দূর-দূরান্ত পাড়ি দিতে অনেকেরই প্রথম পছন্দ ট্রেন। যোগাযোগের চমৎকার এই মাধ্যমটি প্রায় সব বয়সের মানুষকেই আকর্ষণ করে। বিশেষ করে শিশুদের মাঝে ট্রেনে চড়ার আগ্রহ প্রবল। কেননা এই ভ্রমণ বেশ রোমাঞ্চকর। ভ্রমণকালে সুদীর্ঘ ট্রেনের এক বগি থেকে অন্য বগিতে যাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া যাত্রীরা ট্রেনের কেবিনে, সাধারণ কম্পার্টমেন্টে কিংবা ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন বগিতে অবাধ বিচরণ করতে পারেন। বিপদজনক হলেও আমাদের দেশের ট্রেনগুলোতে খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। এটি এক অনন্য অনুভূতি, একই সঙ্গে অভিজ্ঞতাও বটে। আর এই অভিজ্ঞতা শুধু ট্রেন ভ্রমণ থেকেই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু জানেন কি, বিস্ময়কর হলেও সত্য যে অনেক দেশের মানুষ এখনও ট্রেনে চড়ার অনুভূতি থেকে বঞ্চিত? কেননা ওই সকল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাতে কোনো ট্রেন নেই। চলুন জেনে নেওয়া যাক ট্রেন বিহীন সে সকল দেশ সম্পর্কে।
১. কুয়েত
কুয়েত মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুক্ত অর্থনীতির দেশ। দেশটি মূলত ৯টি তেল সমৃদ্ধ দ্বীপ নিয়ে তৈরি হয়েছে। দ্বীপ হলেও এগুলো মরুভূমি। এখানে বছরে গড়ে দুই দিন বৃষ্টিপাত হয়। কুয়েতে জলপথ এবং সড়কপথে যাতায়াতের দারুণ ব্যবস্থা আছে। তবে দেশটিতে রেল যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ তারপরও কুয়েতের যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত।

২. ভুটান
হিমালয়ের কোলে ছোট্ট দেশ ভুটান৷ দেশটি প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ভুটানের সরকার ও সাধারণ মানুষ তাঁদের ঐতিহ্য সম্পর্কে স্পর্শকাতর। এখানে কালো গলার ক্রেন নামের এক ধরনের বিপন্ন প্রজাতির পাখি রয়েছে। এই পাখিটি হত্যা করলে আজীবন কারাবাসের বিধান রয়েছে ভুটানে। আর ভুটানই বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে তামাক বিক্রয় নিষিদ্ধ। তবে দেশটির অর্থনীতি শক্তিশালী নয়। ভুটানের অধিকাংশ এলাকা জুড়েই রয়েছে পাহাড়। দেশটিতে এখন পর্যন্ত পাহাড় কেটে রেল ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। ভুটানের যোগাযোগের ব্যবস্থা মূলত সড়ক নির্ভর।

৩. লিবিয়া
লিবিয়া, দেশটির নাম শুনতেই মনে পড়ে যায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও আরব বসন্তের কথা। কেননা এখান থেকেই আরব বসন্তের সূচনা হয়েছিল। লিবিয়ার মজার একটি দিক হলপ দেশটির দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে একজন মাত্র রাজা ছিলেন। রাজার নাম ইদ্রিস। তিনি ১৯৫১ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। মুয়াম্মার গাদ্দাফি তাকে অপসারণ করে ক্ষমতায় আসেন। আফ্রিকার দেশ লিবিয়াতেও ট্রেন চলে না৷ আর অদূর ভবিষ্যতেও লিবিয়াতে রেললাইন বসানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।

৪. আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ডকে বলা হয় বরফ ও আগুনের ভূমি। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সংসদ এখানে গঠিত হয়েছিল। বরফাচ্ছন্ন দেশ হলে কী হবে, এখানে রয়েছে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। রয়েছে ১২৫টি ভলকানিক পর্বত। এর মধ্যে অনেকগুলোই সক্রিয়। প্রাকৃতিক এই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ইউরোপের এই দেশটি অত্যন্ত উন্নত। এখানে পরিবহন ব্যবস্থাও অত্যন্ত উন্নত৷ তবে এখন পর্যন্ত দেশটিতে রেলপথ তৈরি করা হয়নি।

