বহুদিন থেকে যাবো যাবো করেও কেন আর কীভাবে যেন ২০০ বছরের পুরনো প্রাচীন এই স্থাপনায় যাওয়া হয়ে উঠছিল না। আর একটা জায়গায় যে যাবো, নতুন কিছু একটা যে দেখবো সেজন্য তো স্থানীয় মানুষজনের তাদের সেই স্থাপনার প্রতি ন্যূনতম আগ্রহ থাকতে হবে, মানুষকে বলতে হবে, জানাতে হবে। তা তো নয়ই, বরং সবাই দেখি আরও নিরুৎসাহিত করেছে বারবার। যে কারণে বেশ কয়েকবার বের হয়েও এত এত নিরুৎসাহিত মুখ দেখে আর যেতেই ইচ্ছা করেনি।
আর তাছাড়া আপনি যদি অদম্য সাহসী কেউ না হন, তবে এই ধরনের প্রাচীন আর প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্থাপনার কাছে একা একা যেতে একটু কেমন কেমন যেন লাগে। ঠিক ভয় না হলেও, কেমন গা ছমছমে একটা অনুভূতি হয়। তাই সেখানে যেতে কাউকে সঙ্গী পাওয়া তো দূরের কথা এখানে যাবো শুনলেই সবার অবাক দৃষ্টি, কী আছে ওখানে?
ধুর এক জঙ্গলের মধ্যে ভেঙে ভেঙে প্রায় গুড়িয়ে যাওয়া একটা রাজবাড়িতে দেখার কী আছে? শুধু কিছু ইট, সুরকি, লোহার বিম আর কয়েকটা মূর্তি আছে সেখানে। এসব কেউ দ্যাখে? কী হয় এসব দেখে? অযথা রোদে পুড়ে, গরমে ঘেমে, দুপুরের ভাত ঘুম নষ্ট করে ৫/৬ কিলোমিটার, যাওয়া-আসা মিলিয়ে ১০/১২ কিলোমিটার জার্নি করার কী মানে?

প্রতিবার এসব কথা শুনে শুনেই ভীষণ আগ্রহটা অনাগ্রহে রূপ নেয়। যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। কিন্তু এবার, যেহেতু লম্বা ছুটিতে সব রকম পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পিত জায়গায় যেতে পারিনি, তাই এবার ঠিক করেই রেখেছিলাম, যেদিন যাবো সেদিন একটু বিশ্রাম নিয়ে পরেরদিনই বেরিয়ে পড়বো প্রাচীন আর ভঙ্গুর এই রাজবাড়ি দেখতে। তাতে সাথে কাউকে পাই আর নাই পাই। এবার আর কাউকে দরকার নেই একাই যাবো।
এই জেদ ছিল বলেই পরদিন একজন নয় একই সাথে দুইজন সঙ্গী পেয়ে গেলাম। একটা আমার জুনিয়র, যে আমাকে কোথাও যেতে দেখলেই পিছু নেয়া শুরু করেছে আজকাল আর একজন ছেলের মামা। বাহ বেশ তো হলো। তবে চল দেখে আসি রাজশাহী বা নাটোরের রানী ভবানীর অধীনস্ত নওগাঁ জেলাধীন স্থানীয় এক রাজবাড়ি। দুবলহাটি রাজবাড়ি।

নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরত্বে প্রাচীন এই রাজবাড়ির অবস্থান। অটো রিক্সা, রিক্সা আর সিএনজি করে এখানে যেতে মাত্র ১৫-২০ মিনিট সময় লাগবে দুবলহাটি রাজবাড়ি। আমি এটাকে মজা করে দুর্বলহাটি বলতাম! যেহেতু যেতে পারতাম না, মনে করতাম বেশ দুর্বল জায়গা, তেমন আকর্ষণ নেই তাই আমাকে টেনে নিতে পারছে না। এজন্যই নাম দিয়েছিলাম দুর্বলহাটি রাজবাড়ি!
কিন্তু সত্যি যে রাজবাড়িটি এত এত দুর্বল আর প্রাচীন যে কিছু অবকাঠামো ছাড়া প্রায় সবটুকুই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বহুকাল আগেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। এই ধরনের রাজবাড়ির শুরুতে সাধারণত বিশাল আকারের গেট বা দরজা থাকে, সেটাই স্বাভাবিক আর সেকালের ঐতিহ্য। কিন্তু এই রাজবাড়ির সামনে তেমন কোনো কিছু দেখতে পাইনি। তবে ছিল নিশ্চয়ই। বিলীন হয়ে গেছে অযত্ন, অবহেলা আর গণমানুষের অত্যাচারে।

