ভ্রমণ নিয়ে আমার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, সাধ আর পাগলামির কোন শেষ নেই যেন! নানা রকম ইচ্ছার মধ্যে অনেকদিন থেকেই একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারছিল। আর সেটা হলো পুজোর সময়ের বর্ণীল আর সন্ধ্যার ঝলমলে কলকাতা দেখার। কিন্তু কোনোভাবেই সাহস করে সেই কথা কাউকে বলতে পারি না আমি। এমনিতে আমি ভীষণ সাহসী সে সবাই কমবেশী জানে। কিন্তু যত সাহস সব আমার বিশাল বিশাল ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে।
ছোটখাটো ইচ্ছার কথা বলার সাহস কেন যেন আমার হয়ে ওঠে না। ঠিক আমার ভোঁতা অনুভূতিগুলোর মতো কিন্তু উল্টোভাবে। ছোট ছোট সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো আমাকে ঠিক নাড়া দেয়, কিন্তু বিশাল বিশাল ব্যাপারগুলো আমাকে সেভাবে কেন যেন নাড়া দেয় না। আমার অনুভূতিগুলো তখন ভোঁতা আর বোবা হয়ে যায় যেন!

যেমন সান্দাকফু ট্রেক, লেহ-লাদাখ-কাশ্মীরের রোড ট্রিপ, ভ্যালী অফ ফ্লাওয়ারস বা গোমুখ ট্রেকের ক্ষেত্রে আমি যখন অসীম সাহসী, বেপারোয়া মনোভাব আর অদম্য বন্যতায় সবকিছু ভেঙেচুরে চুরমার করে, তুচ্ছ করে সমাজ আর সংসার বেরিয়ে পড়তে পারি, পেরেছি। কিন্তু এই ছোট ছোট ইচ্ছাগুলোই কেন যেন আর প্রকাশ করতে সাহস পাই না! কিন্তু তাই বলে আমি আবার কোনো ইচ্ছা আর আকাঙ্ক্ষা থেকে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র কিছুতেই নই।
এইসব ছোট ছোট ভ্রমণ ইচ্ছার ক্ষেত্রে আমি অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে থাকি সাধারণত। কারণ বড় বড় পরিকল্পনাগুলো অদম্যতা আর অবাধ্যতা ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না কিছুতেই। তাই ছোট ছোটগুলো নিয়ে কোনো ঝামেলা না করে মাছরাঙা পাখির মতো সুযোগের অপেক্ষায় থাকি।

আর এই সুযোগের অপেক্ষায় থাকাই এক সময় আমার ইচ্ছা পূরণে সহায়ক হয়ে ওঠে, আমার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে থাকে। ঠিক তেমনি অসীম ধৈর্যের ফলাফল আর সুযোগের অপেক্ষায় চুপ করে থাকার তিন বছর পরে এমন মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেলাম আমি।
হ্যাঁ, আমার মাত্র তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে এই কাছের, প্রায় বাড়ির উঠোনের মতো হয়ে যাওয়া পুজোর কলকাতা দেখার জন্য। কারণ এই প্রস্তাব কখনো দেয়াই হয়নি, শুধু কোনো একদিন সুযোগের অপেক্ষায় থেকে থেকে।

তো গোমুখ থেকে ফেরার ঠিক ১৫ দিন পরে একদিন হুট করেই প্রস্তাব এলো, কাজিনের বিয়ের কেনাকাটা করতে সবাই কলকাতায় যাবে আর আমাকে সেখানে যেতে হবে ওদের গাইড হিসেবে। আমাকে কোনো খরচ করতে তো হবেই না, উল্টো সবকিছু আমার ইচ্ছামতো হবে! বাহ, কী দারুণ! আমি তো এমন সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম।
ব্যস, ঝটপট ছোট ব্যাগ গুছিয়ে, পাসপোর্ট পকেটে পুরে বেরিয়ে পড়লাম। লোকাল ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী স্ক্যানিয়ার মতো বিলাসবহুল বাসে চেপে বসলাম। একদম খরচহীন একটা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। সেটাও আমার অনেক দিনের ইচ্ছা পূরণের পূজোর ঝলমলে কলকাতা দেখার মতো সঠিক সময়ে।

