টয় ট্রেন দেখেছেন কখনো? খেলনা রেলগাড়ি যদি কখনো বাস্তবে ধরা দেয়? যদি কখনো বসার সুযোগ আসে সেই বাস্তব বিশাল খেলনা রেলগাড়িতে তবে কি হাতছাড়া করবেন? অবশ্যই না, তবে আপনার জন্য ভারতের অন্যতম সুন্দর জায়গা দার্জিলিংয়ে অপেক্ষা করছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে স্থান পাওয়া পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে সরু রেললাইন ধরে উপরে উঠে যাওয়া হিমালয়ান রেলওয়ের টয় ট্রেন।
এক টয় ট্রেন দিয়েই অনেকে দার্জিলিংকে চেনে। আবার শুধু টয় ট্রেনই আছে দার্জিলিংয়ে ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তা নয়। শীতকালে দার্জিলিংয়ের উচ্চতায় এক কাপ দার্জিলিং চা নিয়ে বসে আরামে সবুজের বিশালতা উপভোগ করার যে অভিজ্ঞতা তা খুব কম মানুষই হাতছাড়া করতে চাইবে। পাশের দেশ ভারতের শীর্ষ কয়েকটি ঘুরতে যাওয়ার স্থানগুলোর মধ্যে দার্জিলিং অন্যতম পছন্দনীয় স্থান। দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে ভালো দিক হলো এখানে ঘুরে আসতে খুব কম খরচ হয়, মোটামুটি ৬,০০০ টাকার ভেতর দার্জিলিং ঘুরে আসা সম্ভব।
নিজের দেশের বিভিন্ন জায়গার কম খরচে ঘুরে আসার গল্প দিয়ে শুরু করা এই বাজেট ট্রিপের সিরিজে এখন করছি বাইরের দেশে কম খরচে ঘুরে আসার গল্প। চলুন তাহলে দেখে নিই কীভাবে দার্জিলিংয়ে কম খরচে ঘুরে আসা যায় সম্পূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে।

কলকাতা যেমন পশ্চিমবঙ্গে অবিস্থত তেমনি দার্জিলিংও পশ্চিম বাংলারই অংশ। প্রায় ২,১০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ভারতীয় এই হিল স্টেশনের সৌন্দর্য অন্যরকম। দার্জিলিং থেকে দেখা যায় পৃথিবীর ৭টি উচ্চতম শৃঙ্গের ৫টিই। এদেরকে একত্রে বলা হয় স্লিপিং বুদ্ধ যার মধ্যে সবচেয়ে ভালো দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। প্রতি বছর শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রচুর পর্যটক দার্জিলিং ভ্রমণে যায়, এদের অধিকাংশই থাকে বিদেশী।
পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মোটামুটি বাংলাভাষী মানু্ষ পাবেন দার্জিলিংয়ে, তাই কথা বলতে তেমন সমস্যা হবে না। পাহাড় কেটে হাজারো রঙের ঘরবাড়ি বানানো হয়েছে দার্জিলিংয়ে, রাতের বেলায় বাড়িগুলোতে আলো জ্বালিয়ে দিলে মনে হয় আকাশের তারারা বুঝি মাটিতে নেমে এসেছে।
কীভাবে যাবেন:
বাংলাদেশ থেকে সরাসরি দার্জিলিং যায় এমন কোনো উপায় নেই। দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর দার্জিলিং থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরে বাগডোগরায় অবস্থিত। তবে বিমানে দার্জিলিং যাওয়া মোটেই খরচের দিক দিয়ে সুবিধেজনক নয়। বাংলাদেশ থেকে খুব সহজেই দার্জিলিং চলে যাওয়া যায় দুই উপায়ে।
যদি আপনার ভারতীয় ভিসার পোর্ট দেয়া থাকে বুড়িমারি চেংড়াবান্ধা তবে প্রথমেই ঢাকার শ্যামলি বা গাবতলি থেকে হানিফের বাসের টিকেট কেটে নিন বুড়িমারি পর্যন্ত, ভাড়া ৬৫০ টাকা। একদম বুড়িমারি বর্ডারের কাছেই বাস থামবে। ইমিগ্রেশন পার করে ওপাশ থেকে অটো নিয়ে চলে যাবেন বিশ্বরোড, সেখান থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার বাস পাবেন, ভাড়া ৬০ রুপি।
বর্ডার থেকে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মতো। শিলিগুড়ি থেকে শেয়ারে জীপ পাবেন দার্জিলিং যাওয়ার জন্য, ভাড়া ১৫০ থেকে ২৫০ রুপির মধ্যে সীমাবদ্ধ।

