চাঁচড়া রাজবংশের ষষ্ঠ পুরুষ ছিলেন রাজা মনোহর রায়। মূলত তিনিই ছিলেন চাঁচড়া জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা। রাজা মনোহরের সময়ে প্রজাদের যারা রাজস্ব দিতে পারত, তারা ভালো থাকত। যারা রাজস্ব দিতে পারত না, তাদের রাজস্বের টাকা রাজা মনোহর নিজ থেকে ধার দিতেন সরকারের কাছে টাকা পাঠানোর জন্য। কেউ যদি রাজস্ব দিতে বিরোধিতা করত, তাদের জমি এভাবে ধারের টাকার সূত্র ধরে দখল করে নিত রাজা মনোহর। তার বিপুল জমিদারির কোনগুলো যে ন্যায়ভাবে অর্জন করেছিলেন, আর কোনগুলো অন্যায়ভাবে, তা আর জানার উপায় নেই৷
তবে মনোহর যে কেবল জমিদারি বাড়িয়ে গেছেন, তা কিন্তু নয়। রাজধানী চাঁচড়ার সৌন্দর্যবৃদ্ধি, ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও প্রচুর ব্যয় করতেন। নিজের রাজপ্রাসাদের পাশেই নির্মাণ করেছিলেন চাঁচড়া শিব মন্দিরটি, যার সামনের দুটি দেয়ালে নানা রকম কারুকাজে সজ্জিত। মন্দিরের সাথে একটি দীঘি খনন করেন, যা শিবদীঘি নামে পরিচিত। দীঘিটি এখনো টলটলে পানি বুকে নিয়ে শুয়ে আছে মন্দিরের সামনে। কিন্তু রাজপ্রাসাদটির অস্তিত্ব এখন আর নেই।

চাঁচড়া শিব মন্দির; image source : মাদিহা মৌ
৩২৩ বছরের পুরাতন এই শিব মন্দিরটি যশোর জেলার যশোর-বেনাপোল হাইওয়ের চাঁচড়ায় অবস্থিত। মন্দিরটি ‘আট-চালা’ স্থাপত্য ঘরানায় নির্মাণ করা হয়েছিল। আট-চালা’ রীতি বাংলার মন্দির স্থাপত্যকলার বিশেষ এক ধরনের রীতি, যেখানে বর্গাকার বা আয়তাকার গর্ভগৃহের ‘চৌ-চালা’ ছাদের উপরে আরেকটি ছোট ‘চৌ-চালা’ ছাদ নির্মাণ করা হয়। এই স্থাপত্যটিকে ‘আট-চালা’ রীতি বলা হলেও এটি মূলত চারচালা। মূল চারচালা ছাদের মাঝে কিছুটা উঁচুতে আরেকটি ছোট চারচালা ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। এ নির্মাণ কৌশলে উঁচু চারচালা যুক্ত ছাদের যে অনুবল তৈরি হয় তা উপস্থিত থাকে না, ও ঘরের ভেতরে ছাদের সাপোর্ট নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত পিলার ব্যবহার করতে হয়।
মন্দিরের সামনের দুইপাশের দেয়ালে টেরাকোটার ফলক ব্যবহারের কারণে বাইরের দিকে দারুণ নান্দনিক দেখায়। এখানে ছাঁচ টেরাকোটা ব্যবহৃত হয়েছে। টেরাকোটায় ৮ ধরনের নকশা দেখা যায়। তার মধ্যে ২টি নকশা খুবই সূক্ষ্ম। কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়, সংস্কারের সময় মন্দিরের দেয়ালে বর্তমানে থাকা টেরাকোটার ফলকগুলো আদি টেরাকোটার আদলেই লাগানো হয়েছে।

সূক্ষ্মতম টেরাকোটা; image source : মাদিহা মৌ
সামনের দিকে তিনটি খিলান প্রবেশ পথ আছে যার মাঝেরটি অপেক্ষাকৃত বড়। পূর্বদিকেও একটি খিলান পথ আছ। অর্থাৎ মন্দিরের মোট প্রবেশ পথ ৪টি। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ৩১ ফুট ও প্রস্থ ২৭ ফুট এবং উচ্চতা ৩৫ ফুট। মূল শিব বিগ্রহটি অনেক আগেই চুরি হয়ে গেছে। তার জায়গায় বর্তমান মূর্তিটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পূজা-অর্চনা বন্ধ থাকার পর কিছুদিন আগে পুনরায় তা চালু হয়েছে।
মন্দিরের সামনের দেয়ালে শিলালিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা আছে,
‘শাকে নাগ শশাঙ্কর্ত্তুস্মরে প্রাসাদ উত্তমঃ।
শ্রীমনোহর রায়েন নিরমায়ে পিণাকিনে।’
-শুভমস্তু শকাব্দা ১৬১৮