৫. পাপুয়া নিউ গিনি
সমুদ্রের মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপ পাপুয়া নিউ গিনি। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপরাষ্ট্র। এর আয়তন মাত্র ৬২ হাজার ৮৪০ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনে ছোট হলেও পাপুয়া নিউ গিনি প্রাকৃতিক সম্পদে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সেই সঙ্গে এখানেও রয়েছে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ও ঘন বনাঞ্চল। দেশটির আয়তন এতই ছোট যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এখন পর্যন্ত রেলপথের প্রয়োজন পড়েনি।

৬. মাল্টা
ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্র মাল্টা। এর উত্তরে সিসিলি আর দক্ষিণে আফ্রিকার মরুভূমি৷ পর্যটনের জন্য মাল্টা অত্যন্ত জনপ্রিয়। দেশটি ১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়। দেশটির সমুদ্র সীমাতে এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডুবে যাওয়া বেশ কয়েকটি জাহাজ রয়েছে। এগুলোর অবস্থান তটরেখা থেকে খুব দূরেও নয়। মাল্টাতে সড়ক ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও এখানে কোনো রেল ব্যবস্থা নেই।

৭. মরিশাস
পর্যটন শিল্পের জন্য মরিশাস বিখ্যাত৷ অভিযাত্রীরা ১৫০৭ সালে আদিবাসীবিহীন দ্বীপটি আবিষ্কার করে। ১৯৬৮ সালে দেশটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা মুক্ত হয়। মরিশাসের জনসংখ্যা অত্যন্ত কম, মাত্র ১২ লাখ। এর মধ্যে দেড় লাখ মানুষই থাকে রাজধানী পোর্ট লুইসে। এখানে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক আসেন৷ দেশটি আয়তনেও ছোট, মাত্র ২ হাজার ৪০ বর্গ কিলোমিটার। তাই এখানে রেলপথ তৈরির প্রয়োজন পড়েনি৷

৮. ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি দেশ ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো। উৎসব উৎযাপনের জন্য দেশটির সংস্কৃতির বিশ্বজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। দেশটির অর্থনীতিতে তাদের বিপুল তেলের সঞ্চয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখানেও কোনোদিন রেল যোগাযোগ তৈরি হয়নি৷

৯. সলোমন আইল্যান্ড
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে শতাধিক দ্বীপ নিয়ে তৈরি সলোমন আইল্যান্ড৷ দেশটির রাজধানীর নাম হোনিয়ারা। সলোমন আইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস পর্যটন খাত। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে প্রচুর পর্যটক আসেন। এখানকার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও নীল সমুদ্র বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে। ছোট ছোট অনেক দ্বীপ আর পানির কারণে এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে রেলপথ তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

১০. ভানুআতু
ভানুআতু দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দেশ৷ ১৩টি বড় আর ৭০টি ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়েছে ভানুআতু। এখানে পর্যটন শিল্প দ্রুত উন্নত হচ্ছে। দেশটির অর্থনীতি মূলত কৃষি ও মৎস্য শিল্পের উপর নির্ভরশীল। এখানেও ছোট ছোট অনেক দ্বীপ আর পানির কারণে কোনো রেলপথ তৈরি হয়নি৷

বিস্তীর্ণ মরুভূমি, ছোট ছোট অনেক দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র, আয়তনে অত্যন্ত ছোট রাষ্ট্র কিংবা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতাসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর অনেক দেশেই ট্রেন চলে না। ম্যাকাও, হাইতি, সোমালিয়া, মার্শাল আইল্যান্ড, ওমান, ইয়েমেন, কাতার, রুয়ান্ডা, ম্যাকাও, হাইতি, সুরিনাম, নাইজার, চাঁদ ও তুবালুতেও কোনো রেলপথ নেই।
ফিচার ইমেজ- telegraph.co