সাধারণত নেপাল ঘুরতে গেলে বেশিরভাগ পর্যটক কাঠমান্ডু আর পোখরা ঘুরেই চলে আসেন। তবে নেপালের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে আরো অনেক ভেতরে, অনেক গভীরে। নেপালকে বলা হয় পৃথিবীর দুর্দান্ত সব ট্রেকিং এর স্বর্গদ্বার। পাহাড়ের দেশ নেপালে গিয়ে যদি পাহাড়ের একদম কাছাকাছি না যাওয়া যায় তবে নেপাল ভ্রমণ যে অনেকাংশেই অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
নেপালের তেমনই কিছু জায়গা রয়েছে একদম ভেতরের দিকে, মুসতাং আর মানাং জেলা তাদের মধ্যে অন্যতম। অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পের ট্রেকিং শুরু করা হয় মুসতাং জেলার জমসম গ্রাম থেকে। আরো আছে নীলগিরি, ধৌলাগিরির মতো শুভ্র বিশাল উচ্চতার মাইলফলক পর্বতরাজী আর সুবিস্তীর্ণ মালভূমি।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯,০০০ ফুট উচ্চতার এক গ্রামের নাম জমসম। এটি মুসতাংয়ের দুটি ভাগ- আপার মুসতাং এবং লোয়ার মুসতাংয়ের লোয়ার মুসতাংয়ে অবস্থিত। নেপালের একদম আনকোরা সৌন্দর্য দেখতে হলে যেতে হবে জমসম গ্রামে। এই বাজেট সিরিজের এই পর্বে তাই গল্প করবো জমসমে যাওয়ার উপায় এবং যাবতীয় খরচাদি নিয়ে। চলুন তাহলে শুরু করা যাক মুসতাং জেলার জমসমের গল্প।

কীভাবে যাবেন:
মুসতাং জেলার জমসমে যেতে হলে প্রথমে চলে আসতে হবে কাঠমান্ডুতে। কাঠমান্ডুর রত্না পার্ক থেকে পারমিশন নিতে হবে সবার প্রথমে। যদি এমন হয় যে আপনি ট্রেক করার উদ্দেশ্যে জমসমে যাচ্ছেন তবে আপনার ACA এবং TIMS দুটি পারমিশন লাগবে। TIMS পারমিশনটি শুধু ট্রেকারদেরই নিতে হবে। যারা ট্রেকার নন তাদের ক্ষেত্রে TIMS পারমিশন লাগবে না।
শুধু ACA পারমিশন নিতে খরচ হয় ৩৫০ নেপালি রুপি আর দুটোই নিতে খরচ হয় ৬০০ রুপির মতো। জমসম যাওয়ার সময় বিশেষ কোথাও এই পারমিশনের চেক হবে না, কিন্তু আপনার কাছে যদি এই পারমিশন না থাকে তবে জমসম যাওয়ার বাসে উঠতে ঝামেলা করতে পারে বাস কর্তৃপক্ষ। সেক্ষেত্রে জমসম যাওয়ার সময় রাস্তায় করাতে হবে পারমিশন, সেক্ষেত্রে টাকা যাবে দুটি মিলিয়ে ১,১০০ রুপির মতো এবং তখন দুটিই বাধ্যতামূলকভাবে করাতে হবে, সে আপনি ট্রেক করুন আর নাই করুন।

কাঠমান্ডু থেকে পারমিশন করানো হয়ে গেলে যদি পোখরা যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে তবে পোখরা চলে যান। দুইদিন পোখরায় থেকে সেখান থেকে বাসে উঠুন জমসমের। পোখরার হাল্লান চৌক থেকে জমসমের বাস পাবেন। তবে সব বাসে উঠবেন না। একমাত্র “ঘোড়াঘোড়ি এক্সপ্রেস” এই রুটের সবচেয়ে ভালো বাস, জমসম পর্যন্ত যার ভাড়া ১,০০০ রুপি।
জমসম যাবার রাস্তা প্রচণ্ড খারাপ, তাই বাস যদি ভালো না হয় জীবন বের হয়ে যাবে জমসম পৌঁছাতে পৌঁছাতে। ঘোড়াঘোড়ি এক্সপ্রেসের নাম্বারে (9841454328) ফোন করে বাসের টিকেট বুক করতে পারেন। জমসম যেতে সাধারণত সময় লাগে ৮ ঘণ্টা। কিন্তু পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে একটা গাড়ির লাইন উপর থেকে নিচে নামে আবার একটা গাড়ির লাইন নিচে থেকে উপরে মানে জমসমে যায়।
এই রুটের নিয়ম হচ্ছে যে গাড়িগুলো উপর থেকে আসছে সেগুলোকে আগে যেতে দেয়া, তাই উপরে উঠার সময় ৮ ঘণ্টার বদলে ১২-১৩ ঘণ্টা লেগে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনি ইচ্ছে করলে পোখরা থেকে ছোট ছোট বিমানে করেও সরাসরি জমসম যেতে পারেন, সেক্ষেত্রে আসা-যাওয়ায় খরচ হবে ১৬ হাজার নেপালি রুপি।
কোথায় থাকবেন:
জমসম খুবই ছোট একটি গ্রাম। যেখানে সব বাস থামাবে সেখানেই দেখবেন প্রচুর হোটেল। আসলে সবই হচ্ছে স্থানীয়দের বাড়ি, বাড়িকে হোটেল হিসেবে ব্যবহার করছে তারা নিজেদের রোজগারের উৎস হিসেবে। তাই হোটেল ভাড়া খুব একটা বেশি নয়। তবে একটা নদী চোখে পড়বে জমসম যাওয়ার সময়, নাম কালিগান্দাকি নদী।

