গোমতী নদীর তীরের শহর কুমিল্লা। এই কুমিল্লায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থান, বিনোদন কেন্দ্র ও অন্যান্য পর্যটন স্থান। আমি আজকে আলোচনা করছি কুমিল্লা জেলার কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।
১। ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি কুমিল্লার ময়নামতিতে অবস্থিত। এর আরেক নাম কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি। স্থানীয়দের কাছে এটি ইংরেজদের সমাধি নামে অধিক পরিচিত। এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭৩৭ জন সৈন্যের সমাধি রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে নানা ধর্ম ও ভাষার মানুষ। তাই এখানে প্রতি বছর নভেম্বর মাসে বিভিন্ন ধর্মগুরুদের সমন্বয়ে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

পুরো সমাধিক্ষেত্র জুড়ে অসংখ্য গাছপালা রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে রয়েছে ফুল গাছ। ঝিরিঝিরি বাতাসে সমাধির গায়ে যখন কৃষ্ণচূড়া সহ নানা রঙের ফুল পড়তে থাকে, তখন মনে হয় প্রকৃতিও যেন বীর যোদ্ধাদের শ্রদ্ধায় নিবেদিত। প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে অনেক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে এই সমাধিক্ষেত্রে।
২। শালবন বৌদ্ধ বিহার
বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শনের নাম শালবন বৌদ্ধ বিহার। এটি কুমিল্লা জেলার কোটবাড়িতে ময়নামতি জাদুঘরের কাছাকাছি অবস্থিত। এখানে এক সময় শাল ও গজারির ঘন বন ছিল বলে বিহারটির নাম হয় শালবন বিহার। আপনি যদি কখনো পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার দেখে থাকেন তবে নিশ্চয় পরস্পরের সাথে অনেকটা সাদৃশ্য খুঁজে পাবেন।

শালবন বৌদ্ধ বিহারটি ১৮৭৫ সালের শেষের দিকে কোটবাড়ি এলাকায় রাস্তা খননের কাজ করতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়। তারপর থেকে অনেক দিন যাবৎ এর নির্মাণ ইতিহাস নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে। পরবর্তীতে এখান থেকে প্রাপ্ত একটি শিলা থেকে অনুমান করা হয়- এটি ৭ম শতাব্দীর শেষের দিকে দেব বংশের চতুর্থ রাজা শ্রী ভবদেব কর্তৃক নির্মাণ করা হয়েছে।
বিহারে সর্বমোট ১৫৫টি কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলোতে মুলত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বসবাস করত। এছাড়া একটি বড় হল ঘর রয়েছে, যা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের খাবারের ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো বলে অনুমান করা হয়।
এখান থেকে উদ্ধারকৃত প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রৌঞ্জ ও মাটির মূর্তি, আটটি তাম্রলিপি, সিলমোহর, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটাগুলো এখন ময়নামতি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
৩। বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড)

অনেকেই হয়তো জেনে অবাক হয়েছেন যে, আমি কুমিল্লার দর্শনীয় স্থানগুলোর তালিকায় একটি সরকারী অফিসের নাম এনেছি। আসলে বার্ড একটি অফিস হলেও এটি একটি বিনোদন কেন্দ্রের থেকে কম নয়। এখানে গেলে উপভোগ করা যায়, সবুজে ঘেরা ছায়া নিবিড় পরিবেশ ও পাখির কলকাকলি। এছাড়া এখানে রয়েছে পিকনিক স্পট ও আবাসিক ব্যবস্থা। কুমিল্লা ভ্রমণে গেলে ঘুরে আসতে পারেন এখান থেকেও। এটি শালবন বৌদ্ধ বিহারের কাছাকাছি হওয়ায় সহসায় এক দিনে দুই স্বাদ নিতে পারবেন।
৪। শাহ সুজা মসজিদ
মোগল সম্রাট শাহজাহানের নাম আমরা সবাই জানি সেই সাথে জানি তাঁর অনন্য সৃষ্টি তাজমহল সম্পর্কেও। তাই এই সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই, কিন্তু এখন যেটা বলতে চাই সেটা সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজা সম্পর্কে। সুজা যে সম্রাট শাহজাহানের আদর্শ পুত্র ছিলেন তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় এই শাহ সুজা মসজিদটি দেখলে।

