ছোটবেলায় বাবার সাথে কোথাও একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম। বাবার পরিচিত এক লোকের সাথে দেখা। আমাকে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হে খোকা, তোমার ঠিকানা কই?’
আমি বুক চিতিয়ে জবাব দিলাম, ‘গ্রাম- ভবানীপুর, ডাকঘর- বাঘুটিয়া, থানা- অভয়নগর, জেলা- যশোর আর দেশ- বাংলাদেশ।’
লোকটি হেসে ফেললেন। বললেন, ‘বাহ! তোমার তো আসলেই ভয়ডর নেই! আসলেই অভয়নগরের বাসিন্দা তুমি!’
আমার মাথায় শব্দটা গেঁথে গেলো। এই রে। আসলেই তো তাই। অভয়নগর মানে তো যে নগরে ভয় নেই। এমন কেন জায়গার নাম? এখানে যারা থাকে, তাদের কি আসলে ভয়ডর নেই? সেই থেকে জায়গার নামের প্রতি আমার আগ্রহের শুরু। যেখানেই যাই সেই জায়গার নামকরণের ইতিহাস আমার নেশা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে আলাদা গল্প। আজ বরং অভয়নগরের ইতিহাস আর তার খোঁজে যাওয়া যাক। অসাধারণ সে ইতিহাস। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে এক দুঃখী রাজকুমারী আর এগারটি মন্দিরের গল্প।
অভয়নগরের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে বারো ভুঁইয়াদের আমলে। বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম শক্তিশালী ছিলেন যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য। মুঘলদের সাথে লড়াই করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অত বড় মুঘল সেনাবাহিনীর সাথে পেরে ওঠা কি সম্ভব? তিনিও পারলেন না। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। তিনি পরাজিত ও বন্দী হলেন। রাজপরিবারের সদস্যরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেন। এদের একজন বসত গড়েন যশোরের চাঁচড়ায়। উল্লেখ্য, ইতিহাসে যে যশোর রাজ্যের কথা পাই, তা কিন্তু আজকের সাতক্ষীরা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।
তো চাঁচড়া রাজবংশের একজন নীলকণ্ঠ রায় খুব প্রভাব প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন। রাজার মতোই ছিল তার শান শওকত। তার আমলে এই এলাকায় পর্তুগীজ জলদস্যুদের প্রভাব বেড়ে যায়। তারা সুন্দরবন হয়ে এই এলাকায় ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম লুঠ করে নিয়ে যেত। ধরে নিয়ে যেত যুবতী কন্যা আর শিশুদের। তাদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত।
এই অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাজা নীলকণ্ঠ রায় ভৈরব নদীর তীরের জায়গা ঠিক করে সেখানে দুর্গ নির্মাণ করে বসত শুরু করেন। এখানে তার ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক কন্যা। তিনি তার নাম রাখেন অভয়া। অভয়া বড় হয়ে উঠলে রাজা তার বিয়ের বন্দোবস্ত করেন। পাত্র ছিল তখনকার অন্যতম প্রভাবশালী জমিদার বংশ নড়াইল জমিদারের সন্তান নীলাম্বর রায়ের সাথে। কিন্তু কপাল মন্দ! অদৃষ্টের পরিহাসে বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই অভয়ার স্বামী নীলাম্বর রায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান নীলাম্বর রায়। ফলে বিধবা হয়ে যান রাজকন্যা অভয়া।
অভয়া ছিলেন শৈব অর্থাৎ মহাদেব শিবের উপাসক। তিনি পিতার কাছে অনুরোধ করলেন, তিনি তার বাকি জীবন মহাদেবের আরাধনা করেই কাটিয়ে দিতে চান।
নীলকণ্ঠ রায় মেয়ের ইচ্ছা শুনলেন। তারপর রাজবাড়ির সন্নিকটে মেয়ের জন্য মহাদেব শিবকে উৎসর্গ করে মন্দির নির্মাণ করে দেন। একটি দুইটি নয়, ৬০ একর জায়গার উপর ১১টি শিব মন্দির নির্মাণ করলেন তিনি। আর মেয়ের নাম অনুসারে নগরের নাম রাখেন অভয়ানগর। এই অভয়ানগরই কালক্রমে পরিচয় পেয়েছে অভয়নগর নামে।
