বিদেশ বলতে শুধু সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, আমেরিকা বা বাঘা বাঘা দেশ বোঝায় না। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটানও আমাদের কাছে বিদেশ, তাই নয় কি? এই তিন দেশ বাদেও আছে মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, চীন, রাশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি। আমাদের প্রায় সবার ধারণা বিদেশের মাটিতে বুঝি অনেক খরচ হয় ঘুরতে গেলে, হয়তো মধ্যবিত্তদের জন্য বিদেশ ভ্রমণ মরীচিকা হয়েই রয়ে যায়।
যেসব পর্যটক খুব ভালো করে জেনেশুনে তারপর বাইরের দেশে ঘুরতে যাওয়ার জন্য পাড়ি জমান তারা ভালো করেই জানেন আসল ব্যাপারটা মোটেই এমন নয়। আপনি যদি একটা দেশ, তার রীতিনীতি আর ছোট বড় সব দিক নিয়ে ভালো করে পড়াশোনা করেন তবে জানতে পারবেন আমাদের দেশের তুলনায় খুব বেশি একটা তফাৎ নেই সেসব দেশের ভ্রমণ খরচে। এমনকি ফ্রান্সের মতো একটি দেশে বাংলাদেশী ৭০০ টাকা সমমূল্যের থাকার জায়গাও পেয়ে যাবেন অনায়াসেই।
তবে বিদেশে বাজেট ভ্রমণে যেতে হলে জানতে হবে প্রচুর, যারা আগে গিয়েছেন কথা বলতে হবে তাদের সাথে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিম বাংলা রাজ্যের রাজধানী কলকাতা ভ্রমণ অনেকেরই ভ্রমণ তালিকায় থাকে। এই বাজেট ট্রিপের সিরিজে আপনাদের জানাবো কোথায় কত কম খরচ করে সুন্দর করে ঘুরে আসা যায়। এই লেখায় থাকছে কলকাতায় কম খরচে ঘুরে আসার উপায় নিয়ে গল্প। চলুন তাহলে শুরু করা যাক।

কলকাতাকে বলা হয় “সিটি অফ জয়” মানে আনন্দের শহর। ঐতিহ্যবাহী হলুদ ট্যাক্সি থেকে শুরু করে পুরনো সব বাড়িঘর, শৈশবের ক্রিকেট খেলার অলিগলি, বিখ্যাত সব মন্দির আর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট নিয়ে কলকাতা ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে আছে অন্যরকম এক গৌরব নিয়ে।
কলকাতা ঘুরতে হলে চোখে রাখতে হবে একটু কলকেতে আমেজ, হাঁটতে হবে শহরের হলুদ ল্যাম্পপোস্টের রাস্তায়। কলকাতাকে ভালোবাসতে হবে, ভালোবাসা দিতে হবে এখানকার রাস্তার পাশে হরেক রকম রঙে রাঙানো দেয়ালগুলোকে।

কীভাবে যাবেন কলকাতায়:
বাংলাদেশ থেকে তিন উপায়ে কলকাতা যাওয়া যায়। প্রথমটি বিমানে করে সরাসরি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কলকাতা বিমানবন্দর। রাউন্ড ট্রিপের ভাড়া পড়বে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকার মধ্যে। বিমানের ভাড়া মূলত নির্ভর করে আপনি কত আগে টিকেট কাটছেন তার উপর।
যদি অন্ততপক্ষে দেড় থেকে দুই মাস আগে টিকেট কেটে থাকেন তবে রাউন্ড ট্রিপে ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ টাকার মধ্যেই বিমানের টিকেট হয়ে যাবে। দ্বিতীয় উপায় হলো রেলওয়ে। বাংলাদেশের ঢাকা এবং খুলনা থেকে যথাক্রমে মৈত্রী এবং বন্ধন নামের দুটি ট্রেন সপ্তাহে একদিন সরাসরি কলকাতার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
মৈত্রী ট্রেনের ভাড়া প্রায় ২,৫০০ টাকার মতো আর বন্ধন ট্রেনের ভাড়া প্রায় ১,২০০ টাকার মতো। মৈত্রী ট্রেন মূলত দর্শনা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। বন্ধন এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। তৃতীয় উপায় হলো ভেঙে ভেঙে কলকাতা যাওয়া।

