাহাঁটি করতে। শীতকালের সকালে তখন ও সূর্যের আলো এসে পৌঁছায়নি। চাঁদের আলোয় ঝলসে আছে বলা চলে তিলাবনী পাহাড়ের উপরের অংশ। রাস্তা ধরে হালকা জগিং করে আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এলাম। ৬টার সময় লাইনে দাঁড়াতে হয় এখানে।

পিটি চলছে। ছবিঃ মহিউদ্দিন মাহি
লাইনে দাঁড়ানোর পর কিছু ইনস্ট্রাকশন শেষ করে নিয়ে যাওয়া হয় পিটি করাতে। অনেক রকম এক্সারসাইজ থাকে। বেশ কিছু মজার মজার এক্সারসাইজ আমাদের করানো হলো। তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে আধা ঘণ্টা এক্সারসাইজ করার পর শরীর এমনিতেই গরম হয়ে আসলে এক্সারসাইজ শেষে, সারিবদ্ধভাবে আবার ক্যাম্প সাইটে ফিরে আসা হলো। সকালের খাবারের জন্য এরপর আধা ঘণ্টা সময় সবার হাতে থাকে। সেই সময়টা সবাই সারাদিনের অ্যাক্টিভিটিগুলোর জন্য ব্যাগ গুছিয়ে নেয়।
সকাল সাতটা থেকে শুরু হয় রক সাইট ট্রেক। ক্যাম্প সাইট থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে রক সাইটে পৌঁছাতে। পৌঁছানোর পর প্রথম একটি টার্মিনোলজি ক্লাস নেয়া হয় । এই টার্মিনোলজি ক্লাসে বলে দেয়া হয় আজ সারাদিন কী কী অ্যাক্টিভিটি করানো হবে। দ্বিতীয় দিনের প্রথমেই আমাদের দেখানো হয় অ্যাঙ্গেল অনুযায়ী পাথরের উপর কীভাবে হাঁটতে হয় তার কিছু নিয়ম।

ক্লাইম্বিং চলছে। ছবিঃ স্বর্ণ কোমল শাহা
এরপর শুরু হলো রক ক্লাইম্বিং। প্রথম দিন থেকে আজকে বড় বোল্ডার সিলেক্ট করা হয়েছে ক্লাইম্বিংয়ের জন্য। এই বোল্ডারগুলো কিছুটা ঢালু, প্রায় ৮০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলের। তাই প্রথমেই ইনস্ট্রাক্টরগণ আমাদের দেখিয়ে দেন, কীভাবে নাইন গোল্ডেন রুলস ফলো করে এই পাথরগুলোতে আরোহন করা যায়। এরপর আমাদের আরোহন করতে দেয়া হয়। প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টার মতো সময় ৮টি আলাদা আলাদা সেকশনের সমগ্র প্রশিক্ষণার্থীদের প্র্যাকটিক্যালি রক ক্লাইম্বিং করানো হয়।
চারপাশে বিশাল মালভূমি প্রান্তরের মাঝখানে উঁচুতে ওঠার পর চারদিকে তাকালে মন জুড়িয়ে যায়। আসলে পর্বতের ব্যাপারটা এরকম, অনেক উঁচু থেকে সব কিছু দেখা। এটি একটি নেশার মতো যে নেশা ভুলবার নয়, যে নেশার মাঝে বেঁচে থাকে পর্বতারোহণে ইচ্ছুক হাজার হাজার মানুষ।

পুরুলিয়ার মালভূমি প্রান্তর। ছবিঃ লেখক
২-৩ ঘণ্টা ক্লাইম্বিং করানোর পর আমাদের দেখানো হয় ট্রাভার্সিং। কীভাবে একটি সরু পাথরের এক প্রান্ত থেকে শুরু করে ডানে অথবা বায়ে ট্রাভার্স করে নিজের হাত অথবা পায়ের উপর প্রেসার দিয়ে পাথরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া যায়। ঢালু পাথরে ট্রাভার্স করা খুবই সহজ কাজ, কিন্তু পাথরগুলো যদি সোজা হয় বা ৯০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে পায়ের উপর জোর দিতে হয়। খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কিছু নিয়ম অনুসরণ করলে ট্রাভার্সিং করা খুব সহজ বলেই মনে হয়।
দুপুর গড়িয়ে আসলে আমাদের খাবারের বাঁশি পড়ে। সেদিন দুপুরের খাবার রক সাইটেই করার কথা ছিল। তাই আমরা রক সাইট থেকে কিছুটা নিচে নেমে দেখলাম রাধুনীরা আমাদের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। সবাই যার যার ব্যাগ থেকে প্লেট বের করে খেতে শুরু করলাম। এখানে পানির স্বল্পতা অত্যাধিক তাই পানি ব্যবহারের সময় আমাদের বার বার সতর্ক করে দেয়া হচ্ছিল। খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর ২০ মিনিট বিশ্রামের জন্য সময় দেয়া হলো।