আমি অনেক আগে একবার গিয়েছিলাম সেখানে। তখন ভেঙেচুরে ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে গিয়েছিল মন্দিরগুলো। তাছাড়া জাতের ক্যামেরা কিংবা ফোনও ছিল না। তাই ছবি তুলতে পারিনি। এবার হাতে একটা ডিএসএলআর। প্লান করলাম শুধু ছবিই নয়, একেবারে ভিডিও ডকুমেন্টারি বানাব এবার। একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে দেশের মানুষকে জানিয়ে দেই এই অপূর্ব স্থাপত্যের কথা।
সেই কথা মোতাবেক বন্ধু জ্যোতিকে নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম খুলনা থেকে। খুলনা থেকে যশোরগামী যে বাসগুলো আছে তার মধ্যে গড়াই আর রূপসা পরিবহনের বাসগুলো দ্রুত চলে। বাকিগুলো এই চলে এই থামে! যদিও গড়াই আর রূপসাতে ভিড়ও তুলনামূলক বেশি, তবুও তাতেই চড়ে বসলাম। সেখান থেকে নামলাম বন্দরনগরী নওয়াপাড়ার নুরবাগ খেয়াঘাটে। ভাড়া ত্রিশ টাকা মাথাপ্রতি।
অন্য পথেও নাকি যাওয়া যায়। কিন্তু এটি আমার পরিচিত পথ। তাই এই পথেই আসা।
নুর বাগ খেয়াঘাট পার হয়ে ওপার থেকে অভয়নগর পুরনো মন্দির দেখতে যাব বলতেই অনেক মোটরসাইকেল চালক এগিয়ে এলো। ওরা ভাড়া টানে, লোকাল ভাষায় বলে খ্যাপ টানে। আমরা একজন মোটরসাইকেল চালককে বেছে নিলাম। ১০০ টাকায় দরদাম ঠিক হলো। যাত্রা শুরু হলো। পথে নানান দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা সিংগাড়ী বাজার হয়ে ভাট পাড়া বাজারে পৌঁছুলাম। এই ভাট পাড়ার একটি প্রাচীন ইতিহাস আছে। অন্যপর্বে হয় তা তুলে ধরব।
অভয়নগর যেতে হয় ভাটপাড়া বাজারের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেখানে রাস্তা সংস্কারের কাজ চলছে। ফলে গ্রামের মধ্য দিয়ে ঘুরে ঘুরে যেতে হলো।
যশোর বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু এলাকা। এখানে বাঁশ খুব ভালো জন্মে। গ্রামের মধ্যে ঢুকতেই মনে হলো বেলা পড়ে এসেছে। কারণ আর কিছুই নয়। রাস্তার দু’ধারে আশেপাশে বাঁশের প্রাচুর্য। রাস্তার দু’ধার থেকে তারা এসে মাথার উপরে ঝুঁকে পড়েছে। এ যেন ইউরোপের ক্যানোপি-রোড। আমরা সেই পথ ধরে মোটরসাইকেল চেপে পৌঁছুলাম এগার শিব মন্দিরে।
ভেবেছিলাম রোদ ভরা সেই আকাশের নিচে কত শতকের পুরনো এক ধ্বংসস্তূপের শেষ নিদর্শন দেখব। কিন্তু এ কী? চোখের সামনে নতুনের মতো জ্বলজ্বল করছে লাল রঙের এগারটি মন্দির। কিন্তু এগুলো তো তেমনটি নয়, যেগুলো আমি সাত বছর আগে দেখে এসেছিলাম।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এগুলো সংস্কার করেছে। মন ভালো হয়ে গেল। অনুপম এই নিদর্শন হারিয়ে যাবে- একটি দুঃখ আমার বুকে এতদিন পাথর হয়ে চেপে বসেছিলো। আজ তা নেমে গেল। আমার বন্ধু জ্যোতি দেখি হা করিয়ে তাকিয়ে রয়েছে! এগারটি মন্দির একটি আয়তাকার ক্ষেত্রের পরিধি বরাবর স্থাপন করা হয়েছে। তাদের চুনসুরকি ধ্বসে গেছে কবেই। ইটগুলোও ক্ষয়ে গিয়েছিল। পুনঃসংস্কার করা হয়েছে কিন্তু সেই চুনসুরকি আর লাগায়নি। বরং পরিষ্কার করা হয়েছে শুধু। তাতেই তাদের সেগুলোকে দেখাচ্ছে মনোহর, সুনিপুণ, শ্বাসরোধী!
সে রূপের বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। তাই ক্যামেরা হাতে করে নেমে পড়লাম। চেষ্টা করলাম তার সমস্তটা তুলে আনতে। কতদূর পেরেছি জানি না। আপনারাই দেখে নিন নিচের ডকুমেন্টারি থেকে।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে বাস কিংবা ট্রেনে খুলনা পৌঁছাবেন। বাকিটা লেখার মধ্যেই বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
Feature Image: Amitav Aronno