হার্ডিঞ্জ ব্রিজ থেকে লালন শাহ সেতুর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি, অন্ধকারাচ্ছন্ন পাকশি স্টেশনে ষ্টেশন মাস্টারের অফিস বা টিকিট কাউন্টারের অনুপস্থিতি দেখে ভৌতিক অনুভূতির সঞ্চার হয়েছে। সব মিলিয়ে জায়গাটিকে অদ্ভুত সুন্দর জায়গা বলে বিশেষায়িত করলে ভুল হবে না। তাই ভেবেছি ঈশ্বরদী গিয়ে ট্রেন থেকে নেমে হোটেল ঠিক করেই রওনা হবো হার্ডিঞ্জ ব্রিজের উদ্দেশ্যে।

দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে। এখানে নেমে কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। ইতি-উতি করে শহরের আলো খোঁজার চেষ্টা করলাম। চোখ পড়লো স্টেশনের অপর পাশের আলো-ঝলমলে বিল্ডিংগুলোর দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ওদিকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শহরের ব্যস্ততা। চোট পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সামনেই বিশাল ওভার ব্রিজ। ব্রিজের উপর থেকে স্টেশনের ব্যস্ততাকে খানিকটা মায়াবী মনে হচ্ছিল। অবশ্য এই রাতের পুরো ভ্রমণটাই আমার জন্য মায়াবী ছিল। তবু যেন ঈশ্বরদী রেল স্টেশন সামথিং ডিফারেন্ট।
ঈশ্বরদী রেল স্টেশনটি প্রায় ১০০ বছরের পুরনো একটি রেল জংশন স্টেশন ও ইয়ার্ড। এছাড়া এটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম বৃহত্তম রেলওয়ে জংশন, যা পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার মূল শহরে অবস্থিত। এই রেল স্টেশনের উপর দিয়ে অনেকবারই ঢাকা গিয়েছি, কিন্তু নামা হয়নি কখনো। ঢাকা যাওয়ার পথে পাকশি স্টেশনের উপর দিয়ে যখন ট্রেন এসে থামত ঈশ্বরদীতে, তখন আমার কাছে ব্যপারটি বিচিত্র মনে হতো। ভাবতাম এতো কাছাকাছি আবার স্টেশন হয় নাকি! অনেক ইচ্ছে হতো নেমে দেখার, কিন্তু ট্রেন হারানোর ভয়ে নামতে পারিনি।

ওভার ব্রিজ থেকে নেমে একটু সামনে এগিয়ে যেতেই মানুষের কোলাহল। এটা ওয়েটিং রুম। কিছু যাত্রী বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে শহরের মধ্যে প্রবেশ করলাম। চারদিকে ঈদের কেনাকাটার ধুম। মোটর চালিত রিক্সা-অটো রিক্সার পাল্লার মাঝে এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে আসতে হয়। এক পাশে বড় বড় বিল্ডিং আর অন্য পাশে সারি সারি এক তলা দোকান। মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলা ব্যস্ততম রাস্তাটা যেন উঁচু-নিচুর সেপারেশনের কাজ করছে। উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলোর মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সব চেয়ে উঁচু বিল্ডিংটির দিকে তাকাতেই দেখি, লেখা আছে হোটেল রয়্যাল প্যালেস। আমি তখন মনে মনে হোটেলই খুঁজছিলাম।
এগিয়ে গেলাম হোটেলটির দিকে। বিলাসবহুল এই সুউচ্চ ভবনে কোনো রুম ফাঁকা নেই, জেনে বেশ অবাক হলাম। কারণটা স্বাভাবিক, ঈশ্বরদীতে ঈদের সময় এত পর্যটক এলো কোথা থেকে! সে যাই হোক, হতাশা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখে পড়লো পাশাপাশি দুটি হোটেল, একটি হোটেল ঈশ্বরদী আর অন্যটি উত্তরা আবাসিক। দুটিই ছোট মাপের হোটেল। ঢুকে পড়লাম হোটেল ঈশ্বরদীতে। সেখানে যেতেই রুম দেখানোর আগেই একটা কন্ডিশন জানিয়ে দিলো। ম্যানেজার বলল, যদি সকাল ছয়টার আগে বাড়ায় (বেরিয়ে) পড়তে পারেন, তবে রুম দেখতে পারেন। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগল না। ব্যাটা রুম না দেখিয়েই কন্ডিশন দিচ্ছে, যা ব্যাটা থাকব না তোর হোটেলে! বেরিয়ে পড়লাম সেখান থেকেও।

