আমরা যারা ভেতো বাঙালি, ভাতই যাদের কাছে খাবার একমাত্র ও প্রধান উপকরণ তাদের কেউ যদি টানা ১২ দিন ভাত না খেয়ে থাকেন, তবে কেমন অনুভূতি হবে আপনার?
উহ, ভাবলে এখনো শিহরিত হই, সেই দিনটির কথা, ঠিক দিন নয়, দিন ফুরিয়ে, অবরোধের প্রকোপ এড়িয়ে, কোনোমতে যশোর স্টেশন এসে পৌঁছাবার পরে। সন্ধ্যার শুরুতে, সবার একটাই চাওয়া, ভাত চাই ভাত! ইশ কতদিন ভাত খাই না? আর সেই একপ্লেট ভাতের জন্য কত কাহিনী না করেছিলাম! সেটাই স্বাভাবিক ছিল যেহেতু টানা ১২ দিন আমরা সত্যিকারের সাদা ভাতের সাথে শীতের তরকারী আর মাছ খেতে পারিনি।

চলেন এক প্লেট ভাতের জন্য নিদারুণ হাহাকার আর কি ভীষণ আকুতি করেছিলাম সেদিন, সেই গল্পটা আজ বলি?
দেশে চরম হরতাল আর অবরোধের মাঝে আমরা গিয়েছিলাম স্বপ্নের শিমলা-মানালিতে। মোট ১২ দিনের দুরন্তপনা শেষে ফিরছিলাম বাংলাদেশে। এই ১২ দিনে সত্যিকারের বাঙালি খাবার খাওয়া হয়নি একটি বারের জন্যও। এটা-সেটা-ওটা কত কিছুই তো খেয়েছি, কিন্তু সাদা ভাত-ডাল-তরকারী বা মাছ-মাংস আর খাওয়া হয়নি মন ভরে। তাই কলকাতা থেকে ঠেলেঠুলে যখন যশোরের দিকে যাচ্ছিলাম, সবার একটাই চাওয়া ছিল, যশোর পৌঁছে সামনে যে ভাতের হোটেল পাবো সেটাতেই পেটপুরে ভাত খাবো।
যশোর পৌঁছে সেই কমলার স্তূপ (এই রোমাঞ্চকর গল্প তো আগেই পড়েছেন) কোনোমতে স্টেশনে রেখে ভাতের হোটেলের উদ্দেশ্যে দৌড় দেব, এমন সময় ঘোষণা এলো, খুলনা থেকে ঈশ্বরদী গামী ট্রেন এক্ষুনি এসে পড়বে। সরাসরি ঢাকায় যাবার কোনো ট্রেন ছিল না বলে সেই ট্রেনেই অন্তত ঈশ্বরদী পর্যন্ত আসা যাবে যে কারণে ভাতের কথা ভুলে গিয়ে কোনোমতে ট্রেনে উঠে পড়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। এদিকে পেটে একমুঠো ভাতের জন্য হাহাকার। ওদিকে কমলার স্তূপ নিয়ে ট্রেনে উঠতে পারবো কি পারবো না সেই দুশ্চিন্তা। তাই আবারো ভাতের জন্য নিদারুণ অপেক্ষার প্রহর বাড়লো।

এক সময় ট্রেন এলো, বেশ দ্রুতই। কিন্তু প্রত্যাশার চেয়ে ট্রেন বেশ ফাঁকা থাকাতে সেই মুহূর্তে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম সবাই। ট্রেনে উঠে বসতেই আবারো ভাতের ক্ষুধা, কুরে কুরে খেতে শুরু করলো সবাইকে। এদিকে কোথাও খাবার তেমন কিছু চোখেও পড়ছে না। যে কারণে ক্ষুধাটা আরও বেশী চড়াও হলো বোধহয়। বেশ অনেকক্ষণ পরে খেয়াল হলো, আরে আন্তঃনগর ট্রেনে তো আলাদা খাবার গাড়ি থাকে, যেখানে সব সময়ই খাবার পাওয়া যায় বা যাবার কথা।
মনে পড়তেই আমি আর জম্মু (জামিল) খোঁজে বের হলাম খাবার গাড়ির। তিন বা চারটা বগি পেরিয়েই দেখা পেলাম কাঙ্ক্ষিত খাবার গাড়ির। গিয়ে কোনো কথাবার্তা নাই, বেসিনে হাত ধুয়ে দুইজনে বসে পড়লাম খাবার টেবিলে। বসেই ওয়েটারকে ডাক দিয়ে খাবারের অর্ডার দিলাম, ভাত আর সাথে ভালো যে তরকারী আছে তাই। ওয়েটার আমাদের টেবিলেই বসে পড়লেন এবং শান্ত মুখে বলল যে এখন এই অসময়ে আর হরতাল অবরোধের মধ্যে ওনারা খাবার সরবরাহ করছেন না! হায় বলে কি? শুনে তো পুরাই হতাশ নয় শুধু যেন মুষড়ে পড়লাম।

বিরস বদনে উঠে পড়লাম দুইজন, আমি আর জম্মু! হেঁটে চলেছি আমাদের বগির দিকে। যেতে যেতে চোখ আটকে গেল খাবার গাড়ির কিচেনের দিকে। দেখি সেখানে রীতিমত বড় চুলায় ভাত রান্না চলছে, মুরগীর মাংস কষানো হচ্ছে তাও কিনা দেশী মুরগী! সেই সাথে কেটে রাখা হয়েছে শীতের ফুলকপি, নতুন আলু, টমেটো, ধনেপাতা, কাঁচা মরিচ! সালাদের জন্য শসা, গাজর এসব! দেখে তো মাথাই খারাপ। এসব তাহলে কাদের জন্য? জম্মু হাঁটা ধরেছে, আমি থামলাম, আমার থেকে যাওয়া দেখে জম্মুও থামলো।

