ট্রেকিং যাদের আসক্তির পর্যায়ে পড়ে তাদের দিন-দুনিয়া জুড়ে শুধু কোথায় ট্রেকিং করা যায়, কী কী সাথে নিয়ে যাওয়া যায়, নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা নেয়া যায় নাকি এসবই থাকে। ট্রেকারদের জগৎটাই যে সাধারণের চেয়ে ভীষণ অন্যরকম। যাযাবরের জীবন নিজের ইচ্ছেয় আপন করে নেয় প্রতিটি ট্রেকার। ট্রেকিং অভিজ্ঞতা আর রোমাঞ্চকর সব অভিযান জয়ের গল্প বেশ কিছু ট্রেকারদের করেছে বিশ্ববিখ্যাত। তবে অজ্ঞাতনামা ট্রেকারদের নিয়ে বিশ্বের কৌতুহলের সীমা নেই। সেই কৌতুহল আর ট্রেকারদের দুর্দান্ত অভিযানকে যান্ত্রিক পর্দায় নামাতে অনেক পরিচালক তৈরি করেছেন বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র। ট্রেকিংয়ে যাদের আগ্রহ প্রচুর সাথে চলচ্চিত্রেও সমান আগ্রহ রাখেন লেখাটি বিশেষ করে তাদের জন্য।
যারা ট্রেকিংয়ে আগ্রহ বাড়াতে চান তাদের জন্যও এই সিনেমাগুলো দেখা অনেক কার্যকরী হবে। প্রতিটি সিনেমায় যে জীবনাচরণ আর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা দেখানো হয়েছে তাদের কিছু পরিচালকদের নিজেদের তৈরি কাহিনী অবলম্বনে আবার কিছু সত্য ঘটনা থেকে বানানো। চলুন তাহলে দেখে আসা যাক বিখ্যাত সেসব চলচ্চিত্রের কাহিনীকল্প।
১. দ্য ওয়াইল্ডেস্ট ড্রিম, ২০১০
আমার দেখা এভারেস্ট সামিটের সবচেয়ে দুর্দান্ত চলচ্চিত্র ‘দ্য ওয়াইল্ডেস্ট ড্রিম’। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে সত্য ঘটনা অবলম্বনে। আমরা সবাই জানি মাউন্ট এভারেস্টের প্রথম আরোহী এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং নরগে। কিন্তু এটা খুব কম মানুষই জানে এডমন্ড হিলারির প্রায় ২৯ বছর আগে ১৯২৪ সালে একজন ব্রিটিশ ট্রেকার সর্বপ্রথম এভারেস্ট সামিটের জন্য বের হয়েছিলেন।
আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে এভারেস্ট ট্রেকার কোনার্ড এনকার এভারেস্টের কোলে খুঁজে পায় সেই হারিয়ে যাওয়া অদম্য মানুষটিকে। ব্যক্তিত্বটির নাম জর্জ মেলোরি। ইতিহাস, ডকুমেন্টেশন আর প্রেম কাহিনীর আদলে বানানো এন্থনি গেফেইনের এই দুর্দান্ত তথ্যচিত্র দেখলে বোঝাই যাবে না এতে মেলোরি অভিনয় করেননি, শুধুমাত্র তার স্ত্রীকে পাঠানো চিঠিগুলা পড়া হয়েছে। এভারেস্ট আর সহধর্মিণীকে সমানভাবে ভালোবাসা একজন পাগলাটে মানুষের এভারেস্ট অভিযান অনুভব করতে হলে দেখতে হবে সিনেমাটি।
২. এভারেস্ট, ২০১৫
এভারেস্ট এক্সপিডিশনের আদ্যোপান্ত যদি জানার ইচ্ছে থাকে তবে এই সিনেমাটি অবশ্যই দেখতে হবে। বালতাসার করমাকুর পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটিও সত্য কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। ১৯৯৬ সালের এভারেস্ট তৎকালীন ট্রেকারদের কাছে ভয়ানক এক স্বপ্নের মতো ছিল।
ঐ বছর মে মাসের ১০ তারিখ বেস ক্যাম্প আর গোটা দুনিয়ার মানুষ অভিজ্ঞতা লাভ করে এভারেস্টে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় আর প্রাণ হরণকারী তুষারঝড়ের, যার কবলে পড়ে তৎকালীন নামকরা এভারেস্ট ট্রেকার রবার্ট রব এডউইন হল আর স্কট ফিশার। মরণফাঁদ এভারেস্টের বৈরী ঝড়ো হাওয়ার মাঝে টিকে থাকার লড়াই, আত্মত্যাগ আর বেস ক্যাম্প ৩ থেকে শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোর আকুলতা চলচ্চিত্রটিকে একটি মাস্টারপিসে পরিণতে করেছে।
