বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা দুটি লাইন দিয়ে শুরু করছি,
“দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার,
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার!”
সেই দুর্গমগিরি পাড়ি দিতেই যেন কদিন আগে দলবেঁধে ঘুরে আসলাম রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার তিনটি ঝর্ণা থেকে। আক্ষরিক অর্থেই ঝর্ণাগুলোতে যেতে হয় খুব দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে, তবে আমাদের বেলায় সে পথ আরও দুর্বিষহ করে দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় ‘তিতলী’।

যাই হোক, স্বল্প বাজেটের এক রাত দুই দিনের এই ছোট ট্রিপের আপ টু বটম বর্ণনার চেষ্টা করবো এই লেখায়।
মূলত আমাদের ট্যুর প্ল্যান ছিল এরকম –
দিন-১: ঢাকা-কাপ্তাই-বিলাইছড়ি-মুপ্পোছড়া ঝর্ণা-ন’কাটা ঝর্ণা-বিলাইছড়ি।
দিন-২: বিলাইছড়ি-উলুছড়ি-ধূপপানি ঝর্ণা-কাপ্তাই-ঢাকা।

দিন-১
ঢাকা-কাপ্তাই-বিলাইছড়ি
ঢাকা থেকে রাত দশটার বাসে আমরা কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা করি। ঢাকা-কাপ্তাই র্যুটে শ্যামলী, ইউনিক, সৌদিয়া, ডলফিন সহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস চলাচল করে। ভোর ৬টায় কাপ্তাই বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যাই।
সেখান থেকে ৫ মিনিট হাঁটলেই ঘাট। ঘাটেই একটা হোটেলে হালকা সকালের নাস্তা সেরে ট্রলার দুইদিনের জন্য ভাড়া করে ফেলি। ট্রলারে করে বিলাইছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই সকাল ৭টায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাই আমাদের গন্তব্য বিলাইছড়িতে।
- ঢাকা-কাপ্তাই (বাস)= ৫৫০/-
- কাপ্তাই ঘাটে নাস্তা= ৩৫/-
- ট্রলার ভাড়া (দুই দিনের জন্য)= ৫,২০০/-

বিলাইছড়ি-মুপ্পোছড়া ঝর্ণা-ন’কাটা ঝর্ণা-বিলাইছড়ি
বিলাইছড়িতে নেমে দ্রুত হোটেল ঠিক করে ফেলি। স্মৃতিময় আবাসিক বোর্ডিং। তুলনামূলক এটিই এখানকার সবচেয়ে ভালো হোটেল বলা যায়। হোটেলে চেক ইন করে ফ্রেশ হয়ে চলে যাই দিগন্ত পাহাড়ি হোটেলে।
সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে ট্রলারে করে আবার রওনা দেই মুপ্পোছড়া ও ন’কাটা ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। আমরা এখানেই রাতের খাবার ও সকালের জন্য খিচুড়ি ডিম অর্ডার দিয়ে যাই। বিলাইছড়ি ঘাটেই গাইড পাওয়া যায়।

ট্রলার থেকে নেমে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যাই মুপ্পোছড়া ঝর্ণায়। সেখান থেকে ফেরার পথে ন’কাটা ঝর্ণা। ট্রলারে করে সন্ধ্যার মধ্যে বিলাইছড়ি।
- স্মৃতিময় আবাসিক হোটেল= ২,৭০০/- দিয়ে আমরা ৫ রুম নিয়েছিলাম। প্রতিরুমে ৪ জন থাকা যায় অনায়াসেই।
- দুপুরের খাবার:
ভাত, মাছ/মুরগী, ডাল= ৬০/- - গাইড খরচ= ৫০০/-
- ঘাট খরচ= ১০০/-
- রাতের খাবার:
ভাত, মাছ (আইড়/কালিবাউশ), আলু ভর্তা, ডাল= ৮৫/-

দিন-২
বিলাইছড়ি-উলুছড়ি
ভোর পাঁচটায় উঠে ফ্রেশ হয়ে দিগন্ত হোটেল থেকে ডিম খিচুড়ির প্যাকেটগুলো নিয়ে ট্রলারে করে উলুছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই। ভোরের কুয়াশাময় কাপ্তাই লেক সত্যিই খুব অসাধারণ।
প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে উলুছড়ি পৌঁছে যাই। সেখানে দুপুরের খাবার অর্ডার করে গাইড ঠিক করি।
- গাইড খরচ= ৫০০/-