এবার কিচেনে ঢুকে পড়লাম সরাসরি, দুজনই। গিয়ে ম্যানেজারকে ধরলাম, ভাই আমাদের কাছে কিছু বিক্রি করেন?
না ভাই, এটা আমাদের স্টাফদের জন্য।
আপনারা অন্য কিছুর অর্ডার করতে পারেন, আমরা রেডি করে দিতে পারি।
না ভাই ভাত-ই খাবো!
কিছু করার নাই ভাই, আমাদের তেমন প্রস্তুতি নাই। এগুলো আমাদের রাতের খাবার।
ফিরে তাকালাম পিছন দিকে। চলে আসতে আসতে বলতে লাগলাম……
ভাই ১২ দিন হলো ভাত খাই না! একটু ভাতের জন্য এতদূর আসলাম, আপনারা তো দুপুরে খেয়েছেন, আবার রাতে খাবেন, আবার সামনের স্টেশন থেকে খাবার কিনেও রান্না করতে পারবেন। আর আমরা সেই ১২ দিন আগে শেষ ভাত খাইছি ভাই! অথচ টাকা পয়সা সবই আছে শুধু ভাত তাই খাইতে পারি নাই কোথাও!
ভাবছিলাম যশোর এসে ভাত খাবো, সেও ট্রেনের জন্য খেতে পারলাম না, তারপর ভাবলাম ট্রেনে উঠে খাবো, সেই ব্যবস্থাও নাই! কবে যে ঢাকায় পৌঁছাবো আর একটু ভাত খাইতে পারবো কে জানে? নাকি দেশের যে পরিস্থিতি ভাত না খেয়েই কোথাও মরে পড়ে থাকবো কে জানে?

ঠিক আছে ভাই আপনারা খান ভাত, আমরা তাহলে যাই? ম্যানেজার আর অন্যান্য স্টাফদের শুনিয়ে শুনিয়ে এই কথাগুলো বলে ফিরে আসছিলাম। আসলে ওনাদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার জন্যই এগুলো বলছিলাম।
এই বলতে বলতে ফিরে যাচ্ছি, পিছন থেকে ম্যানেজার ডাক দিল। ফিরে গেলাম। তারপর বসতে বললে বসেও পড়লাম। এরপর ১০ বা ১৫ মিনিট উনাদের সাথে কোথায় গেলাম, কী দেখলাম, কী কী করলাম, সেসব গল্প আর ছবি দেখালাম। তারপর উনাদের যে এই কথাগুলো শুনে (১২ দিন ভাত না খাওয়া) কতটা খারাপ লেগেছে সেই কথা বললেন। এরপর উনারা আর আমাদেরকে না দিয়ে কিছুতেই ভাত খেতে পারতেন না বলেও জানালেন!
গল্পে গল্পে ১৫ মিনিট পরে টেবিলে এলো ধবধবে সাদা ভাত, শসা-গাজর-টমেটো-পিঁয়াজ-কাঁচা মরিচের সালাদ। ঘন মশুর ডাল, সাথে ধনে পাতার পাগল করা সুবাস! আহা গন্ধেই যেন খেয়ে নিয়েছিলাম অনেকখানি! তারপর এলো ফুলকপি-নতুন আলু-টমেটো আর ধনে পাতা দেয়া ধোঁয়া ওঠা তরকারী। আর এরপর, উহ সেই দেশী মুরগীর রোস্ট! আহা, মন প্রাণ মাতাল তখন!

এরপর আর কিচ্ছু মনে নেই। শুধু পাগলের মতো খেলাম দুইজনে। কতটুকু আর কতক্ষণ খেয়েছিলাম মনে নেই। শুধু মনে পড়ে যখন আর নড়তে পারছিলাম না, তখন থেমে ছিলাম দুজন! এরপর ধন্যবাদ দিয়ে উনাদের আর ছোট করিনি, তবে টাকা দিতে গেলে সেটা আর কিছুতেই নিতে চায়নি। কিছুতেই না, তাই শেষ পর্যন্ত দলের অন্য সদস্যদের জন্য কাটলেট আর মুরগীর কাবাব অর্ডার করে ওদের কাছে গিয়ে তোপের মুখে পড়লাম!
কারণ আমরা যে পেট পুরে খেয়ে এসেছি সেটা চোখ-মুখে আনন্দ আর তৃপ্তির রেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে ওদের সবার মুখ শুকিয়ে আমসত্ত্ব! ওদের অভিব্যক্তি ছিল এমন যে পারলে আমাদের দুইজনকে ধরে চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে ফেলে দেয়!

তবে আমরা দুজনেই চুপ করেছিলাম, ওদের খাবার না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত। এরপর ওদের গরম গরম কাটলেট আর মুরগীর কাবাব এসে পৌঁছানোর পরে হাসি ফুটেছিল সাথে আমাদেরকেও ক্ষমার চোখে দেখেছিল শেষ পর্যন্ত! নইলে গিয়েছিলাম প্রায়, “দো গাদ্দার” হয়ে!
উহ, সেই একপ্লেট ভাতের জন্য কি অভিনয়টাই না করতে হয়েছিল। ভেতো বাঙালির ভাত খাবার আকাঙ্ক্ষা বলে কথা? আর ভারত ভ্রমণে ভাতের হাহাকার থেকে…