পথে কিছু বিরক্তি ছিল, তা নিয়ে পরে আলাদা করে একটা লেখা লেখার ইচ্ছা আছে। এই লেখায় শুধু ঝলমলে, বর্ণীল আর বউ সাজে সেজে থাকা কলকাতার গল্প, আরও বিশেষ করে বললে পুজোর কলকাতার গল্প বলবো।
দুই দেশের বাস, কাস্টমস-ইমিগ্রেশন আর জ্যাম পেরিয়ে কলকাতায় পৌঁছালাম দুপুর গড়িয়ে। মনের মতো একটা হোটেল খুঁজে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়া। ওদের কেনাকাটা আর আমার পুজোর ঝলমলে কলকাতা দেখার বাসনায়। আমরা যখন নিউমার্কেট এরিয়া থেকে গড়িয়াহাট যাচ্ছিলাম ট্যাক্সিতে চেপে, তখন কলকাতার আকাশ আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝরিয়ে। বেশ লাগছিল ট্যাক্সির কাঁচের জানালার উপরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ফোঁটারা ঝরে পড়ছিল দেখে আর সেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি জানালার কাঁচে জমে জমে গড়িয়ে পড়ছিল বেশ বড় বড় ফোঁটা হয়ে।

কাঁচের জানালার বাইরে হাত দিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখার একটা অন্য রকম সুখ আছে। তাই সেই সুখের স্বাদ নিতে হাতে বৃষ্টি ছোঁয়ালাম। হাতের তালুতে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি সত্যি একটা অন্য রকম অনুরণন তুলেছিল, গাছের সবুজ পাতায় পাতায় বৃষ্টি ঝরে ঝরে জমে থেকে টুপটাপ পড়ছিল, গাড়ির উপরে মৃদু ছন্দ তুলেছিল। কালো পিচ ঢালা পথে বৃষ্টিরা যেন কাঁচের প্রলেপ বিছিয়ে দিয়েছিল সেদিন।
লাল-হলুদ-সবুজ সিগন্যাল বাতিগুলোয় বৃষ্টির স্পর্শরা যেন বর্ণীল আলোর ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে। এসব মুগ্ধতায় মুগ্ধ হতে হতে কতগুলো নাম না জানা মোড় পেরিয়ে, বেশ কিছু সিগন্যালের আলোর ঝলকানি দেখে, কাঁচের জানালায় বৃষ্টি নাচন দেখে আর বৃষ্টি সুখের স্পর্শ নিয়ে কখন যেন গড়িয়াহাট পৌঁছে গেলাম।

বেশ ভালো। পথ পেরোতে পেরোতেই নানা জায়গায়, বর্ণীল উৎসবের আয়োজন টের পেয়েছিলাম সাজসজ্জা দেখে। তবে ঢের বুঝতে পারছিলাম যে দিনের আলোতে নয়, দিনের আলো ফুরিয়ে যখন সন্ধ্যা নামবে আর সন্ধ্যা পেরিয়ে যখন রাতের আঁধার নামতে শুরু করবে তখন থেকে, সেই দিনের আলো নিভে যাওয়ার শুরু থেকেই উৎসবের নগরী তার রঙ ছড়াতে শুরু করবে।
পুজোর কলকাতা তার আলোর ঝলকানিতে মাদকতা ছড়াবে। উৎসবের কলকাতা নতুন সাজে সেজে উঠবে আমার চোখের সামনে। কলকাতার যে রূপ আগে কখনো দেখা হয়নি। দেখবো দেখবো বলে বহুদিন থেকে অপেক্ষায় থেকেছি।
ট্যাক্সি থেকে নেমে ওরা সবাই শাড়ির দোকানে গেল আর ওদেরকে সেখানে নামিয়ে রেখে আমি শুরু করলাম হেঁটে হেঁটে কলকাতা দেখা। যে যাই বলুক না কেন, কেন যেন হেঁটে হেঁটে কলকাতা শহর দেখা আমার কাছে খুব ভালো লাগে। মনে হয় যেন শত বছরের পুরনো কোনো এক সময় হারিয়ে গেছি বুঝি। অবশ্য এজন্য প্রিয় লেখক সুনীল অনেকটা দায়ী। তার বিভিন্ন ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা বইপত্র পড়ে পড়ে কলকাতা শহরের প্রতি আমার এত আকর্ষণ, অপার মুগ্ধতা আর অদ্ভুত এক আকর্ষণে মুষড়ে যাই সব সময়।

সেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি মধ্যেই আলতো করে ভিজে ভিজে ব্যস্ত গড়িয়াহাটের অলিতে গলিতে ঘুরতে লাগলাম। এরই মাঝে কখন যেন চারদিকে আলোর ঝলকানি শুরু হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। মানে দিনের আলো শেষ হয়ে গেছে। চারদিকের হাজারো আলোয় আলোকিত গড়িয়াহাট ছাড়িয়ে পুরো কলকাতা শহর। এই কলকাতা দেখবো বলেই তো আমার কত দিনের অপেক্ষা।
আজ তবে সেই অপেক্ষার শেষ হতে চলল বুঝি। এই আনন্দে মুহূর্তেই জল ঢেলে দিল মুষলধারের বৃষ্টি! যা একটু আগেই ছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি, সেটাই এখন মুষলধারে ঝরে পড়তে শুরু করলো। অগত্যা আমাকে ওদের সাথে শাড়ির দোকানে আশ্রয় খুঁজে নিতে হলো।
যাহ, হাতের নাগালে পেয়েও ঝলমলে, বর্ণীল আর আলোকিত পুজোর কলকাতা দেখা হলো না সেই মুহূর্তে। তাতে কী? আছি তো আরও দুই দিন আর আজকে তো কেবল সন্ধ্যা। পুরো রাতই তো পড়ে রয়েছে, ঝলমলে কলকাতা দেখার জন্য। তাই নিজেকে সেই অপেক্ষায় রেখে সবার সাথে বিয়ের কেনাকাটায় মনোযোগ দিলাম। কিন্তু মন তো আমার উচাটন হয়ে আছে, কখন বৃষ্টি থেমে যাবে আর আমি পথে নেমে যাবো, পুজোর বর্ণীল, ঝলমলে কলকাতা দেখতে।

ঠিক আধা ঘণ্টা পরে বৃষ্টি একেবারেই থেমে গেল। কিন্তু তখন ইচ্ছা হলেই আর বের হতে পারছি না। কারণ মূল কেনাকাটা, মানে কনের শাড়ি দেখার কাজটা তখনই শুরু হয়েছে। কী করি, কী করি?
কোনো রকমে হরেক রকমের শাড়ি কেনার মাঝে, দুই তিনটা কেনা হয়ে যাবার পরেই বেরিয়ে গেলাম। বাইরে বেরিয়ে তো আমি অবাক! কলকাতা যেন বিয়ের সাজে সেজেছে আজ! একেবারে সেজে টুকটুকে যাকে বলে।

চারদিকে লাল, নীল আলোর রোশনাই তো আছেই, যে যত খুশি সাজিয়েছে তার ইচ্ছা আর মনের মতো করে। শুধু দোকান পাট বা শপিং মল নয়, বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট এমনকি গাছপালা পর্যন্ত আলোয় আলোকিত হয়েছে উৎসব উপলক্ষে। কোন রঙ নেই পুরো পথ জুড়ে? লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, সোনালী, রুপালী, গোলাপি, কমলা। চোখ ধাঁধানো সব রঙের সম্মিলন ঘটিয়েছে উৎসবের নগরী কলকাতা।
উৎসব যেন শুধু মানুষের নয়, এই শহরের, এই শহরের সকলের, বাড়ি-ঘরের, পথ-ঘাটের, গাছপালার, লতা-পাতার, ইট, কাঠ আর পাথরেরও! আকাশের, বাতাসের, বৃষ্টির, রাতের আঁধারের, মেঘ কেটে গিয়ে আকাশকে আলোকিত করে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারাদেরও!

তাই তো বলি, কেন আমার পুজোর কলকাতা দেখার, কেন আমার আলো ঝলমলে, বর্ণীল কলকাতা দেখার এত আকর্ষণ, এত অপেক্ষা আর এত এত আগ্রহ? যাক তবুও সার্থকতা, অনেক দিন পরে হলেও অনেক স্বাদের, অনেক অপেক্ষার, অনেক ধৈর্য ধরে থাকার ফল পেয়ে গেছি আজ, পেয়েছি পরের দুই রাতেও। উৎসবের নগরী, ঝলমলে আর বর্ণীল কলকাতা উপভোগের স্বাদ।

আসলে এ যেন নতুন বউয়ের সাজে সেজে ওঠা এক অন্য কলকাতা। বর্ণীল, ঝালমলে আর আলোকিত কলকাতা।