খুলনা থেকে আমার বাস ছাড়লো সকাল ৭টায়। বিআরটিসির এই হতশ্রী বাস ছাড়া বরগুনার পাথরঘাটা যাওয়ার সরাসরি কোনো উপায় নেই। বাধ্য হয়েই এটাকে বেছে নিতে হয়েছে। অবশ্য খরচটাও খুব কম, ৬ ঘণ্টার এ পথের ভাড়া মাত্র ২১০ টাকা। পথে কচা নদী পার হতে হয়েছে ফেরীতে।
আমার যাচ্ছি গোপন ট্রাভেলার্সের আমন্ত্রনে রুহিতা গ্রামে ক্যাম্পিং করার জন্য। মোট ৩১ জনের ৩০ জনই আসছে ঢাকা থেকে। রুহিতা গ্রামে আমি যখন পৌঁছালাম ততক্ষণে ওরা সবাই এসে বিশ্রাম নিচ্ছে আমাদের হোস্ট ইব্রাহিম সাজ্জাল ভাইয়ের বাসায়। আমি পৌঁছানোর পরই খাওয়া দাওয়া করে নিলাম সবাই।

প্রথম রাতে আমাদের ক্যাম্পিং হবে রুহিতা গ্রামের কাছেই নির্জন এক দ্বীপে। দেরী না করে খাওয়া দাওয়া শেষ করেই রওনা দিলাম আমরা। ইব্রাহিম ভাইয়ের বাসা থেকে এক কি.মি. হেঁটে আমরা পৌঁছালাম ঘাটে, সেখান থেকে ট্রলারে উঠে বলেশ্বর নদী পার হয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য মাঝের চরে।
ছোট্ট একটি দ্বীপ। এক পাশে একটু বালিয়াড়ি আর অধিকাংশ দিকে ম্যানগ্রোভ বন। জানা গেল বন বিভাগ এ বনে ৩৩টা অজগর সাপ ছেড়েছে। শীতকালে সাপের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও ক্যাম্প সাইটে জিনিপত্র রেখে বের হয়ে গেলাম সাপের সন্ধানে। ক্যাম্প সাইটের কাছে কিছু কাশফুল, তারপরই শুরু বনের।

বনের ভেতরে ঢুকে দেখলাম এখানেও পানি আসে। যত সামনে যাচ্ছি ততই কাদার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। সাপের ভয়ে বুট পরে এসেছিলাম। এখন কাদার মধ্য থেকে বুট টেনে বের করাই দায় হয়ে গেল। যত সামনে এগুচ্ছি ততই কাদা বেড়ে চলেছে। শেষে এ বেলা অজগর দেখার আশা ছেড়ে দিয়ে সাইটে ফিরে আসলাম।
সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, তাই দেরি না করে আগে তাঁবু স্থাপনে মনোযোগ দিলাম। ঝটপট তাঁবু খাটিয়ে মুড়ি চানাচুর দিয়ে নাস্তা সেরে আমি চলে গেলাম মাছ ধরার জন্য। চায়না থেকে আমদানি করা মাছ ধরার ফাঁদটা দিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত চেষ্টা করে কয়েকটা কুঁচে চিংড়ি ছাড়া আর কিছু ধরতে পারলাম না।

পূর্ণিমার বাকি একদিন। কিন্তু চাঁদ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। কোনো প্রকার লাইট ছাড়াই দ্বীপে ঘুরে বেড়ানো যাচ্ছে। অপার্থিব চাঁদের আলোতে সময়টা ভালোই কাটছিলো। রাত ৯টার দিকে আমাদের খাবার চলে এলো। রাঁজহাসের মাংস আর খিচুড়ি দিয়ে পেটপুরে খেয়ে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে তাঁবুতে ঘুমাতে গেলাম।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নদী পার হয়ে আমরা চলে এলাম আমাদের দ্বিতীয় দিনের ক্যাম্প সাইটে। একটা ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর এই সাইটটাই আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে। গাছে হ্যামক ঝুলিয়ে কিছুক্ষণ দোল খেয়ে সাইকেল নিয়ে গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। বিদ্যুৎ আসেনি এখনও এ গ্রামে।

