আমরা এসেছিলাম যদুনাথ রায়ের জমিদার বাড়ি দেখতে। বড় পুকুরটির পাশের একটা ভবন আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল। ভবনটিতে ঠিক যতগুলো প্রবেশদ্বার, তত সারি সোপান। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম এক সারি সিঁড়ির সামনে। বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ভবনটি পরিত্যক্ত। উপরে উঠে দেখি বেশ কয়েকটা কক্ষ। দেয়ালগুলোয় হাবিজাবি অনেক কিছু লেখা।
একটা কক্ষের দরজার উপর লেখা, “অফিস ঘর”। বোঝাই যাচ্ছে বর্তমান সময়ে লেখা। তারমানে এই ভবনটি কোনো কাজে ব্যবহার করা হতো। এ ঘর, ও ঘর ঘুরে এক জায়গা দিয়ে বেরুতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমি ভবনটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। তার মানে পিছনের দিকে ঢুকেছিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি, জরাজীর্ণ আলিশান প্রবেশদ্বারটির উপরে একটি সাইনবোর্ড লাগানো। ওতে লেখা,
“আমরা আলোর পথযাত্রী
বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন
বালাশুর, বিক্রমপুর, বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ”

বিক্রমপুর জাদুঘরের পূর্বের ভবন; Source: মাদিহা মৌ
বুঝতে পারলাম, ব্যবহারের অযোগ্য হবার আগে এই ভাগ্যকূল জমিদারের এই ভবনটি বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। হয়তো দেখতে ঠিকঠাক রকমের বাড়িটি খুব বেশি বিপজ্জনক বলে এখান থেকে জাদুঘরের কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
পরিত্যক্ত জাদুঘরের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা রয়েছে, সেখান থেকে সামনে তাকালেই একটা নতুন বানানো লাল রঙের আড়াই তলা ভবন। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম, বর্তমানে এখানেই বিক্রমপুর জাদুঘরের কার্যক্রম চলছে।

জমিদার বাড়িতে চলতো বিক্রমপুর জাদুঘরের কার্যক্রম ; Source: মাদিহা মৌ
ভাগ্যকুলের জমিদারদের সকলেরই কলকাতায় বাড়ি ছিল। দেশ ভাগের পর তারা ধীরে ধীরে এদেশ ছেড়ে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। দেশভাগের পরেও আঠারো বছর পর্যন্ত শুধুমাত্র যদুনাথ রায় তার বিলের ধারে নিজের তৈরি প্রাসাদে ছিলেন। তিনি ভাগ্যকুল ত্যাগ করতে চাননি। বৃদ্ধ বয়সে তার আত্মীয়-স্বজনরা জোর করে ভাগ্যকুল থেকে তাকে কলকাতায় নিয়ে যায়। তিনি কলকাতায় গিয়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন। যদুনাথ রায়ের বাড়িটি দীর্ঘদিন অযত্নে অবহেলায় পড়েছিল। পরিণত হচ্ছিল ধ্বংসস্তূপে।
বর্তমানে “অগ্রসর বিক্রমপুর” এই বাড়িটি রক্ষায় এগিয়ে এসেছে এই প্রত্যয়ে যে, তারা ফিরিয়ে আনবে আগের অবয়ব। স্থাপন করবে বিক্রমপুর জাদুঘর ও সংস্কৃতি কেন্দ্র, থাকবে পর্যটন কেন্দ্র, গেস্ট হাউজ, থীমপার্ক, নৌ-জাদুঘর ইত্যাদি। তারই কার্যক্রম হিসেবে, সেই সাথে জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়িটির স্মৃতি রক্ষার্থে প্রায় সাড়ে ১৩ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘর। জাদুঘরটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। জাদুঘর ভবন উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবং এর দ্বারোদঘাটন করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক এমপি আসাদুজ্জামান নূর।

ভবনটিতে ঠিক যতগুলো প্রবেশদ্বার, তত সারি সোপান; Source: মাদিহা মৌ
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ এবং সরকারি অর্থায়নে নির্মাণ করা হয়েছে জাদুঘর, গেস্ট হাউজ, থিমপার্ক। জাদুঘরের প্রথম তলায় দুইটি গ্যালারি করা হয়েছে। তিনতলা ভবনের এ জাদুঘরে প্রবেশ করলেই দুইপাশে দেখা যাবে দুইটি বড় মাটির পাতিল। নিচতলার বাম পাশের গ্যালারিটি যদুনাথ রায়ের নামে।
এ গ্যালারিতে বিক্রমপুরের প্রাচীন মানচিত্র, রঘুরামপুর, নাটেশ্বরসহ বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া পোড়ামাটির নল, মাটির পাত্র, পোড়ামাটির খেলনা সহ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে। নিচতলার ডান পাশের গ্যালারিটি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে। এ গ্যালারিতে আছে ব্যাসাল্ট, পাথরের বাটি, গামলা, পাথরের থালা, পোড়ামাটির ইট, টালি, বিক্রমপুরের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার ছবি সহ বিভিন্ন নিদর্শন।

