লুর্দের রাণী মা মারিয়া ধর্মপল্লীর অপর নাম বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন। লালপুর, বাঘা, শহীদ সাগর, দয়ারামপুর ঘুরে বনপাড়া ফিরে এসে লুর্দের রাণী মা মারিয়া ধর্মপল্লী খোঁজার মিশনে নামলাম। কাউকে কিছু না জিজ্ঞেস করে হাঁটতে শুরু করলাম নাটোর-রাজশাহী হাইওয়ে ধরে। কিছুক্ষণ পর আমার কনফিউশন হলো, ঠিক রাস্তায় আছি তো? পায়ে পায়ে তবুও এগিয়ে যাই।
রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই। এক মহিলাকে দেখে জানতে চাইলাম, ‘চার্চটা কোন দিকে, বলতে পারেন?’ মহিলা ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলো। ভাবখানা এমন যে, চার্চ কী জিনিস? খায় না মাথায় দেয়? মহিলাকে ওই অবস্থায় রেখে আমরা আবারোও হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ এগিয়ে যাওয়ার পর একটা ডিসপেনসারি দেখতে পেয়ে ফার্মাসিস্টকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। এবারে আর চার্চ বলিনি। বলেছি, ‘গীর্জাটা কোথায়?’ আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল। আমরা ঠিক রাস্তাতেই আছি।
বেশ অনেকটা পথ হেঁটে তারপর দেখা পেলাম চার্চটির। মেইনরোড ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা পার্শ্ব রাস্তা চলে গেছে ডান দিক দিয়ে। সেখান দিয়ে যাওয়ার পথেও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতে হয়েছে। যতই সামনের দিকে এগিয়েছি, মানুষজন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেছে, কোত্থেকে এসেছি, কী কাজে এসেছি।
মেইন গেইট দিয়ে ঢোকার আগেই মনে হলো, কেমন একটা থমথমে পরিবেশ। কেউ উঁকি দিলেই বিশালাকার কোনো জ্বীন যেন হা হা করে ধরতে আসবে। সত্যিই কোনো জ্বীন ধরতে এসেছিল কি না, তা জানার আগে চলুন এই ধর্মপল্লীর ইতিহাস জেনে আসি।
খ্রিস্টধর্ম পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে বলা হয় খ্রিস্টমণ্ডলী বা সংক্ষিপ্তাকারে শুধু মণ্ডলী। মণ্ডলী কর্তৃপক্ষের মূল পরিচালনা কেন্দ্র ভাটিকান বা রোম। স্থানীয়ভাবে খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসী জনসাধারনকে পরিচালনা ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যা করা বা সেবা দানের উদ্দেশ্যে গঠিত একটি সাংগঠনিক কর্ম এলাকাকে ধর্মপল্লী বলা হয়। লুর্দের রাণী মা মারিয়া ধর্মপল্লীটি খ্রিষ্ট ধর্মানুযায়ী ঈশ্বরপুত্র যীশু খ্রিস্টের জাগতিক জননী মারিয়া বা মরিয়ম-এর পূণ্য নামের স্মৃতিতে উৎসর্গিত।
ঐতিহ্যবাহী বড়াল নদীর দক্ষিণে বনপাড়া নামক একটি গ্রামে ধর্মপল্লীর জন্য নির্ধারিত র্গীজাটি অবস্থিত। যেখানে ১৯৪০ সালের দিকে প্রথম স্বর্গীয় ফাদার থমাস কাত্তানের (পিমে), একজন ইতালীয় ধর্মযাজক সর্বপ্রথম আসেন এবং গীর্জাঘরটি স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে।
ধর্মপল্লীর অর্ন্তগত গ্রামগুলোতে প্রায় সাত হাজার ক্যাথমিক খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসী মানুষ বসবাস করেন। খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীগণের মধ্যে ৯৫ শতাংশ বাঙালি এবং ৫ শতাংশ সাঁওতাল ও অন্যান্য আদিবাসী। সাধারণত, খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীগণ এলাকার গ্রামগুলোতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীগণের সাথে (ইসলাম ধর্মাবলম্বী- মুসলমান ও সনাতন ধর্মাবলম্বী-হিন্দু) মিলেমিশে পাশাপাশি বসত করেন।
ধর্মপল্লীর নিয়মকানুন:
এ ধর্মপল্লীর অধিনস্থ খ্রিস্ট বিশ্বাসীগণ প্রায় ১০০ ভাগ স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন ও ৮০ শতাংশ শিক্ষিত। এখানকার খ্রিস্ট বিশ্বাসীগণ অত্যন্ত শৃংখল একটি সামাজিক কাঠামোর মধ্যে বসবাস করেন। প্রতিটি গ্রামে খ্রিষ্টানদের সামাজিক সুবিধা প্রদান ও পরিচালনার জন্য একটি সমাজ ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং খ্রিস্টধর্মাবলম্বী জনসাধারণ দ্বারা নির্বাচিত জন প্রতিনিধি রয়েছেন, যিনি গ্রামের জনগণের সামাজিক সমস্যাসমূহ সমাধান করেন। পারস্পারিক শান্তি ও সৌহার্দ্য রক্ষার প্রয়োজনে তিনি সালিশও পরিচালনা করেন। গ্রামবাসী কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে তিনি ধর্মপল্লী পরিচালনার স্খানীয় মাণ্ডলীক প্রশাসন- ‘পালকীয় পরিষদ’ এর একজন পরিচালক সদস্য হন।