শাহ সুজা মসজিদের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ কৈলাসচন্দ্র সিংহ তার রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস গ্রন্থে বলেন, ‘গোমতী নদীর তীরে কুমিল্লা নগরীতে সুজা মসজিদ নামক একটি ইষ্টক নির্মিত বৃহৎ মসজিদ অদ্যাপি দৃষ্ট হয়ে থাকে। এ মসজিদ সম্পর্কে দুই ধরনের প্রবাদ শ্রুত হওয়া যায়। প্রথমত, সুজা ত্রিপুরা জয় করে বিজয়বৃত্তান্ত চিরস্মরণীয় করার জন্য এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।
দ্বিতীয়ত, মহারাজ গোবিন্দ মাণিক্য সুজার নাম চিরস্মরণীয় করার জন্য নিমচা তরবারি ও হিরকাঙ্গুরীয়ের বিনিময়ে বহু অর্থ ব্যয় করে এ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। দ্বিতীয় প্রবাদ অপেক্ষা প্রথমোক্ত প্রবাদ সত্য বলে ধারণা করা হয়।’ (রাজমালা : পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪, ২য় ভাগ অধ্যায় : ৭)।
৫। বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন
বীরচন্দ্র গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তন ভবনটি ১৯৮৫ সালের ৬ মে তারিখে নির্মাণ করা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার চাকলা রোশনাবাদের জমিদার নরেশ মহারাজ ‘বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুর’। প্রতিষ্ঠাকালে এটি শুধুমাত্র পাঠাগার হিসেবে থাকলেও, বর্তমানে এটিই কুমিল্লার গণ পাঠাগার ও নগর মিলনায়তন। কুমিল্লাতে এটি টাউনহল নামে পরিচিত।

পাঠাগারটিতে বর্তমানে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, রাজমালা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মনীষীদের রচনাসমগ্র রয়েছে। এখানে বাংলা ও ইংরেজি ভাষা মিলিয়ে মোট ৩০,০০০ বই রয়েছে, যা ৬৩টি আলমারিতে সুসজ্জিত রয়েছে। ভাষার ২৪ হাজার বই ও ইংরেজি ভাষার ছয় হাজার বই রয়েছে।
ঐতিহাসিক এই টাউনহলে পদধূলি দিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরো অনেক মনিষীরা।
৬। গোমতী নদী
চীনের দুঃখ হুয়াংহো কথাটির সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। আমি এখন বলছি কুমিল্লার দুঃখ গোমতী নদীর কথা।
গোমতী নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্ব প্রান্তীয় পার্বত্য অঞ্চল ডুমুর নামক স্থান থেকে উৎপন্ন হয়েছে। নদীটি উৎস থেকে পার্বত্যভূমির মধ্য দিয়ে ১৫০ কিঃমিঃ আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে কুমিল্লা সদর উপজেলার কটক বাজারের কাছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে।

বাংলাদেশে প্রবেশের পর এটি তাঁর সর্পিল প্রবাহ পথকে ধরে রেখেই কুমিল্লা শহরের উত্তর প্রান্ত এবং ময়নামতীর পূর্ব প্রান্ত অতিক্রম করে বয়ে চলেছে, যার শেষ হয়েছে মেঘনা নদীতে পতিত হওয়ার মাধ্যমে।
গোমতী নদী তীব্র স্রোত সম্পন্ন একটি পার্বত্য নদী। আকস্মিক বন্যা এর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। মূলত সেই কারণেই একে কুমিল্লার দুঃখ বলা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক গৃহীত কিছু সংখ্যক প্রকল্প বাস্তবায়নের পর গোমতী দৃশ্যত নিয়ন্ত্রণাধীন। সময় পেলে ঘুরে আসতে পারেন গোমতী নদীর তীর থেকে।
পরবর্তী পর্বে থাকছে
১। কবি তীর্থ দৌলতপুর (জাতীয় কবি কাজী নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত স্থান), ২। উটখাড়া মাজার, ৩। বায়তুল আজগর জামে মসজিদ, ৪। নূর মানিকচর জামে মসজিদ, ৫। নওয়াব ফয়জুন্নেছার স্বামী গাজী চৌধুরীর বাড়ী সংলগ্ন মসজিদ, ৬। জাহাপুর জমিদার বাড়ি, ৭। ধর্ম সাগর, ৮। রূপবান মুড়া, ৯। ইটাখোলা মুড়া, ১০। ভোজ রাজার বাড়ী, ১১। আনন্দ বিহার, ১২। কোটিলা মুড়া, ১৩। চারপত্র মুড়া, ১৪। রানী ময়নামতি প্রাসাদ ও মন্দির, ১৫। রানীর কুঠি, ১৬। সতর রত্ন মন্দির ১৭। শচীন দেব বর্মণের রাজবাড়ি
Feature Image: NTV