খাওয়া শেষ করে আবার রক সাইটে যাত্রা শুরু। ছবিঃ লেখক
বিশ্রাম শেষ করে আমরা আবার চলে আসলাম রক সাইটে। এবারের প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল রানার চেঞ্জিং। ব্যাপারটা হচ্ছে যখন কোনো সোজা বা দীর্ঘ পাথরে উঠতে হবে, মানে পাথরের দূরত্ব খুবই বেশি হবে সেক্ষেত্রে, পড়ে গেলে মারা যাওয়া বা বাজেভাবে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এই পাথরগুলোতে উঠতে হয়। এর মধ্যে কিছুর নাম হচ্ছে রোপ, ক্যারাবিনার, হার্নেস, পিটন, কুইকড্রস ইত্যাদি।
ওঠার সময় এগুলো ব্যবহার করে এর সাহায্যে নিজের সাথে যুক্ত করে তারপর উপরের দিকে উঠতে হয়। হাত বা পা ফসকে গেলে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ দড়িতে আটকে যায় কিন্তু একটি পিটন পর্যন্ত আসার পর পরবর্তী দড়ির সাথে কীভাবে নিজেকে সংযুক্ত করতে হবে এটাই ছিল এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য।

সবাই ছুটছে বোল্ডারের দিকে। ছবিঃ লেখক
এই প্রশিক্ষণটি অনেকের কাছেই নতুন ছিল তাই এই প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর অনেকেই খুব আনন্দ পেয়েছে। কঠিন এবং সোজা ৯০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলের পাথরে কীভাবে নিরাপদে ওঠা যাবে সেই প্রশিক্ষণ এই পর্বে দেয়া হলো। এটা শেষ করার পর অনেকটা সময় হাতে বেশি থেকে গিয়েছিল। সেই সময় আমরা অতিরিক্ত কিছু প্র্যাকটিস করে ফেললাম। এছাড়া যে পাথরে অন্যরা কেউ রানার চেঞ্জিং প্রশিক্ষণটি করছে না এবং যাদের প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়ে গিয়েছে, তার আগে সেই পাথরগুলোতে অতিরিক্ত অনুশীলন করতে শুরু করল। এর ফল খুব ভালোভাবে পাওয়া গিয়েছিল শেষ দিন পরীক্ষায়।

চলছে রানার চেঞ্জিং। ছবিঃ স্বর্ন কোমল শাহা
রানার চেঞ্জিং শেষ করতে করতে সাড়ে চারটে বেজে গিয়েছিলো। সাড়ে চারটের সময় সদলবলে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া ছিল ক্যাম্প সাইট থেকেই। তাই সকলে তাদের তল্পি-তল্পা গুটিয়ে ইনস্ট্রাক্টরদের পিছু পিছু ক্যাম্পের দিকে রওনা হলাম। পুরুলিয়াতে ক্লাইম্বিং প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অন্যান্য ক্লাবের অনেক মেম্বার দেখলাম উঁচু উঁচু বেশ কিছু পাথরে তখনও ক্লাইম্বিং করে যাচ্ছে। আমরা সকলে এক জায়গায় সমবেত হওয়ার পর আমাদের লাইন আপ করানো হলো। রোপ লিডারদের কাছ থেকে তাদের রোপের সকল মেম্বারদের উপস্থিতি জানতে চাওয়া হলো। তারপর সকলে একসাথে হয়ে গেলে ক্যাম্পের দিকে সদলবলে রওনা দিলাম।

ক্যাম্পে ফেরার লাইন।
ক্যাম্প সাইটে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যায় আমাদের মুড়িমাখা খেতে দেওয়া হলো, সাথে ছিল চা এবং স্যুপ। সন্ধ্যার পর অ্যাক্টিভিটি হিসেবে ছিল মূলত বেশ কিছু পর্বতারোহণ বিষয়ক ক্লাস। শ্রদ্ধেয় কুন্তল কারার স্যার আমাদের দেখালেন তিনি কীভাবে এভারেস্টে ক্লাইম্ব করেছিলেন ২০১৭ সালে। এমন একজন মানুষ আমাদের সাইটে ছিলেন যিনি এভারেস্ট জয় করেছেন। তাঁর গল্পগুলো শুনতে, ভিডিও আর ছবিগুলো দেখতে অসাধারণ এক অনুভূতি হচ্ছিল। নিজের মধ্যে খুব গর্ববোধ হচ্ছিল।
এর ফাঁকে তিলাবনি পাহাড়ের উপর চাঁদ উঠে গেল। আস্তে আস্তে ক্যাম্পসাইট আলোকিত হয়ে উঠল চাঁদের হলুদ আলোয়। রাত ৯টা বাজার সাথে সাথেই বাঁশি পড়ল খাবারের। দ্রুত আমরা যার যার খাবার খেয়ে নিলাম এবং পরদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠার জন্য তাড়াতাড়ি যার যার টেন্টে ফিরে গেলাম। তিলাবনি পাহাড়ের নিচে আমাদের ক্যাম্প সাইটের কেরোসিনের কুপিগুলো আস্তে আস্তে নিভে যেতে শুরু করল।
রুট ও খরচের খসড়া:
কলকাতা থেকে আগ্রা অথবা আনারা চলে আসতে হবে ট্রেনে অথবা বাসে করে। এখান থেকেই মিনিট্রাক অথবা সি এন জি ভাড়া করে চলে আসা যাবে তিলাবনি পাহাড় বা তিলাবনি ক্যাম্প সাইটে। কোনো গ্রুপের সাথে গেলে এই কোর্সের খরচ পড়বে হাওড়া টু হাওড়া ৩,৫০০ – ৮,০০০ টাকা পর্যন্ত।