বাহারী টেরাকোটা; image source : মাদিহা মৌ
সেই সময়ে সনাতনী স্থাপনাগুলোর শিলালিপি সংস্কৃত ভাষাতেই লেখা হতো। অঙ্কের বামা গতিতে নাগ=৮, শশাঙ্ক=১, ঋতু=৬ এবং স্মর (কামদেব)=১; এই মান পাওয়া যায়। যা ১৬১৮ শকাব্দকে নির্দেশ করে। শকাব্দ হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে বহুলপ্রচলিত এক প্রাচীন সৌর বর্ষ। এ অব্দ বঙ্গাব্দের ৫১৫ বছর পূর্বে এবং খ্রিস্টাব্দের ৭৮ বছর পরে প্রচলিত হয়। সেই হিসেবে মন্দিরের নির্মাণকাল হলো ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দ।
আমরা যখন চাঁচড়া শিব মন্দিরে গেলাম, তখন মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশের দরজা বন্ধ ছিল। এটি কি সবসময়ই বন্ধ থাকে, নাকি সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল, তা জানি না। কারণ নিরাপত্তা প্রাচীরের অন্য একদিকে প্রাচীরের নিচ দিয়েই ছেলে ছোকরারা যাওয়া আসা করছে। মন্দির প্রাঙ্গণটিকে তারা খেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করে৷ আমরাও তাদের পদাঙ্কই অনুসরণ করি, কারণ এতদূর এসে মন্দিরটি কেবল বাইরে থেকে দেখে চলে যেতে মন সায় দেয়নি।
পড়ন্ত বিকেলে বেশ লম্বা সময় মন্দিরের সামনে বসে ছিলাম। আমাদের সাথে তাল মিলিয়েই মনে হয় স্থানীয় একজন মহিলা মন্দিরের বেদীর উপর বসে ছিল অনেকক্ষণ। তার কাছেই জানতে পারি, এখানে সত্যিই নিয়মিত পূজা হয়। প্রধান খিলান দিয়ে শিবমূর্তিটি দেখা যাচ্ছিল। এর টেরাকোটাগুলো এতই নিখুঁত দেখে মনেই হয় না প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগের নির্দেশনা এই চাঁচড়া শিব মন্দির৷

আটচালা মন্দির; image source : মাদিহা মৌ
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যশোর (Jessore) যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর, কলাবাগান থেকে গ্রিন লাইন পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, ঈগল পরিবহন, শ্যামলী পরিবহনের এসি বাস যশোর যায়। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা। এ ছাড়া হানিফ, শ্যামলী, সোহাগ, ঈগল ইত্যাদি পরিবহনের নন-এসি বাসও যশোর যায়। ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা।
ঢাকার কমলাপুর থেকে সপ্তাহের শনিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৬টা ২০ মিনিটে আন্তঃনগর ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেস এবং সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় আন্তঃনগর ট্রেন চিত্রা এক্সপ্রেস যশোরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভাড়া শোভন ৩৫০ টাকা, শোভন চেয়ার ৪২০ টাকা। প্রথম শ্রেণি চেয়ার ৫৬০ টাকা। প্রথম শ্রেণি বার্থ ৮৪০ টাকা। স্নিগ্ধা শ্রেণি (এসি চেয়ার) ৭০০ টাকা। এসি বার্থ ১,২৬০ টাকা।

শিব বিগ্রহ; image source : মাদিহা মৌ
ঢাকা থেকে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স, রিজেন্ট এয়ারলাইন্স ও নভো এয়ারের বিমান নিয়মিত যশোরের পথে চলাচল করে।
ঢাকা থেকে যশোরগামী বাসে চড়ে মণিহার সিনেমা হলের সামনে নেমে সেখান থেকে রিক্সায় করে চাঁচড়া শিব মন্দির যাওয়া যায়। এছাড়া ১০ নং চাঁচড়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভ্যান/ইজিবাইক/বাসে করেও যাওয়া যায়। মনিহার বাস স্ট্যান্ড থেকে চাঁচড়া ১৫ মিনিটের রিকশা বাহনের দূরত্ব। বাস যদি বেনাপোলের দিকে যায়, তাহলে শিব মন্দিরের ঠিক সামনেই নামতে পারবেন।

খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার; image source : মাদিহা মৌ
কোথায় থাকবেন
থাকার জন্য যশোর শহরকেই বেছে নিতে হবে। সেখানে থাকা এবং খাবারের জন্য হোটেল পেয়ে যাবেন। ভালো আবাসিক হোটেলের মধ্যে হোটেল আমিন এবং হোটেল মিডটাউন উল্লেখযোগ্য।
ইতিহাস অংশের তথ্যসূত্র : যশোহর খুলনার ইতিহাস, সতীশচন্দ্র মিত্র
Feature image source : মাদিহা মৌ