একদম জমসমের শেষ মাথায় একটা কাঠের ব্রীজ আছে, সেই ব্রীজের ওইপাশে যে হোটেলগুলো আছে সেগুলোর ভাড়া আবার একটু বেশি কারণ একদম নদীর কাছে হওয়ায় খুব সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় হোটেলের রুম থেকেই। জমসম এয়ারপোর্টের কাছেও অনেক হোটেল আছে।
এখানে ৫০০ রুপি থেকে শুরু করে ২,০০০ রুপি পর্যন্ত দামের রুম আছে যেখানে আলাদা আলাদা সিংগেল বেড রাখা আছে সব রুমেই। দরদাম করে রুম থেকে দৃশ্য সুন্দর দেখা যায় নাকি বিবেচনা করে উঠে পড়বেন হোটেলে। তবে ব্রীজের ওইপারে না থেকে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি থাকলে যাতায়াতে সুবিধে হবে বেশি।
কোথায় এবং কীভাবে ঘুরবেন:
জমসম পুরো গ্রামটাই একটা ঘোরার জায়গা। এর প্রতিটা স্থানে স্থানে সৌন্দর্য বাড়তে থাকে পদসংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে। সকাল সকাল জমসম ঘুরতে বের হলে নীলগিরি, ধৌলাগিরি আর অন্নপূর্ণার যে অভাবনীয় রূপ দেখতে পাবেন তা মাথা থেকে সরিয়ে দেয়া অনেকটা অসম্ভব।
রাতের জমে যাওয়া বরফ সকালবেলার নতুন সূর্যালোকে চিক চিক করতে করতে একসময় গলে যায়। দুপুরের দিকে দেখা যায় কালো পাথরে গড়া পর্বতরাজী। রাত বাড়তেই বরফ পড়া শুরু করে আবার, ভোরে উঠে সেই বরফ দেখা নেশা হয়ে দাঁড়ায়।

জমসমের অন্যতম জনপ্রিয় জায়গা মুক্তিনাথ মন্দির। জমসম থেকে শেয়ারড জীপে করে মুক্তিনাথ যাওয়া যায়, জীপ ভাড়া ৩০০ নেপালি রুপি। জীপ একদম মুক্তিনাথ পর্যন্ত যাবে না, মুক্তিনাথের ঠিক এক কিলোমিটার নিচে সমতলে থেমে যাবে। সেখান থেকে হেঁটে যেতে হবে মুক্তিনাথ মন্দিরে। এটি মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। তবে বৌদ্ধমূর্তিও আছে এখানে।
মুক্তিনাথ যেতে হলে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হয়, বেশি কঠিন না এই সিঁড়ি ভাঙা। বয়স্ক মানুষজনও তরতর করে উঠে যায় মুক্তিনাথ যাওয়ার সিঁড়িতে। মুক্তিনাথ থেকে ফিরে আসার সময়ও জীপে করেই ফিরে আসতে হবে জমসমে, ভাড়া একই জনপ্রতি ৩০০ রুপি।
কী খাবেন:
নেপাল মানেই মোমো, সসেজ, নুডুলস আর ফ্রাইড রাইসের দেশ। এখানে ভাত-মাছ-মুরগীর মাংস খুব কম পাওয়া যায়। আর জমসমের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসবের আশা করা মানে মরুভূমিতে পানির আশা করার মতো। জমসমে নিরামিষ থালির দাম ৫০০ রুপি, একটা ডিম ভাজির দাম ৮০ থেকে ১০০ রুপি। খাবার-দাবারের দাম প্রচুর জমসমে।
তাই বলে খাবার-দাবার তো আর আটকে রাখা যাবে না। যে হোটেলে থাকছেন সে হোটেলেই দেখবেন খাবার ব্যবস্থা আছে। একটু বলে কয়ে খাবারের দামটা ঠিক করে নেবেন। জমসমে প্রতিদিন খাবার খরচ ধরা যায় ৬০০-৭০০ রুপি।

নেপালের অধরা অস্পর্শা সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে মুসতাং আর মানাং জেলায়। এখানে ডিসেম্বরের দিকে প্রচুর তুষারপাত হয়। চারদিকে সাদা বরফের মেলা বসে এই পাহাড়ি জেলাগুলোয়। নিজ চোখে দেখতে হলে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হবে এখানে। ফিরে যাওয়ার সময় ঘোড়াঘোড়ি এক্সপ্রেসের টিকেট কেটে নেবেন একদম কাঠমান্ডু পর্যন্ত, ভাড়া ১,৬০০ নেপালি রুপি। ভ্রমণ হোক সুন্দর, সাশ্রয়ী আর নিরাপদ।
ফিচার ইমেজ- লেখক