দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতেই আকাশ ঢেকে গেল কালো মেঘে। সেই সাথে কাপ্তাই হয়ে উঠল উত্তাল! বিশাল বড় বড় ঢেউ উঠছে লেকটায়। পানি আছড়ে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের। বোটটাও দুলতে শুরু করেছে। বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করছি! কিছুক্ষণের মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। দূরের পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা মেঘ আর বৃষ্টি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলছি বিলাইছড়ির দিকে।
দেড় ঘণ্টার মাঝেই আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। প্রায় ছটা বেজে গেল পৌঁছাতে। বিলাইছড়ির হাসপাতাল ঘাটে নেমে উঠে পড়লাম নিজাম ভাইয়ের ভাতঘর বোর্ডিংয়ে। এটার ঠিক ওপরেই নিরিবিলি বোর্ডিং।
পাঁচটা রুমে আমাদের ১৮ জনের জায়গা হয়ে গেল। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে এবার হেঁটে দেখতে শুরু করলাম চারপাশ। বিলাইছড়ি উপজেলাটা রাঙামাটির বেশ গহীনে হওয়ায় এখনো সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি দর্শনার্থীদের মাঝে।
মুপ্পোছড়া আর ধুপপানি ট্রেইলে ট্রেকিং করার জন্যই মূলত এখানে আসতে হয়। বিলাইছড়ি থেকে এই দুই ট্রেইলে ট্রেকিং করার জন্য ভোরের দিকে নৌকা নিয়ে আবারো বেরিয়ে পড়তে হয়। বিলাইছড়িকে তাই একটা “ট্রেকিং স্টেশন” বলা যেতে পারে!
থাকার মতো তিন চারটা মোটামুটি মানের বোর্ডিং এখানে আছে। উপজেলা পরিষদের একটা সরকারি বাংলোও আছে। সব মিলিয়ে ২০০ জনের মতো মানুষকে একসাথে জায়গা করে দিতে পারবে এগুলো।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেই ধুপপানি যাওয়ার জন্য নৌকা ঠিক করে ফেললাম। রাতের খাবার খাওয়ার আগে আগে নৌকাটা নিয়ে লেকের পানিতে ছোটখাটো একটা নিশি ভ্রমণও সেরে ফেললাম আমরা। নৌকার বাতি নিভিয়ে অন্ধকারের মধ্যে লেকে ভেসে ভেসে চললো গল্প, আড্ডা আর গান! বেশ উপভোগ্য একটা রাত ছিল সেটা!
পরদিন ঘুম থেকে উঠে পড়লাম ভোর ৫টার আগেই। নাস্তা আর হালকা কিছু খাবার কিনে নৌকায় উঠে গেলাম সবাই। আর্মি চেকপোস্টগুলোয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে উলুছড়ি পৌঁছে গেলাম ঠিক ৯টায়। উলুছড়ি থেকে এবার ডিঙি নৌকা নিয়ে পানি পার হয়ে পনেরো মিনিট পর ডাঙায় পা রাখলাম। আমাদের সাথে গাইড হিসেবে আছেন হাসিখুশি তরুণ এক স্থানীয় অধিবাসী, লক্কি ভাই। শুরু হলো আমাদের বহু প্রতীক্ষিত ধুপপানি ট্রেকিং!
ধুপপানি ঝর্ণায় পৌঁছাতে হলে আপনাকে পাড়ি দিতে হবে তিনটি পাহাড় এবং বেশ কিছু ঝিরি। আবহাওয়া ভালো থাকলে আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই আপনি ঝর্ণায় পৌঁছে যাবেন। ট্রেইলটা খুব বেশি কঠিন নয়। ধৈর্য ধরে হেঁটে যেতে থাকলেই এক সময় দেখবেন তেমন কোনো কষ্ট ছাড়াই পৌঁছে গিয়েছেন। তবে বৃষ্টি হলে পরিস্থিতিটা হবে ভিন্ন। কাদা আর পিচ্ছিল সরু পাহাড়ি রাস্তার কারণে আপনাকে ঝর্ণায় পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হবে।
অসাধারণ সুন্দর সব ঝিরি আর সবগুলো পাহাড় পেরিয়ে দু ঘণ্টার মাঝেই আমরা পৌঁছে গেলাম ধুপপানি পাড়ায়। পাড়ার দোকানে বসে কিছু সময়ের জন্য চাইলে বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারবেন। পাহাড়ি ভুট্টা, কলা, চা, চিপস, কেক জাতীয় খাবারও পাবেন। খিদে পেয়ে গেলে অবশ্যই এখান থেকে খেয়ে নেবেন।
ধুপপানি পাড়া থেকে ঝর্ণায় যেতে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিটের মতো সময় লাগে সাধারণত। এই ট্রেকিংয়ের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পথ এটাই।
প্রায় আশি ডিগ্রি খাড়া পাহাড় বেয়ে আপনাকে নেমে যেতে হবে একদম নিচে। নামার রাস্তাটা খুবই সরু। সাবধানে ধীরে ধীরে এই রাস্তা ধরে পাহাড়টা থেকে নেমে আসলেই দেখা পাবেন মায়াবী ধুপপানি ঝর্ণার!