আড়াইতলা ভবন; Source: মাদিহা মৌ
দ্বিতীয়তলার বাম পাশে মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে দেখা যাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি, ইতিহাস, দলিল, বই, বিভিন্ন নমুনা সহ আরো অনেক কিছু। ডান পাশের গ্যালারিতে রয়েছে বিক্রমপুরে জন্ম নেয়া মনীষীদের জীবন ও কর্মের বৃত্তান্ত। আরও আছে কাগজ আবিষ্কারের আগে প্রাচীন আমলে যে ভূর্জ গাছের বাকলে লেখা হতো সেই ভূর্জ গাছের বাকল, তালপাতায় লেখা পুঁথি, কাঠের সিন্দুক, পাকিস্তান আমলের মুদ্রা, তাঁতের চরকা, পোড়ামাটির মূর্তি, সিরামিকের থালা সহ প্রাচীন আমলে স্থানীয় মানুষের ব্যবহার্য বিভিন্ন নিদর্শন।
বিক্রমপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৯৮ সালের ২৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে অগ্রসর বিক্রমপুর সংগঠনটি। লৌহজংয়ের কনকসারে পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় এর যাত্রা। সংগঠনের উদ্যোগে মুন্সীগঞ্জের মালপাড়ায় নির্মাণ করা হয়েছে গবেষণা কেন্দ্র। এছাড়া ক্রমান্বয়ে নেওয়া হয়েছে অনেক উদ্যোগ।

জাদুঘরের সামনের অংশ; Source: মাদিহা মৌ
অগ্রসর বিক্রমপুর যদুনাথ রায়ের জমিদার বাড়িটি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে এখানে স্থাপন করেছে এ জাদুঘর। সামনে জাদুঘরে আরও নিদর্শন বাড়ানো হবে। এখানে একটি নৌকা জাদুঘরও আছে। নৌকা জাদুঘরে রাখা হবে ভাগ্যকুলের জমিদারের প্রাচীন নৌকা। ধীরে ধীরে এ পুকুরে ভাসানো হবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নৌকা। এরকম নৌকা জাদুঘর এ দেশে এটাই প্রথম।
পুরো জাদুঘর, সেই সাথে যদুনাথ রায়ের জমিদার বাড়ি নিয়ে কর্তৃপক্ষের মহাপরিকল্পনা রয়েছে। জমিদার বাড়ির পশ্চিমে দীঘির পাড়ে দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা করা হবে। বাড়ির বিশাল খালি জায়গায় বসানো হবে উন্মুক্ত প্রদর্শনী যার নাম ‘ঐতিহ্য প্রাঙ্গণ’। এ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বসতবাড়ির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ঘর ও উঠান প্রদর্শিত হবে এবং এসব বাড়ি সজ্জিত করা হবে ওই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, নকশা ও উপকরণ দিয়ে। সেখানে থাকবে উপজাতিদের বাহারী রঙের নকশা করা ঘর, কাঠ ও মাটির তৈরি একতলা-দোতলা ঘর। সেখানে রাখা হবে প্রায় বিলুপ্ত হওয়া চাল কাটা ঢেঁকি সহ নানান গ্রামীণ ঐতিহ্য। আমি এই পরিবর্তিত জমিদার বাড়ির ঝলকানি দেখতে খুবই আগ্রহী।
সময়সূচী
শীতকালীন সময়ে জাদুঘরটি খোলা থাকে শনিবার থেকে বুধবার সকাল ৯টা থেকে ১টা এবং দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পযর্ন্ত। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটি। শুক্রবার বেলা ২টা থেকে ৫টা পযর্ন্ত খোলা থাকে। কোনো প্রবেশ মূল্য নেই।

প্রবেশদ্বার; Source: মাদিহা মৌ
কীভাবে যাবেন
ঢাকা গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজারের পাশ থেকে দোহারের উদ্দেশে বাস ছাড়ে কিছুক্ষণ পর পর। বাস কন্টাক্টরকে বলে রাখবেন, বালাসুর চৌরাস্তা নামবো। ৬০ টাকা ভাড়া নেবে। এছাড়া পোস্তগোলা থেকেও যেতে পারেন বালাসুর। চৌরাস্তা থেকে এতিমখানা রোডে যাওয়ার অটো পাবেন। ভাড়া নেবে ১০ টাকা প্রতিজন।
এতিমখানা রোড থেকে যদুনাথ রায়ের জমিদার বাড়ি পেরিয়ে একটু ভেতরের দিকে গেলেই পেয়ে যাবেন অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
Feature Image: মাদিহা মৌ