এবার গেলাম উত্তরা আবাসিকে। এটি বেশ ছিমছাম একটি হোটেল, কিন্তু ব্যবহারটা ভালো ছিল। তারা আগে রুম দেখিয়ে তবেই বিনয়ের সাথে বললেন, কাল যেহেতু ঈদ, সেহেতু আপনাকে সকাল ছয়টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। আমরা সবাই ঈদের নামাজ পড়ব তো! আমি তাদের সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করে জানালাম, আমিও মুসলিম, তাই ওটা নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। সকালে ডেকে দিলেই হবে।
ব্যস, হয়ে গেল। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বের হওয়ার সময় হোটেলের মালিক কাম ম্যানেজারের কাছ থেকে পাকশি যাওয়ার রাস্তাটা জেনে নিলাম। ঠিকানা বলার সময় তিনি জানালেন, এই রাতে ওখানে না গেলে কি হয় না, যদি কোনো বিপদ হয়! আমি জিজ্ঞেস করলাম, কI বিপদ হতে পারে! তিনি ক্যামেরার কথা উল্লেখ করে বললেন, দেশের যে অবস্থা তাতে যদি ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়েন। আমি তার সতর্ক বার্তাটি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আর তাকে বললাম, সেখানে আমাকে যেতেই হবে এবং এই রাতেই যেতে হবে।
হোটেল মালিকের নাম সুমার খান। তাঁর দেওয়া রাস্তা অনুযায়ী প্রথমে রেলগেট গেলাম। সেখান থেকে পাকশি যাওয়ার কোনো গাড়ি নেই। রাত ১২টা বাজে। এই রাতে কেউ যেতে চাচ্ছে না। কী আর করার, একটু একটু করে এগোতে লাগলাম। তিনটি গাড়ি পরিবর্তন করার পর গিয়ে পৌঁছালাম ঈশ্বরদী ইপিজেডের গেটে। এখান থেকে পাকশি বেশি দূরে নয় কিন্তু যেহেতু মধ্যরাত আর আমার কাছে জায়গাটি অপরিচিত, সেহেতু রিক্সাওয়ালারা হাঁকিয়ে ভাড়া চাইতে লাগল। দুইশত থেকে নেমে এক পর্যায়ে এক শত টাকায় ফিক্স করলাম।

রিক্সা এগিয়ে চলেছে। চারপাশের অন্ধকার ঠেলে দু’একটা গাড়ি আমাদেরকে ক্রস করে যাচ্ছে। পরিবেশটা বেশ রোমাঞ্চকর হয়েই ধরা দিচ্ছে। এভাবে যেতে যেতে রিক্সাটা এক সময় একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করল। সুড়ঙ্গের অপর পাশে আলোর ঝলকানি। তাই তেমন একটা ভয় লাগে না।
রিক্সাটা ঐ আলোর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। নিয়ন আলোই সজ্জিত এই বিশাল এলাকাটা সম্পর্কে রিক্সাওয়ালার কাছে জানতে চাইলাম। সে জানালো, ওটা পারমাণবিক। আমি এর মানেটা মেলাতে পারছিলাম না, পারমাণবিক! মাথা চুলকাতে চুলকাতে বুঝতে পারলাম, এটাই সেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশ দিয়ে রিক্সাটা এগিয়ে চলেছে। খানিক দূরে গিয়ে আর তাকে দেখা যায় না; গাছের আবডালে ঢেকে গেছে। এবার সামনে পড়ে একটি গোলচত্ত্বর। এখান থেকে দুই দিকে দুইটি রাস্তা চলে গেছে; একটা লালন শাহ ব্রিজে আর অন্যটি হার্ডিঞ্জ ব্রিজে। বেড়ি বাঁধের মতো দেখতে লম্বা পাড়ের পাশ দিয়ে রিক্সাটা এগিয়ে চলল, হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দিকে। এটা আসলে বেড়ি বাঁধ নয়; উঁচু ট্রেন লাইনের রাস্তা। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের গোড়ায় গিয়ে রিক্সা থামাতেই তা পরিষ্কার হলো।

নীরব ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অপর প্রান্তে জীবন্ত লালন শাহ ব্রিজের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম অপলক। কোনো পিছুটান না থাকলে নিশ্চয়ই আমি এখানে সারা রাত থেকে যেতাম। পাশেই রয়েছে পুলিশ ক্যাম্প, তাই রিক্সাওয়ালা বার বার এখান থেকে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছিল। বলছিল, পুলিশ দেখলে ঝামেলা করতে পারে কাকা, তাড়াতাড়ি চলেন। আমি তবুও শুনলাম না।
আমি পুলিশের ছেলে পুলিশকে ভয় পেলে চলে! তাই বলে চুপ করিয়ে দিলাম তাকে। তবে সে আর বেশিক্ষণ থাকতে চাইল না। সমস্যা দেখিয়ে বাড়তি টাকার দাবি করে বসল। আমিও তাঁর সমস্যার কথা ভেবে বিদায় জানালাম, মনের মাঝে নেমে আসা নীরব, নিথর হার্ডিঞ্জ সাহেব ও জীবন্ত লালনকে।
Feature Image: Achinto Asif
Pingback:ঈদ ভ্রমণ: ঈশ্বরদীর পথে বিচিত্র এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা – Trip Zone