ধুপপানিতে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধ্যান করেন। আমরা অবশ্য গিয়ে তাঁর দেখা পাইনি। স্থানীয়দের কাছে ঝর্ণাটির বিশেষ ধর্মীয় গুরুত্ব আছে। এখানে গিয়ে তাই নীরবতা বজায় রাখতে হয়।
প্রায় এক ঘণ্টার মতো আমরা ছিলাম এখানে। ধুপপানির পাথুরে ফাঁপা জায়গাটায় বসে ইচ্ছেমতো গা ভিজিয়েছি সবাই। আর চারপাশের অসাধারণ প্রকৃতির চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখেছি মন ভরে। নিঃসন্দেহে ধুপপানি আপনাকে উপহার দেবে তুলনাহীন কাঁচা সৌন্দর্য!
ধুপপানি থেকে ফেরার পথেই শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্য বেশ কষ্ট হয়েছে আমাদের। আড়াই ঘণ্টার সহজ পথ হয়ে গিয়েছিল পাঁচ ঘণ্টার পাহাড়ি বিভীষিকা! শেষ পর্যন্ত যখন উলুছড়ি পৌঁছেছি ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৭টা!
তবে বলতেই হবে, ঝর্ণা আর ট্রেকিং দুটোই আমরা বেশ ভালমতোই উপভোগ করেছি। এখনো ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে না থাকলে ধুপপানিকে চোখ বন্ধ করে আপনার প্রথম ট্রেকিং গন্তব্য বানিয়ে ফেলতে পারেন!
যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে রাতের বাসে কাপ্তাই। কাপ্তাই থেকে লোকাল বা রিজার্ভ বোটে বিলাইছড়ি। বিলাইছড়ি থেকে উলুছড়ি হয়ে ধুপপানি।
খুঁটিনাটি:
কাপ্তাই থেকে বিলাইছড়ি রিজার্ভ বোট ১,৫০০-১,৮০০ টাকা।
ভাতঘরে সিঙ্গেল রুমের ভাড়া ৩০০ টাকা এবং ডাবল রুমের ভাড়া ৫০০ টাকা।
থাকার ক্ষেত্রে স্বপ্নবিলাস বোর্ডিংকে ভাতঘর থেকে এগিয়ে রাখবো। আমরা এক রাত স্বপ্নবিলাসে ছিলাম। ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা (সৈকত, ০১৮৪৩০৩১৮২১)
ভাতঘরের নিজাম ভাই নৌকা, খাবার, গাইড সব ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। (নিজাম,০১৮৬০০৯৯০২৯)
উলুছড়িতে ডিঙি নৌকার ভাড়া ২০০ টাকা (যাওয়া-আসা)। এক নৌকায় সর্বোচ্চ চার জন বসতে পারবেন।
ধুপপানির গাইড খরচ ৫০০ টাকা।
সতর্কতা:
ট্রেকিংয়ের সময় সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং শুকনো খাবার সাথে রাখতে হবে।
জাতীয় পরিচয়পত্র বা যে কোনো আইডি কার্ডের ফটোকপি রাখতে হবে ৬-৭ কপি।
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখবেন। ঝর্ণায় কোনো আবর্জনা ফেলে আসার কথা “দুঃস্বপ্নেও” চিন্তা করবেন না!
ফিচার ইমেজ- রওনক ইসলাম