এ উপায়টি সবচেয়ে সাশ্রয়ী আর কার্যকর। এক্ষেত্রে প্রথমেই ঢাকা থেকে চলে আসতে হবে যশোর বা খুলনায়। সেখান থেকে বেনাপোল যেতে হবে। ঢাকা থেকে যশোর বা খুলনার বাস ভাড়া ৫৫০- ৬০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। খুলনা থেকে বেনাপোল যাবার বেনাপোল কমিউটার ট্রেন আছে যা প্রতিদিন সকাল ৬:৩০টায় এবং দুপুর ১২:৩০টায় ছেড়ে যায় খুলনা থেকে।
ট্রেনটি যশোরের উপর দিয়েই বেনাপোল যাবে। তাই আপনি যদি যশোর থেকে উঠতে চান অনায়াসেই উঠে পড়তে পারবেন। ট্রেনের ভাড়া ৪০ টাকা খুলনা থেকে। বেনাপোল পৌছে ১০ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে চলে যান বেনাপোল বর্ডারে। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় ভিসাধারী যে কেউ বেনাপোল বর্ডার দিয়ে ভারতে প্রবেশ এবং বাহির হতে পারবেন।
বর্ডার পার হয়ে ওপাশ থেকে অটো নিয়ে ৩০ রুপি দিয়ে চলে আসুন বনগাঁ স্টেশনে। বনগাঁ স্টেশন থেকে ২০ রুপি দিয়ে বনগাঁ-শিয়ালদাহ লোকালের টিকেট কেটে উঠে পড়ুন তাড়াতাড়ি। আধ ঘন্টা পর পরই এই লোকাল ট্রেনখানা বনগাঁ থেকে শিয়ালদাহর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। শিয়ালদাহ কলকাতার অন্যতম এক স্টেশন। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে কলকাতার যেকোনো জায়গায় চলে পারবেন।
থাকবেন কোথায় কলকাতার:

পুরো কলকাতা জুড়েই ছোট বড় দামী সস্তা থাকার হোটেল রয়েছে। তবে যদি একদম বাঙালি আমেজ পেতে চান তবে সোজা চলে যাবেন কলকাতার নিউমার্কেটে। সেখানকার মার্কুইস স্ট্রীটকে ছোটখাটো বাংলাদেশ বলা চলে। হোটেল মালিক থেকে ধরে মানি এক্সচেঞ্জার, খাবার হোটেল মালিক সবাই বাংলাদেশের। কলকাতায় থাকার জন্য দাম এবং সুবিধের দিক দিয়ে মার্কুইস স্ট্রীটের উপর কোনো জায়গা নেই।
সন্ধ্যা বেলায় চায়না টাউনের মতো জীবন-উৎসবে মেতে ওঠে মার্কুইস স্ট্রীট। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের দোকান থেকে শুরু করে রাস্তার ধারের বুট-বাদাম-লুচি-আলুভাজি সবই আছে মার্কুইস স্ট্রীটে। এখান থেকে যেকোনো জায়গায় যাওয়াও বেশ সুবিধের। মোটামুটি ৭০০ থেকে ১,০০০ রুপিতে দুইজন থাকা যায় এমন রুম পেয়ে যাবেন যা একেবারেই মধ্যবিত্তদের সাধ্যের ভেতর। যদি এর চেয়েও ভালো হোটেলে থাকতে হয় তবে মার্কুইস স্ট্রিটের একদম মাথায় খুব ভালো ভালো থাকার হোটেল পেয়ে যাবেন।
কোথায় ঘুরবেন? কীভাবে ঘুরবেন?
পুরো কলকাতা খুব ভালো করে ঘুরতে হলে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় প্রয়োজন। হেঁটে হেঁটে রাতের বেলায় কলকাতার পথে হাঁটা থেকে শুরু করে সেখানকার বাস-ট্রামে ঝুলে বসে কলকাতা ঘুরে বেড়ানোর যে তীব্র আসক্তি কাজ করে মানুষের ভেতর তা পূরণ করতে পারবেন যদি সময় বেশি থাকে। সাধারণত শুধু কলকাতা ঘুরে আসার জন্য মানুষ এত সময় ব্যয় করতে চায় না। তাই কম সময়ে বেশি জায়গা ঘুরতে একটি ক্যাব বা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফেলুন।
ইডেন গার্ডেন, কলকাতা স্টেডিয়াম, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মান্না দে ক্যাফে, পার্ক স্ট্রীট, নিউমার্কেট, বিভিন্ন মন্দির সমুহ যেমন সিদ্ধেশ্বরী কালী বাড়ি, রামকৃষ্ণ বেলুর মঠ, বিরলা মন্দির, বিরলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়াম, সাইন্স সিটি, হাওড়া ব্রীজ সহ শহরের বিভিন্ন সিনেমা হলে ঘুরে বেড়াতে পারেন কলকাতার দিনগুলোতে।