৩. শেরপা, ২০১৫
এভারেস্টের নেপালি গাইডদের শেরপা বলা হয়। প্রতি বছর প্রচুর ট্রেকার নিয়ে শেরপারা উঠে যান এভারেস্টের চূড়োয়। তেমনি এক শেরপা পুরভা তাশি। এখন পর্যন্ত মোট ২১ বার এভারেস্ট সামিট করেছে পুরভা। ২০১৪ সালে আরো ১৫ জন শেরপা নিয়ে সে তার ২২তম এভারেস্ট সামিটে যায় হিমালয়ান এক্সপেরিয়েন্সের নিউজিল্যান্ড প্রতিনিধি রাসেল ব্রাইসের সাথে।
যদি সে ২২ তম সামিট সম্পন্ন করতে পারে তবে এটা হবে সবচেয়ে বেশি বার এভারেস্টের উঠার নতুন বিশ্ব রেকর্ড। সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরীকৃত এই চলচ্চিত্রে শেরপা আর ট্রেকারদের আন্তঃসম্পর্কের ধরণ দেখা যাবে, তবে ১৯৫৩ সালের এডমন্ড হিলারি আর তেনজিং এর মাধ্যমে শুরু হওয়া শেরপা-ট্রেকার সম্পর্কের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। সাদা শুভ্র বরফের ভয়ংকর সুন্দর এভারেস্টের ইতিহাসে বিষাদময় কাব্য নিয়ে তৈরী শেরপা সিনেমাটি। সেই কালো অধ্যায় সম্পর্কে জানতে হলে দেখতে হবে পুরো সিনেমাটি।
৪. ১২৭ আওয়ার্স, ২০১০
গতানুগতিক ট্রেকিং চলচ্চিত্র থেকে একটু সরে আসা সিনেমা হচ্ছে ১২৭ আওয়ার্স। আমেরিকান তরুণ মাউন্টেইনার ও অ্যাডভেঞ্চারার আরণ রালস্টোন তার কোনো এক সপ্তাহান্তে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইউটাহ এর ব্লু জন ক্যানিয়নে। সাথে আছে এক বোতল পানি আর একটি ভিডিও ক্যামেরা।
গিরিখাত চড়তে গিয়ে সে আবিষ্কার করে গিরিখাতের মধ্যে পড়ে গেছে সে আর তার হাত আটকে আছে এমন এক পাথরে যা চাইলেই সরানো যাচ্ছে না। এখান থেকে মূল গল্প শুরু চলচ্চিত্রের। টানা ১২৭ ঘণ্টা মানে সাড়ে পাঁচ দিন আরণ একই জায়গায় আটকে ছিল। সারা জীবনের ফ্ল্যাশব্যাক সেই সাড়ে পাঁচ দিনের টিকে থাকার চরম লড়াইয়ে উঠে এসেছে চলচ্চিত্রটিতে। হাল ছেড়ে না দেয়ার এই চলচ্চিত্রটিও সত্য ঘটনা অবলম্বনে। একবার ভাবুন এটা আসলেই হয়েছিল আরণ রালস্টোন নামক এক ট্রাভেলারের সাথে! কীভাবে সে ফিরে এসেছে তা জানতে সিনেমাটি দেখতে হবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
৫. মাউন্টেইন, ২০১৭
চলচ্চিত্রের নামই মাউন্টেইন, তাই চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। তবে এই সিনেমার মূল বিষয় হিসেবে দেখানো হয়েছে শুধু ট্রেকিংই পাহাড়ে করা একমাত্র কার্যকলাপ হতে পারে না। রক ক্লাইম্বিং, মাউন্টেইন সাইক্লিং, বরফের পাহাড়ে স্কেটিং সহ পাহাড়ে করা যায় এমন সব দুর্দান্ত কার্যকলাপে ভরপুর ডকুমেন্টারি শ্রেণীর এই সিনেমাটি।
অসাধারণ ক্যামেরার কাজ আর শ্বাসরুদ্ধকর সব সাউন্ড ইফেক্ট যে কতটা বাস্তবে রূপ নিতে পারে তা এই সিনেমা না দেখলে বোঝা সম্ভব না। বিশেষ করে কোনো পর্বতের কথা বলা না হলেও এভারেস্টের রেঞ্জের দিকেই তাক করা ছিল পরিচালক জেনিফার পিদমের ক্যামেরা। পাহাড়-পর্বত সম্পর্কে যারা প্রচণ্ড মরিয়া হয়ে থাকেন তাদের সব দুর্দশা আর পিপাসা দূর করার যান্ত্রিক উপায় এই চলচ্চিত্রটি।
ফিচার ইমেজ- inspiredtraveller.in