নওগাঁ শহর থেকে এই মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরের দুবলহাটি রাজবাড়ি যেতে হয় ভীষণ মনোরম একটি পিচ ঢালা পথ পেরিয়ে, যার দুইপাশে বিস্তীর্ণ জলাভূমি বা বিল। বর্ষায় যে বিলের যতদূর চোখ যাবে শুধু পানি আর পানি, ঢেউ আর ঢেউ, নৌকা, বোট আর জেলেদের অবিরত মাছ ধরার দৃশ্য দেখা যাবে। দুইপাশে বিলের মাঝ দিয়ে চলে গেছে একমাত্র পথ। একদম সোজা, কোথাও তেমন একটা আঁকাবাঁকা নেই বললেই চলে। শুধু দুবলহাটি বাজারে গিয়ে একটু বামে মোড় নিলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে চোখে পড়বে প্রাচীন এক ধ্বংসাবশেষ দুবলহাটি রাজবাড়ি।
তবে ভেঙে যতই যাক, বিলীন যতই হোক না কেন, লাল দেয়ালের সাথে এখনো লেগে থাকা অনেক উঁচু কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই, সেই ভাঙা, পলেস্তরা খসা, লোহার বিম বের হয়ে ভবনের খাঁচা বেরিয়ে যাওয়া, জীর্ণ সিঁড়ি, চারপাশের ভবনের জানালায়, বেলকোনিতে, বিশাল বিশাল হল ঘরের মতো আলো আঁধারির খেলা করা রুমগুলোতে চোখ বোলালেই বোঝা যাবে, যে প্রতিটি কোণ থেকে প্রাচীন আভিজাত্যের বিচ্ছুরিত আভা যেন ঠিকরে বের হয়ে আসছে।

রাজবাড়ির চারপাশেই রয়েছে নানা রকম ভবনের এক চতুষ্কোণ। কোনটা দোতলা, কোনটা তিনতলা আর কোনটা চারতলা। তবে চারতলার বেশি নেই কোনো ভবনের তলাগুলো। সেই চতুষ্কোণ পেরিয়ে আরও ভেতরে গেলে আরও দুই তিনটি ভবনের শেষ অংশ এখনো চোখে পড়ে ঘন গাছ, ঘাস আর জঙ্গলের আবর্জনা ভেদ করে। যেন সেসব ভবনও জানান দিতে চায়, আমারও ছিল প্রাচীন আর সম্মানজনক অবস্থান, ছিল অল্প বিস্তর আভিজাত্যের ছোঁয়া, ছিল বনেদী ভাবসাব।
এসব দেখতে দেখতেই একটু ঝুঁকিপূর্ণ হলেও কী একটা অদ্ভুত আকর্ষণে যেন ধীরে ধীরে মূল ভবনের ভীষণ ঝুরঝুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম তিন তলার ছাদে। বাহ, শেষ বিকেলের মিঠে সন্ধ্যায় একটা ঝিরঝিরে হাওয়া এসে গা জুড়িয়ে দিল। যেন প্রাচীন আভিজাত্যের জানান দিতে জল-খাবারের পরিবর্তে একটু প্রশান্তির পরশ। মন খুশিতে ভরে গেল মুহূর্তেই এমন অপূর্ব আর প্রাকৃতিক আতিথেয়তার আভিজাত্যে।

একটু ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে ভাঙা ছাদের ভঙ্গুর কার্নিশে বসে চারদিকে চোখ বোলালাম। আর অবাক হয়ে যা দেখলাম সেটা হলো পুরো রাজবাড়ির চারপাশে চারটি বিশাল বিশাল পুকুর বা দীঘিও বলা চলে। এটা এক ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেকালের জন্য। অবশ্য কেউ কেউ বলে, যে দীঘি বা পুকুরগুলো আসলে শ্রেণী ও সমাজ ভেদে, উঁচু-নিচু অবস্থান ভেদে সেভাবেই ছোট, বড়, মাঝারী আর সামনে-পিছনে, উত্তরে বা দক্ষিণে তৈরি করা হতো রাজবাড়ি ও এর প্রজাদের ব্যবহারের জন্য। কোনটা সত্যি কে জানে?
তবে শুনতে কেমন যেন রোমাঞ্চ লাগে। তবে শুধু শুনতে নয় এমন প্রাচীন কোনো স্থাপনায় গেলেই কেমন যেন একটা অনুভূতি স্পর্শ করে সব সময়, মনে হয় যেন সেকালে বুঝি ফিরে গেছি। পাশ ফিরতে বা ঘাড় ঘুরালেই দেখা হয়ে যাবে মাথায় মুকুট, গলায় লম্বা মতির মালা, হাতে তলোয়ার আর পায়ে জরি দেয়া খড়ম পরে কেউ বুঝি এগিয়ে আসছে!
যে কারণে একটু ভয় ভয়, কিছুটা গা ছমছমে, শিউরে ওঠা অনুভুতি হলেও একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে এসব ধ্বংসাবশেষ বা প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া নানা রকম স্থাপনায় বা রাজবাড়িগুলোতে। যে কারণে ছুটে ছুটে যাই সেকালের নানা কীর্তির আর দেয়ালে দেয়ালে, কার্নিশে, খসে পড়া পলেস্তরায়, লোহার বীমে, শ্যাওলা জমা পুকুরে পুরনো ইতিহাস খুঁজি, রোমাঞ্চিত হই, বিস্মিত হই, শিহরিত হই।

বেশ ভালোই লাগে কিন্তু, একটা অন্য রকম অনুভূতি যা ঠিক বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না। মুশকিল। তবে ঠিক অনুভব করতে পারি। কেমন আচ্ছন্ন করে ফেলা একটা অদ্ভুত অনুভূতি। আপনিও কিন্তু একবার ঘুরে আসতে পারেন সময় করে এই প্রাচীন আর প্রায় বিলীন স্থাপনায়, রাজা হরনাথ রায়ের দুবলহাটি রাজবাড়িতে।