ধানের ক্ষেতে পাকা ধান, ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য পাখি। রাস্তার দু’পাশে তালগাছের কারণে রাস্তাটাও অসম্ভব সুন্দর লাগছে। স্থানীয় বাজারে পেঁপে কিনে খেয়ে আর বাঁধের উপর সাইকেল চালিয়ে ফিরলাম আমাদের ক্যাম্প সাইটে। পাশেই একটা জলা জায়গায় আবার ফাঁদটা ফেলে সন্ধ্যা নাগাদ বেশ কিছু ছোট মাছ ধরে ফেললাম।
এবার জোয়ার আসার পর ছোট মাছগুলো সহই ফাঁদটা খালে রেখে রাতের খাবার খেতে এসে দেখি সেরকম আয়োজন। খাসি, মুরগীর রোস্ট আর পরোটা দিয়ে খেয়ে দেয়ে ফাঁদটা তুলে ধরেই চমকে গেলাম। সাপ ঢুকে গেছে ফাঁদে! ভালো করে দেখার পর অবশ্য বুঝতে পারলাম এটা সাপ নয়। এক প্রকারের ইল মাছ।
এদিকে পূর্ণিমার কারণে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি দেখা যাচ্ছে। একসময় দেখলাম ক্যাম্প সাইটের মাত্র ৮/১০ ফিট দূরেই আছে পানি। একটা তাঁবু সরিয়েও নিয়ে আসতে হলো। রাত ১১টা বেজে যাওয়ায় আর পানি বাড়ার সম্ভাবনা কম। উল্টো একটু পরে ভাটার টান শুরু হবার কারণে পানি কমতে শুরু হলো।
খুব সকালে যখন ঘুম ভাঙল, কুয়াশার মধ্য দিয়ে বের হয়ে দেখলাম চারদিক থেকে অসংখ্য পাখপাখালির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রাতে ক্যাম্প সাইটের কাছেই বদ্ধ পানিতে রেখেছিলাম ফাঁদ, এবার সেটা উঠিয়ে দেখি একটা টাকি মাছ আর বেশ কিছু ছোট মাছ রয়েছে।

আমাদের দলের পাচক নাইম জানিয়েছে দুপুরে খাবারে থাকছে কাচ্চি বিরিয়ানি, জালি কাবাব আর মুরগীর রোস্ট। তাই মাছগুলো ছেড়েই দিব ভাবছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লো আমার কাছে আরও কিছু বড়শি আছে। ছোট মাছগুলো সেটাতে গেঁথে পানিতে ফেললে কিছু বড় মাছ পেয়েও যেতে পারি।
সাথে সাথে পরিকল্পনা কাজে লাগাতে শুরু করলাম। পোড়া কপাল আমার। উঠলো তো উঠলো সেই কুইচলাই আবার উঠলো। এবারেরটা আকৃতিতে আরও বড়। বড়শিতে এমনভাবে পেঁচিয়েছে কিছুতেই আর ছাড়াতে পারছি না, কাছে গেলেই কামড়ে দিতে চায়। শেষে স্থানীয় বাচ্চাদের বললাম কেটে নিয়ে আসার জন্য।

এর মধ্যে দলের বাকি সদস্যরা হ্যামক টাংগিয়ে ম্যানগ্রোভের মধ্যে শুয়ে পড়েছে। দেখাদেখি আমিও যোগ দিলাম। দুপুর নাগাদ এই জংগলে বসেই কাচ্চি, জালি কাবাব আর রোস্ট দিয়ে ভরপেট খেয়ে রওনা দিলাম বাড়ীর উদ্দেশ্যে। এ মৌসুমের প্রথম ক্যাম্পিং শেষ হলো। দ্বিতীয় ক্যাম্পিংয়ের পরিকল্পনা আগামী ১৪-১৬ ডিসেম্বর চর কুকড়ি মুকড়িতে, ট্রাভেলার্স অব বাংলাদেশের সাথে।
ফিচার ছবি: লেখক