উলুছড়ি-ধুপপানি ঝর্ণা-উলুছড়ি
ছোট ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে কিছু পথ গিয়ে হাঁটার রাস্তায় চলে আসি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাই ধুপপানি নামক আদিবাসীদের একটি গ্রামে। এখানে পৌঁছুতে প্রায় ৭-৮ বার পাহাড়ে উঠতে ও নামতে হয়।
গ্রামে ছোট্ট একটি দোকানে রয়েছে, সেখানে বিশ্রাম নেই। সাথে ছিল পাহাড়ি সুস্বাদু কলা। সেখান থেকে আরও আধা ঘণ্টার পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নেমে পৌঁছে যাই কাঙ্ক্ষিত ধুপপানি ঝর্ণায়।

ঝর্ণায় ঘণ্টা খানেক সময় কাটিয়ে আবারও একই পথে ফিরে আসি উলুছড়িতে। তবে ফেরার পথে বেশিরভাগ পথ নিচের দিকে হওয়ায় দেড় ঘণ্টায় উলুছড়িতে পৌঁছে যাই। পথে এক আদিবাসীর কাছ থেকে সুস্বাদু পাকা পেঁপে পেয়ে যাই।
- আদাবাসীদের দোকানে চা নাস্তা= ৩৫/-
- দুপুরের খাবার:
ভাত, মুরগী, সবজি, ডাল= ১০০/- - পেঁপে= ২০০/- (বড় সাইজের ২টি, মাঝারি সাইজের ২টি)
- ডিঙ্গি নৌকা= ২০০/- (আসা যাওয়া)

উলুছড়ি-কাপ্তাই-ঢাকা
দুপুরের খাবার খেয়ে ট্রলারে করে রওনা দেই। প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টার দীর্ঘ বোট জার্নি করে কাপ্তাই ঘাটে পৌঁছাই। তখন প্রায় রাত ৮টা বাজে। সেখানে ঢাকার বাসের টিকেট কেটে সকালের মধ্যে ঢাকায় চলে আসি।
- কাপ্তাই-ঢাকা (বাস)= ৫৫০/-
- ট্রলার চালকের বখশিশ= ২০০/-

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- সম্পূর্ণ ট্রিপে ৩ জায়গায় আর্মি চেকপোস্টে সাইন ইন ও সাইন আউট করতে হবে।
- ন্যাশনাল আইডি কার্ড কিংবা স্টুডেন্ট আইডির ৪ কপি ফটোকপি সাথে রাখতে হবে।
- ধুপপানি ঝর্ণায় যাওয়ার সময় ব্যাগ ট্রলারেই রেখে যাবেন মাঝির কাছে।
- ঝর্ণায় গোসলের সময় ইলেক্ট্রনিক গেজেট সহ জরুরী জিনিসপত্র গাইডের কাছে স্বাচ্ছন্দ্যেই রেখে যেতে পারবেন।
- বেশি করে পলিব্যাগ সাথে রাখুন।
- যথাসম্ভব হালকা জামা কাপড় পরিধান করুন। টিশার্ট ও শর্টপ্যান্ট ব্যবহার করলেই সবচেয়ে ভালো হবে।
- পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠতে ও নামতে হবে। তাই ট্রেকিং শ্যু পরা আবশ্যক।
- সাথে যথেষ্ট পরিমাণ খাবার পানি ও স্যালাইন রাখুন।
- ঝর্ণায় ট্রেকিং করার জন্য সাথে বাঁশের লাঠি থাকা বাঞ্ছনীয়। গাইডকে বললেই লাঠি যোগাড় করে দিবে।
- আমরা ১৮ জনের গ্রুপ ছিলাম। ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে আবার ঢাকায় ফেরত আসা পর্যন্ত পার হেড ২,০৬০/- খরচ হয়। চট্টগ্রাম থেকে গেলে এই খরচ অর্ধেকে নেমে আসবে।
- সর্বোপরি কাপ্তাই লেকে ও ঝর্ণায় কোনো ধরনের পচনশীল ও অপচনশীল আবর্জনা ফেলবেন না। বোতল, চিপ্সের প্যাকেটসহ প্লাস্টিকের আবর্জনাগুলো ব্যাগে সংগ্রহ করুন।