কলকাতায় এসব জায়গার অধিকাংশতেই বাসে যাওয়া যায়, বাস ভাড়াও খুবই সীমিত। আমি কলকাতার বাসগুলোর সর্বোচ্চ ভাড়া দেখেছি ৭ রুপি। তবে বাসে চলাচল করলে অনেক খানি পথ হাঁটতেও হবে। এদিক দিয়ে যেমন কষ্ট হবে তেমনি শহরটাও চেনা হয়ে যাবে আপনার।
তবে আপনার যদি তত সময় না থাকে আর একটু আরামে ঘুরে নিতে চান উপরের সব কয়টি জায়গা তবে একটি ক্যাব বা ট্যাক্সি ভাড়া করুন। মোটামুটি ১,২০০-১,৮০০ রুপির মধ্যে চারজনের একটি ট্যাক্সি বা ক্যাব পাওয়া যাবে। তাই কলকাতায় যাওয়ার আগে গ্রুপ বানান ৪ এর গুণিতকে, যেমন ৪ জন, ৮ জন, ১২জন ইত্যাদি।
কী খাবেন কলকাতায় গিয়ে:
কলকাতায় আর যাই হোক, আপনাকে লাগাতার নিরামিষ খেয়ে মরতে হবে না। এখানে সব ধরনের হোটেলই আছে। তবে কেউ যদি খাসীর মাংসের প্রেমিক হয়ে থাকেন তবে বাবুঘাটে হাওড়ার পাড়ে মিলে কলকাতার সবচেয়ে বিখ্যাত খাসীর মাংস। এমনিতে স্ট্রিট ফুডের জন্য কলকাতা প্রচুর বিখ্যাত। একদম সাধারণ স্ট্রিট ফুডগুলো কীভাবে আপনার প্রিয় হয়ে যাবে বুঝবেনই না।
আর হোটেলের আশেপাশে যদি ভালো খাবার চান তবে কষ্ট করে বাঙালি হোটেল খুঁজুন। মার্কুইস স্ট্রিটে একটি হোটেল আছে, হোটেল ধানসিঁড়ি। আমি বলবো আপনার হোটেল যদি মার্কুইস স্ট্রিট বা তার আশেপাশে হয় তবে অবশ্যই এই খাবার হোটেলে একবার ঢুঁ মেরে আসবেন, তারপর থেকে খাবার জন্য অন্য কোনো হোটেলে ঢুকবেন নাকি আমার তাতে সন্দেহ আছে।

খাবারের দাম যথেষ্ট ন্যায্য কলকাতায়। সকালের নাস্তা সারা যায় ১৭ থেকে ২০ রুপি দিয়ে চারটা আটার রুটি, ডিম আর আলু তড়কা খেয়ে। দুপুর আর রাতের খাবারে খরচ হবে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা যদি আগে থেকে জেনে নেন মেন্যুতে যে আইটেমের কথা বলা আছে তাতে কয়টা পিস পাওয়া যাবে। সে হিসেবে একটা অর্ডার দিলে কতজন খেতে পারবেন ভালো করে সেটা হিসেব করে নিন ঐকিক নিয়মে।
মনে রাখবেন, বাজেট ট্রাভেলাররা কখনো সাধারণ খাবার-দাবারের পেছনে টাকা নষ্ট করে না, স্পেশাল কিছু থাকলে শুধু চেখে দেখার জন্য খেয়ে নিন। খাবার ক্ষেত্রে সতর্কতা পালন করুন, কারণ আপনি চাইলেই সারাদিনের খাবার খরচ ৩৫০ রুপির মধ্যে থাকবে, আবার আপনার ইচ্ছে হলে সেটা ৭০০-৮০০ রুপি পর্যন্ত চলে যেতে পারে। তাই ঠিক করুন কী খাবেন, কতটুকু খাবেন।

কলকাতায় স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে কোনো দ্বিধা বোধ করবেন না। চোর-বাটপার থেকে সাবধান থাকুন, বেশি রাতের বেলায় স্টেশন এলাকায় চলাফেরা করা থেকে বিরত থাকুন। কলকাতার রাস্তায় চলার জন্য সবচেয়ে ভালো মাধ্যম “উবার”। উবারের গাড়ি ভাড়া সাধারণ গাড়ি ভাড়া থেকে সবসময়ই ৫০ রুপি কম হয়ে থাকে, আর গাড়িগুলোও থাকে সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তাই শহরের অভ্যন্তরীণ চলাফেরায় সুবিধের জন্য ফোনে উবার ইন্সটল করে নিন।
কলকাতার পিক সিজন হচ্ছে দূর্গাপূজার সময়টা। তাই যতটা পারুন সে সময়টায় কলকাতা যাওয়ার চিন্তা বাদ দিন, যদি পূজা দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে তবে হোটেলের রুম বুক দিয়ে দিন ঠিক এক মাস আগে থেকে, নাহলে কলকাতার কোনো হোটেলেই পাবেন না থাকার জায়গা। হোটেল বুকিং দেয়া যাবে “Booking.com” থেকে। ভ্রমণ হোক সুন্দর, সাশ্রয়ী আর নিরাপদ।
ফিচার ইমেজ- লেখক
১৫ থেকে ২০ দিন কেন লাগবে? পুরো কলকাতা ৫ দিনেই শেষ হয়ে যাবে।হ্যাঁ ঠিক লিখেছেন ক্যাব ভাড়া করুন ১২০০-১৪০০ টাকা ১০ ঘন্টা ঘুরুন।কলকাতার নাইট লাইফ এনজয় করুন পার্কস্ট্রিট,ক্যামাক স্ট্রিট থিয়েটার রোডে (তন্ত্রা,ভেনম, হোটেল হিন্দ্যস্তান এর নাইট ক্লাব)বাবুঘাটে সন্ধ্যায় ফ্লোটেল এ সন্ধ্যা কাটান এসবে একটু খরচ পরবে। নাইট ক্লাবে মহিলা ছাড়া ঢুকতে দেবে না সেক্ষেত্রে মহিলার এন্ট্রি ফি লাগে না।কলকাতার রাস্তায় রাত ১১টা পর্যন্ত নিরাপদ।