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যেতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টার মতো। এটা ছিল এক উপায়ে, আরেক উপায়েও দার্জিলিং যাওয়া যায়। তবে দ্বিতীয় উপায়টি শুধু তাদের জন্য যাদের ভিসার পোর্ট বাংলাবান্ধা/ চেংড়াবান্ধা দেয়া নেই, তারা বেনাপোল বর্ডার দিয়ে ঢুকে ট্রেনে করে নিউ জলপাইগুড়ি যেতে পারেন। এক্ষেত্রে ট্রেনের টিকেট আগেভাগেই কেটে রাখতে হবে বাংলাদেশ থেকে। টিকেট ভাড়া ৩০০-৩৫০ রুপি, সময় লাগে প্রায় ১২-১৩ ঘণ্টার মতো।
নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে সেখান থেকে দার্জিলিং জীপ স্ট্যান্ড বলে একটা জায়গা আছে, সেখানটায় চলে যান। মাহিন্দ্রায় ভাড়া নেবে ২০ রুপির মতো। সেখান থেকে দার্জিলিং যাবার শেয়ারড জীপ পাবেন। ভাড়া ১৫০-১৮০ রুপি, সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। দুটি উপায়েই খরচ তেমন হয় না, তবে যদি আপনার ভিসা এখনো না করিয়ে থাকেন এবং পরিকল্পনা করছেন দার্জিলিং যাবেন তবে অবশ্যই পোর্ট হিসেবে বুড়িমারি, চেংড়াবান্ধা নির্বাচন করুন। এক্ষেত্রে প্রথম উপায়ে দার্জিলিং যেতে কষ্ট অনেক কম হবে।
কোথায় থাকবেন:

দার্জিলিংয়ে থাকার মতো প্রচুর হোটেল আছে। তবে চেষ্টা করুন মল রোডের আশেপাশে থাকার। এক্ষেত্রে দার্জিলিং পেট্রোল পাম্পের দিকে একটা হোটেল আছে, নাম হোটেল গ্রুভ হিল। চারজন থেকে ছয়জন থাকা যায় এমন বড় বড় রুম আছে ৭০০ থেকে ৯০০ রুপিতে। তবে মাথায় রাখতে হবে হোটেলের অবস্থান আর হোটেলে গিজারে ব্যবস্থার কথা।
হোটেল যদি খুব বেশি নিচে হয়, তবে খাবার-দাবার আর শপিং করতে আপনাকে বার বার হেটে উঁচুতে উঠতে হবে যা সত্যিই কষ্টকর। আর হোটেল একটু উঁচুতে হলে চেক করে নিবেন বাথরুমে গিজার আছে কিনা, কারণ শীতের সময় দার্জিলিংয়ে যে পরিমাণ ঠাণ্ডা পড়ে তা আমাদের সহ্য ক্ষমতার বাইরে। গিজার না থাকলে কোনো চিন্তা ছাড়াই সে হোটেল বাদ দিন, শীতকালে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করার কষ্ট সহ্য করতে হবে না।
কোথায় এবং কীভাবে ঘুরবেন:
দার্জিলিং এমন এক স্থান যার সবটা একদিন কি বড়জোড় দুইদিনে ঘুরে ফেলা সম্ভব। যেদিন দার্জিলিং পৌঁছুবেন সেদিনই একটি জীপ ঠিক করে নেবেন, প্রতি জীপে বসা যায় ৮ থেকে ১০ জনের মতো। জীপ ঠিক করার ক্ষেত্রে হোটেলের সাহায্য নিতে পারেন, তারা একটু টাকা নেবে এর জন্য। তবে জীপ ঠিক করার সময় একদম ভালো করে বলে দেবেন অবশ্যই অবশ্যই যেন রক গার্ডেন নিয়ে যায়।
দার্জিলিং দিনের ট্যুরে রক গার্ডেন যাওয়াটা পড়ে না কারণ তা অনেক নিচে অবস্থিত যেখান থেকে উঠে আসতে চায় না ড্রাইভাররা। তাই ৩০০-৫০০ রুপি বাড়িয়ে দিয়ে হলেও রক গার্ডেনটা ঘুরে আসবেন কারণ ভালো লাগার মতো এক জায়গার নাম রক গার্ডেন।