সাধারণত, ধর্মপল্লীর প্রধান পালক পালকীয় পরিষদের সভাপতি বা চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। জনসাধারণের সর্বোচ্চ পদ হলো সহ-সভাপতি। বিভিন্ন গ্রাম থেকে নির্বাচিত জন প্রতিনিধিগণের গোপন ভোটের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য পদাধিকারীগণ নির্বাচিত হন। পালকীয় পরিষদ এই ধর্মপল্লীর বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে।
ধর্মপল্লীর জীবনযাপন:
এই ধর্মপল্লীর অধীনস্থ মানুষজন (খ্রিস্টান) মূলত কৃষিকাজ করেন। কেউ কেউ চাকরিজীবি। এ এলাকার আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় স্থানীয় খ্রিস্টানগণের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। প্রতিনিয়তই তারা কৃষির আধুনিকায়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা চালান। কৃষি নির্ভর প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকেই ১/২ জন সদস্য পড়ালেখা, চাকরি ও ব্যবসায়ের জন্য ঢাকা, রাজশাহী, দিনাজপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য শহরে বাস করেন। তবে এ ৪টি শহরেই সংখ্যাধিক্য বেশি।
এছাড়া এখানকার বেশ কিছু খ্রিস্টান চাকরি সূত্রে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী এবং তারা বিগত প্রায় চার দশকে বনপাড়া ধর্মপল্লীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা পালন করছেন। তবে সম্প্রতি শিক্ষার হার বাড়ার পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খ্রিস্টান ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে গমন করছেন।
বর্তমানে দুইজন যাজক ধর্মপল্লী পরিচালনা ও পরিচর্চার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। তারা হলেন- (১) ফাদার দিনো জ্যাকোমিনেল্লী, পিমে, (২) ফাদার আন্তনী হাঁসদা।
পায়ে পায়ে খানিকটা ভয় নিয়েই গীর্জার সীমানার মধ্যে ঢুকলাম। ঢালাই করা রাস্তা। রাস্তার দুইপাশে দুই বাউন্ডারি। ডানপাশের বাউন্ডারি ছাপিয়ে কিছু দেখা না গেলেও বামপাশের বাউন্ডারির উপর দিয়ে প্রায় পাঁচ তলা সমান উচ্চতার এক নারীমূর্তি দেখতে পেলাম। গলায় ক্রুশ ঝুলছে। এটাই নিশ্চয়ই মাতা মারিয়া। সৌম্য চেহারার ওই দ্যুতি দেখতে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু সেই একই ঘটনার পুনরাবৃতি। জ্বীন ধরতে না এলেও গোমড়ামুখো এক দারোয়ান বসে আছে চার্চে ঢোকার প্রবেশপথে। কয়েকবার অনুরোধ-উপরোধ করেও ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাওয়া গেল না।
গেটের বাইরে থেকেই লুর্দের রাণী মা মারিয়া ধর্মপল্লীটা দেখে নিলাম। দূর থেকেই ছবি তুলে নিলাম। একটা ভালো ক্যামেরার অভাব বোধ করলাম আবারো।
অবস্থান:
নাটোর জেলার দক্ষিণ সীমানায় বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পৌরসভার ৫টি ও ১ নং জোয়াড়ী ও ৫ নং মাঝগ্রাম ইউনিয়নের ২টি সহ মোট ৭টি গ্রাম নিয়ে এই ধর্ম পল্লী প্রতিষ্ঠিত।
কীভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে নাটোর চার ঘণ্টার পথ। কিন্তু ভাঙা রাস্তা আর জ্যামের কারণে চার ঘন্টায় যাওয়া যায় না। গ্রিনলাইন ও হানিফ পরিবহনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সহ শ্যামলী ও ন্যাশনাল ট্রাভেলসের বাস এ পথে নিয়মিত চলাচল করে। এ ছাড়া রাজশাহী গামী যে কোনো বাসে অথবা ট্রেনে নাটোর যাওয়া যাবে। বাসে সময় লাগে ৬-৭ ঘণ্টা। ট্রেনে আরোও বেশি।
বাসে এলে বনপাড়াতেই নেমে যেতে পারেন। আবার নাটোর সদর গেলে সেখান থেকে বনপাড়া আসার বাস পাবেন। নাটোরের বনপাড়া থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে লুর্দের রাণী মা মারিয়া ধর্মপল্লী। রিকশায় বা ভ্যানে করে যাওয়া যায়।
ফিচার ইমেজ: নাটোর ডিস্ট্রিক্ট