দার্জিলিং খুব ভালোভাবে ঘুরতে হলে একদম সকালে বের হতে হবে, যখন সূর্যও ওঠেনি তখন আপনাকে উঠতে হবে। কারণ প্রথমেই জীপ আপনাকে নিয়ে যাবে টাইগার পয়েন্টে, সেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘার কোল থেকে যে সূর্যোদয় দেখতে পাবেন তার স্মৃতি মাথার প্রতিটা নিউরনে গেঁথে যাবে আজীবনের জন্য।
টাইগার পয়েন্টে সূর্যোদয় দেখা শেষ হলে ড্রাইভার একে একে আপনাকে নিয়ে যাবে বাতাসিয়া লুপ, দার্জিলিং টি স্টেট, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট, চিড়িয়াখানা আর রক গার্ডেনে। একেকটা জায়গা অপরটা থেকে একটু দূরে বলে এগুলো ঘুরতেই আপনার সারাদিন লেগে যাবে, সকালে বের হলে হোটেলে ফেরত আসতে আসতে বিকেল তিনটা-চারটা বাজবে। সারাদিনে জীপ ভাড়া নেবে ২,৫০০ রুপির মতো।
কোথায় খাবেন আর শপিং করবেন:
দার্জিলিং যেহেতু পশ্চিম বাংলার অংশ তাই খাবার দাবার নিয়ে তেমন কোনো ঝামেলা হবে না। আমিষ নিরামিষ সবই পাওয়া যায় এখানে। দার্জিলিং মল রোডের দিকে যে বিগ বাজার আছে তার থেকে একটু সামনে উপরে উঠে গেলেই অনেক খাবার দোকান চোখে পড়বে।
তবে আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে “Ana mistan Restaurant” নামক এক ছোটখাটো রেস্টুরেন্টের খাবার। ১০০ রুপির মধ্যে দেড় প্লেট বাসমতি চালের ভাত, দু পিস মুরগী আর জিলাপী দিয়ে ভরপেট খাওয়া যায় এখানে। নাস্তা আর দুইবেলার ভারী খাবারে মোটামুটি যে কারো সর্বোচ্চ ৩০০-৩৫০ রুপি খরচ হবে।

বাজেট ট্রিপের সবচেয়ে নাজুক একই সাথে শক্তিশালী দিক হলো এই খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটি। আপনি চাইলে খাওয়া-দাওয়ার খরচ কমিয়ে ফেলতে পারেন একদম বাছাই করা কিছু খাবার খেয়ে। শপিং করতে হলে দার্জিলিং বিগ বাজারে যেতে পারেন, বেশ ভালোই ছাড় দেয় বছরের বিভিন্ন সময়ে।
দার্জিলিংয়ে ঢুকেই একটা জিনিস চোখে পড়বে, তা হলো উইন্ড চিটার জ্যাকেট। খুব ভালো পাওয়া যায় দার্জিলিংয়ে যেগুলোয় বাইরে থেকে কোনো বাতাস ঢুকতে পারে না। দামও ১,৫০০ রুপির মধ্যে সীমাবদ্ধ। আসল লেদার জ্যাকেট না চিনলে ভুলেও দার্জিলিং থেকে লেদার জ্যাকেট কিনতে যাবেন না, ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।

দার্জিলিং যাওয়ার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত। মোটামুটি ৭-৮ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে গেলে ৫,০০০-৬,০০০ বাংলা টাকায় দার্জিলিং ঘুরে আসা সম্ভব। তবে এ টাকার ভেতর কিন্তু শপিংয়ের টাকা নেই, যে যত শপিং করবেন সে অনুযায়ী অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাবেন যাতে বিপদে না পড়তে হয়। ভ্রমণ হোক সুন্দর, সাশ্রয়ী আর নিরাপদ।
ফিচার ইমেজ- ytimg.com